Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মণ্ডপে হাতে হাত রেখেছেন পিরবাবা আর লাড্ডুগোপাল

দশ মাস আগের কালো রাতগুলোয় সেই অদৃশ্য উপস্থিতিই ভরসা জুগিয়েছিল শ্যামল দেবনাথের মনে। প্যান্ডেলের ফ্যাটফেটে হ্যালোজেনেও তাই বদরতলার পিরসাহেবের নামে কপালে হাত ঠেকান নাথপাড়া তরুণ সংঘ সর্বজনীনের সম্পাদক।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:১৮
Share: Save:

রাতের আঁধার চিরে সাদা ঘোড়া হাঁকিয়ে নাকি ছুটে যান তিনি। শুনেছেন ওঁরা।

দশ মাস আগের কালো রাতগুলোয় সেই অদৃশ্য উপস্থিতিই ভরসা জুগিয়েছিল শ্যামল দেবনাথের মনে। প্যান্ডেলের ফ্যাটফেটে হ্যালোজেনেও তাই বদরতলার পিরসাহেবের নামে কপালে হাত ঠেকান নাথপাড়া তরুণ সংঘ সর্বজনীনের সম্পাদক। সাবেক গোরস্থানের পাশে বদরসাহেবের থানকে মন্দিরই বলেন নাথপাড়ার হিন্দুরা। দেবীপক্ষেও ফি-শুক্রবার মানতের সিন্নি চড়ে। বিয়ের পর নতুন বর-বউ পিরবাবাকে প্রণাম করেই গ্রামে ঢোকেন।

দশ মাস আগে শ্যামলবাবুর ভাগ্নে-ভাগ্নেবউয়ের বিয়ে করে ফেরাটা অবশ্য মসৃণ হয়নি। গাড়িটা ধূলাগড়ে ঢুকতেই বোমার শব্দে কানে তালা! ব্যানার্জিপোলের দিকটায় কীসের জটলা! দু’দিনের মধ্যে পাড়াছাড়া আত্মীয়কুটুম, নবদম্পতি। বৌভাতের প্যান্ডেল পড়ে রইল যে কে সেই!

পাড়ার পুজোকর্তা শ্যামলবাবু অনুকূল ঠাকুরের ভক্ত! হপ্তায় চার দিন শুদ্ধ শাকাহারী। তাঁর কিন্তু স্থির বিশ্বাস, বদরসাহেবের আশীর্বাদেই সব আবার আগের মতো হয়েছে।

দশ মাস আগে ব্যানার্জিপোলের কয়েক ঘণ্টা তাণ্ডবেই পাল্টে গিয়েছিল ধূলাগড়। সে-দিনের পোড়াবাড়ির স্মারক এখন আনকোরা নীলসাদা দেওয়াল! তার সামনেই এ তল্লাটের বড় পুজো।। ধূলাগড়ি ব্যানার্জিপোল ঠাকুরদালান দুর্গাপূজা কমিটির সোমনাথ দেবনাথ বলেন, ভিড়ের ৭০ ভাগই হাজিসাহেবপাড়া, বাদামতলার পড়শি!

নাথপাড়ার প্যান্ডেলের মাঠেও শ্যামল, সুভাষ, সুজয়দের সঙ্গে মিশে যান দেওয়ানপাড়ার মুস্তাক, মহসিন, কালোমানিক! পুজো মানে সাঁঝসকাল জরির সুতোর আলপনা থেকে মুক্তির দিন। উল্টো দিকের সাদা-সবুজ পাকাবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন ওস্তাগর আয়নাল দেওয়ান। কাজের সময়কার গেঞ্জি-লুঙ্গির বদলে ইস্ত্রি করা কুর্তা-পাজামায় তিনি যেন অন্য মানুষ!

দশ মাস আগের সেই দুপুরে দাওয়ায় একসঙ্গেই ঘাড় গুঁজে বসেছিলেন আয়নাল, পুত্র আরুশ আমিন, পাশের বাড়ির ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ, প্রৌঢ় অনিল দেবনাথ, হিরা শেখ, সিরাজুল শেখরা! কাঠের ফ্রেম বা ঢা়ড্ডায় ফেলে, রাসলীলার নকশা বুনেই চুল পেকেছে আয়নালের। বাদামতলার বড় মোনা, দেওয়ানপাড়ার নাদিম শেখ, আসিফ সর্দাররা সব ওস্তাদ খাকাওয়ালা! খাকা মানে জরির সাজের নকশা! রাধাকৃষ্ণ, গোপালঠাকুর, ওম চিহ্ন, মঙ্গলঘট অবিকল ফুটিয়ে তোলেন খাকাওয়ালারা।

নতুন-নতুন ডিজাইনের লোভে তাঁদের ঘরে ধর্না দেয় ওস্তাগরের দল। ক্যালেন্ডারের কৃষ্ণঠাকুরকে একবারটি দেখে চোখ বুজে কী চিন্তা করেন, বড় মোনা! উডপেন্সিলের একটানে ফুটে ওঠে নকশা। জন্মাষ্টমী-রাখীপূর্ণিমার আগে ধূলাগড়ের ওস্তাগরদের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েন পেন্সিলের শ্রীকৃষ্ণ!

আয়নাল বলেন, আমার ঘরে সব পাবেন, রাসলীলা থেকে লাড্ডুগোপাল! মাথায় হাত দিয়ে দেখান কী ভাবে পরতে হয় রাধাকৃষ্ণের মাথাপট্টি। আর পিঠে বসবে গোলাকার বুটিতে শিশুকৃষ্ণ, লাড্ডুগোপালের ছাপ! বড়বাজারের মহাজনের হাত ঘুরে জরির এই পোশাকই রাজস্থান-গুজরাত পাড়ি দেবে! আয়নাল-আমিনুলদের হাতেই সেজে উঠবে জন্মাষ্টমীর বালগোপাল বা রাধাকৃষ্ণের দল!

একসঙ্গে কাজের ফাঁকে ইন্দ্রজিৎ আর আরুশ ভাগ করে খান রান্নাপুজোর ইলিশ! বাইক হাঁকিয়ে আন্দুলের পুজোর মেলা দেখে ফিরতে মানিকজোড়ের সন্ধে কাবার! আয়নাল-শ্যামলরা বলেন, কিছু মাথাগরম বোকা লোকের জন্য কি মিথ্যে হবে বরাবরের এই পাশে থাকা? দেওয়ান-বাড়ির ফটকে পবিত্র কাবা শরিফ ও নাথপাড়ার মণ্ডপ নিঃশব্দে চেয়ে থাকে। হাত ধরেন পিরসাহেব ও লাড্ডুগোপাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE