Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
গণ-ইস্তফার সিদ্ধান্ত পঞ্চায়েতে

গদাধরের হুমকিতে ফুঁসছে সিঙ্গি

প্রায় প্রতি শনিবারই কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটে, দলীয় কোন্দল মিটিয়ে বিধানসভায় একসঙ্গে কাজ করার আহ্বানে, জেলার নেতাদের সঙ্গে বসছেন নেত্রী। অথচ, জেলায় জেলায় শাসকদলের কোন্দল চলছেই। বীরভূমে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও বিধায়ক গদাধর হাজরা বনাম কাজলের দ্বন্দ্ব প্রায় রাজনৈতিক মহলে আর নতুন কোনও ঘটনা নয়।

বোলপুরের তৃণমূল পার্টি অফিসে অনুব্রতর সঙ্গে কাজল শেখ। —ফাইল চিত্র

বোলপুরের তৃণমূল পার্টি অফিসে অনুব্রতর সঙ্গে কাজল শেখ। —ফাইল চিত্র

অর্ঘ্য ঘোষ
নানুর শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৫৩
Share: Save:

প্রায় প্রতি শনিবারই কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটে, দলীয় কোন্দল মিটিয়ে বিধানসভায় একসঙ্গে কাজ করার আহ্বানে, জেলার নেতাদের সঙ্গে বসছেন নেত্রী। অথচ, জেলায় জেলায় শাসকদলের কোন্দল চলছেই। বীরভূমে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও বিধায়ক গদাধর হাজরা বনাম কাজলের দ্বন্দ্ব প্রায় রাজনৈতিক মহলে আর নতুন কোনও ঘটনা নয়। এ বার প্রকাশ্য সমাবেশের মঞ্চ থেকে পাল্টা এলাকা দখলের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠল নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরার বিরুদ্ধে। আর তারই প্রতিবাদে খোদ দলনেত্রীর কাছে প্রধান-সহ গণ ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন বোলপুরের সিঙ্গি পঞ্চায়েতের সদস্যরা। বিধায়ক অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

জেলার নানুর এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বহুলচর্চিত বিষয়। মধুচন্দ্রিমা শেষে দীর্ঘ দিন আগেই শুরু হয়েছে পরস্পরের কাদা ছোড়াছুড়ি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শহিদ দিবসে গোষ্ঠী কোন্দল মেটাতে যে বার্তা দিয়েছিলেন, সে বার্তা উড়িয়ে হয়েছে খুনোখুনিও। রবিবার সিঙ্গি পঞ্চায়েতের সনসত বাসস্ট্যান্ড এলাকার জনসভায় গদাধরবাবুর বক্ত্যবে ফের বেআব্রু হয়ে পড়ল তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব। নাম না করে গদাধরবাবু কাজলকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘পাপুড়ির ওই ডাকাতটাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, পাপুড়ি গ্রামটা দখল করেতে আমাদের ৫ মিনিটও সময় লাগবে না। তাকে দলে থাকতে হলে আমাদের পায়ে ধরে থাকতে হবে। ৪ জানুয়ারি থেকেই সিঙ্গি-সহ নানুরের সমস্ত পঞ্চায়েতের দখল আমরা নিয়ে নেব।’’

একসময় গদাধর হাজরার সঙ্গে নানুর এলাকার দাপুটে যুব নেতা কাজল সেখের মধুর সম্পর্ক ছিল। সে সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একে অন্যের বিস্তর সুখ্যাতিও করেছেন। তখন বরং ওই দুই নেতার বিরোধ ছিল দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে। নানুরে কার্যত ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন অনুব্রত এবং তার অনুগামীরা। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের নানুর এবং বোলপুর এলাকায় বিরোধীরা অধিকাংশ আসনে কোনও প্রার্থী দিতে না পারলেও টিকিট বিলি নিয়ে ওই দুই গোষ্ঠীর বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। দেখা যায়, বেশ কিছু পঞ্চায়েতে যেখানে অনুব্রত অনুগামীরা তৃণমূলের টিকিট পেয়েছেন সেখানে নির্দল খাড়া করেছেন গদাধর-কাজল অনুগামীরা। বিপরীত ঘটনাও ঘটে। নির্বাচনে অবশ্য অনুব্রত অনুগামীরাই হেরে যান। নানুরের ১১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টি এবং বোলপুরের তিনটি পঞ্চায়েতে কর্তৃত্ব কায়েম করেন গদাধরবাবুরা। পরে অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভিন্নমাত্রা পায়। পঞ্চায়েতগুলিতে কাজলই একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেন। কোণঠাসা হয়ে গদাধরবাবু যোগ দেন অনুব্রত শিবিরে।

ঘটনা হল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে দলনেত্রী কড়া মনোভাবের পর অনুব্রতর সঙ্গে ফের এক টেবিলে দেখা যায় কাজল-গদাধরকে। তারপরেও বিবাদ মেটেনি। বরং কাজলকে খুনের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে গদাধর অনুগামীদের বিরুদ্ধে। পাল্টা তিন গদাধর অনুগামীকে খুনের অভিযোগ ওঠে কাজল এবং তার সঙ্গীদের বিরূদ্ধে। যে পঞ্চায়েতগুলি কাজলের দখলে রয়েছে, সেই সব এলাকায় বালির ঘাটের দখলকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের বিবাদ চরমে ওঠে। এবং উভয়পক্ষের সংঘর্ষে বারবার তেতে ওঠে নানুর এবং লাগোয়া বোলপুর এলাকা। কিছুদিন আগে, বোলপুরের বাহিরী ব্রজসুন্দরী হাইস্কুল মাঠে সভা করেন নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরা। সেখানে বক্তৃতায় তিনি বলেন, “এই এলাকায় কিছু হার্মাদ মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। মানুষের উপর অত্যাচার করছে। এই হার্মাদদের সরিয়ে দিতে আমাদের এক মিনিটও সময় লাগবে না।” কারও নাম না করলেও, বিধায়কের আক্রমণের লক্ষ্য যে নানুরের দাপুটে নেতা কাজল শেখ, তা জানিয়েছিলেন তৃণমূলেরই নীচুতলার কর্মীদের একাংশ। ওই সভায় লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলামও বলেন, “কিছু লোক বাজার থেকে পাঁচ টাকার ফ্ল্যাগ কিনে নিজেদের তৃণমূল বলছে। যে দলের জেলা সভাপতিকে মানে না, বিধায়ককে মানে না, পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতির পা ভেঙে দেয়, সে তৃণমূল হতে পারে না।”

রবিবার গদাধরের সভার পর নতুন করে গোষ্ঠী কোন্দল নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রসঙ্গত সিঙ্গি পঞ্চায়েতের নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে কাজলের হাতে। নির্বাচনের সময় ওই পঞ্চায়েতের ১৯ আসনের মধ্যে ৫টিতে তৃণমূলের প্রতীক পেয়েছিল গদাধর-কাজলের প্রার্থীরা। বাকি আসনে তৃণমূলের প্রতীক পান অনুব্রতর অনুগামীরা। তবে প্রতি আসনেই প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা হয় দু’পক্ষের নির্দল প্রার্থীর সঙ্গে। অনুব্রত অনুগামীদের অধিকাংশই পরাজিত হন। পরে জয়ীরাও গা ভাসান কাজল – গদাধরের স্রোতে।

এ দিন প্রধান সহ সিঙ্গি পঞ্চায়েতের সমস্ত সদস্য একযোগে গণ ইস্তফার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তৃণমূলের টিকিটে জেতা ওই পঞ্চায়েতের প্রধান এনামুল হক বলেন, ‘‘বিধায়ক যেভাবে প্রকাশ্যে পঞ্চায়েত দখলের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাতে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। তাই আমরা পঞ্চায়েতে বসে দলনেত্রীর কাছে গণ ইস্তফাপত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’

অন্য দিকে এ দিন কাজলের নিয়ন্ত্রণে থাকা কীর্ণাহার ২ নং পঞ্চায়েতের কাছেও বোমাবাজি হয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান সুলেখা সাহা জানান, সওয়া ১ টা নাগাদ পঞ্চায়েতের অদুরে পরপর ৪টি বোমা ফাটে। কারা কি কারণে বোমা ফাটিয়েছে তা বলতে পারব না। ঘটনার কথা পুলিশকে জানিয়েছি।

জেলার রাজনৈতিক মহলের মতে, গদাধরবাবুর বক্তব্যেরই বর্হিপ্রকাশ ওই বোমাবাজি। গদাধরবাবু অবশ্য সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, ‘‘আমার বক্তব্য বিকৃত করা হচ্ছে। আসলে আমি বলতে চেয়েছি, দলে থেকে যারা দল বিরোধী কাজ করছে তাদের বরদাস্ত করা হবে না। পঞ্চায়েত বা এলাকা দখলের কথা বলিনি।’’ রবিবার গদাধরবাবুর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘গদাধরবাবুর বক্তব্যের সময় আমি মঞ্চের পিছনের সারিতে বসে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে উন্নয়নের বিষয়ে কথা বলছিলাম। তাই তার বক্তব্য আমি শুনিনি। সেই জন্য কিছু মন্তব্য করতে পারব না।’’

কী বলছেন কাজল?

এ দিন কাজল বলেন, ‘‘বিধায়কের ওই বক্তব্যই প্রমাণ করে দেয় কারা দখলদারি চালায়। এরপর দল এবং দলনেত্রী যা ভাল বুঝবেন তাই করবেন।’’

অনুব্রত মণ্ডলের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আসলে সিঙ্গি পঞ্চায়েতটি নির্দল পরিচালিত। ওই পঞ্চায়েতের লোকজন আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছেন। তাঁদের নিয়ে ওই পঞ্চায়েতটি ভেঙে আমরা নতুন করে বোর্ড গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। বিধায়ক সেই কথাই বলেছেন। নানুরে তৃণমূলের পরিচালিত পঞ্চায়েত রয়েছে। তাই সেগুলি দখল নেওয়ার কথাই আসে না।’’

বিধানসভা নির্বাচনের আগে ৩০ বি, হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিট কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই এখন দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news anubrata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE