Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
রাত পেরোতেই মত বদল

নোটিসের জবাবে নিশানা মুকুল

গর্জনের তুলনায় বর্ষণ হল না কিছুই! বুধবার হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘সিবিআইয়ের পাঠানো সব নোটিস দিস্তা করে দিল্লি পাঠিয়ে দেব।’ তার পর রাত পোহাতে না-পোহাতেই দলের এক নেতাকে দিয়ে সিবিআইয়ের দাবি মতো তৃণমূলের আয়ব্যয়ের হিসেব পাঠিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং সেই সঙ্গে কৌশলে মুকুল রায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর।

দলের হয়ে নথি জমা দিতে সিবিআই অফিসে তৃণমূল নেতা তাপস রায়। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।

দলের হয়ে নথি জমা দিতে সিবিআই অফিসে তৃণমূল নেতা তাপস রায়। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

গর্জনের তুলনায় বর্ষণ হল না কিছুই!

বুধবার হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘সিবিআইয়ের পাঠানো সব নোটিস দিস্তা করে দিল্লি পাঠিয়ে দেব।’ তার পর রাত পোহাতে না-পোহাতেই দলের এক নেতাকে দিয়ে সিবিআইয়ের দাবি মতো তৃণমূলের আয়ব্যয়ের হিসেব পাঠিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং সেই সঙ্গে কৌশলে মুকুল রায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে তৃণমূলের কাছ থেকে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসেব, মমতার ছবি বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকার খতিয়ান চেয়ে পাঠিয়েছিল সিবিআই। গত সোমবার দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সীকে পাঠানো নোটিসে চার দিনের মধ্যে যাবতীয় নথি জমা দিতে বলে তারা। তার জবাবে এ দিন কী কী নথি জমা দেওয়া হয়েছে, তা দলের তরফে সরকারি ভাবে জানানো হয়নি। সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে নথিপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় বলেন, ‘‘সিবিআই যে নোটিস পাঠিয়েছিল, তার জবাব দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশে আমি সিবিআই দফতরে পৌঁছে দিয়ে এসেছি।’’ কী কী নথি জমা দিলেন জানতে চাই লে তাঁর জবাব, ‘‘তদন্ত চলছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত চলছে। আইনের এক জন ছাত্র হিসেবে আমার এই ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়।’’

তৃণমূলের পক্ষ থেকে কী কী নথি জমা দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে সিবিআইয়ের তরফেও এ দিন কিছু বলা হয়নি। তবে তদন্তকারী অফিসারদের একাংশের দাবি, নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হিসেবনিকেশের প্রতিলিপিই জমা দিয়েছে তারা। সেখানে বিশদে কোনও তথ্যের উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে, কয়েক দিন পর বিশদ তথ্য দেওয়া হবে। সিবিআইয়ের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘প্রাথমিক ভাবে যাচাই করে তৃণমূলের দেওয়া হিসেব ধোঁয়াশায় ভরা বলেই মনে হচ্ছে। সারদা তদন্তকারী দলে এক জন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট রয়েছেন। তিনি ওই হিসেব পরীক্ষা করে দেখছেন। হিসেব সংক্রান্ত কিছু তথ্যও দেওয়া হয়েছে। ওই সব তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

তৃণমূলের একটি সূত্রে বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দলের আয়-ব্যয়ের হিসেব, আয়ের উৎস, ওই সময়ের মধ্যে দলের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’র বিজ্ঞাপন, অনুদান এবং নেত্রীর আঁকা ছবি বিক্রির হিসেব এ দিন সিবিআই-কে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাকে এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, এই সমস্ত নথি যে আসল সে ব্যাপারে দল নিশ্চিত নয়। মুকুল রায়ের কাছেও কিছু নথি থাকতে পারে। কোনও গরমিল দেখা গেলে সিবিআই মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচাই করে নিক কোন নথি আসল।

তৃণমূলের ওই সূত্র বলছে, এ কথা বলে আসলে এটাই বুঝিয়ে দেওয়া হল যে আয়-ব্যয়ের হিসেব সংক্রান্ত যাবতীয় দায় মুকুলের। কারণ, এত দিন পর্যন্ত তিনিই একা হাতে সব কিছু সামলাতেন। দলের অন্য সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, দলের হিসেবপত্রে যে বিস্তর গোলমাল রয়েছে, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর থেকে সেটা স্পষ্ট। সেই দায় যাতে দলের ঘাড়ে না পড়ে সে জন্য এর আগেই মুকুলকে চিঠি পাঠিয়ে নথিপত্র চেয়েছিলেন সুব্রত। যার উত্তরে মুকুল জানান, নথিপত্র সব দলের দফতরেই আছে। তার পরেও দলের দেওয়া নথি আসল না-ও হতে পারে এ কথা বলার অর্থ, কৌশলে মুকুলের উপরে দোষ চাপিয়ে দেওয়া।

মুকুলকে কাঠগড়ায় তোলার প্রক্রিয়া হিসেবে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই সিবিআই-কে লেখা সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের একটি চিঠির খসড়া এ দিন নথিপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। ২০১৩ সালের এপ্রিলে কলকাতা ছেড়ে পাঠানোর আগে সিবিআই-কে ওই চিঠি লিখেছিলেন সুদীপ্ত। খসড়াটিতে মুকুল নিজের হাতে কিছু সংশোধন করেছিলেন বলে তৃণমূল সূত্রের দাবি। তাঁরা বলছেন, এই চিঠি পাঠিয়ে সারদা-কর্তার সঙ্গে মুকুলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা হল। সেই সঙ্গে ১৯৯৮-এ তৃণমূল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দলের যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মুকুল দেখতেন, তার বিস্তারিত তথ্য সিবিআই-কে দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে, আয়কর দফতর এবং নির্বাচন কমিশনে মুকুলের সই করে পাঠানো বেশ কিছু নথি এবং চিঠিপত্রও।

তবে দল তাঁকে বিপাকে ফেলতে এমন কাজ করেছে বলে মানতে নারাজ মুকুল। আপাতত দিল্লিবাসী মুকুলকে এ দিন ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এ সব বাজে কথা। গুজব।’’ মুকুলের কাছে খবর, মোট ১০৭ পাতার নথি সিবিআই-কে দেওয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগটাই ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের আয়-ব্যয়ের হিসেব। যে হিসেব চেয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থা।

তৃণমূলের কাছ থেকে মমতার ছবি বিক্রি সংক্রান্ত যাবতীয় হিসেবও চেয়েছিল সিবিআই। তৃণমূল সূত্র বলছে, মমতার ছবি বিক্রির পুরো হিসাব জমা দেওয়া হয়নি। ছবি যাঁরা কিনেছিলেন তাঁদের কয়েক জনের নাম জমা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাকি নাম প্রয়োজন হলে বা সিবিআই ফের চাইলে দেওয়া হবে। অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কিনেছিলেন, ফলে সেই নামের তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানানো হয়েছে।

সিবিআইয়ের এক কর্তা জানান, কয়েকটি অর্থলগ্নি সংস্থা কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে দলনেত্রীর আঁকা ছবি কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কুণাল ঘোষ, সুদীপ্ত সেন থেকে শুরু করে সারদার কয়েক জন হিসেবরক্ষক ওই ছবি কেনার বিষয়ে সিবিআই-কে তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু এ দিনের দেওয়া হিসেবে ছবি বিক্রি থেকে মোট কত টাকা পাওয়া গিয়েছে, সেটাই জানিয়েছে তৃণমূল। কী ভাবে ছবি বিক্রি করা হয়েছে, তার উল্লেখ করা হয়নি। ছবির ক্রেতা হিসেবে কয়েক জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া, কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে বিশদ কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি।

কিন্তু বুধবার দলীয় সভায় মমতা সিবিআইয়ের নোটিস দিল্লি পাঠানোর হুমকি দেওয়ার পরের দিনই নথিপত্র জমা দেওয়া হল কেন? তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার দাবি, ‘‘এটা তো কৌশল। রাজনীতির ময়দানে নেত্রী রাজনীতির কথা বলেছেন। কিন্তু উনি তো কোথাও বলেননি, সিবিআইয়ের নোটিসের জবাব দেবেন না! আসলে আমরা মনে করি, আইন আইনের পথে চলবে। সেই আইন মেনেই আমাদের দলনেত্রী নোটিসের জবাব দিয়েছেন।’’ অন্য এক নেতার আবার বক্তব্য, পুরভোটের মুখে সিবিআইয়ের নোটিস নিয়ে দলকে যথেষ্ট বিব্রত হতে হচ্ছে। তাই নথিপত্র পাঠিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হল। যাতে ভোটের ময়দানে বলা যায় যে, দলের লুকনোর কিছু নেই। কাগজপত্র সবই সিবিআই-কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই নেতার কথায়, ‘‘নথিপত্র খতিয়ে দেখতে সিবিআইয়ের তো কিছু দিন সময় লাগবে। তত দিনে পুরভোট পেরিয়ে যাবে। তার পর আবার অন্য লড়াই।’’ এই দুই যুক্তিই অবশ্য মানতে নারাজ তৃণমূলের বড় অংশ। তাঁদের মতে, সিবিআই তদন্তে যতই একের পর এক গরমিল প্রকাশ্যে আসছে, ততই আশঙ্কা বাড়ছে শীর্ষ নেতৃত্বের মনে। তাঁরা বুঝতে পারছেন, তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা না করে পার পাওয়া যাবে না। তাই জনসভায় যা-ই বলা হোক না কেন, বাস্তবে সিবিআইয়ের দাবি মেনেই নোটিসের জবাব পাঠানো হয়েছে।

এই একই কথা বলছে বিরোধীরাও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘এক দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী হুঙ্কার ছাড়লেন। উনি নাকি কেন্দ্রীয় সংস্থার পাঠানো দিস্তে দিস্তে নোটিস বস্তা করে দিল্লি পাঠাবেন। বারো ঘণ্টাও কাটল না, দলের নেতাদের হাত দিয়ে সিবিআই অফিসে দেড়শো পাতার নথি পাঠালেন। আসলে উনি ভয় পেয়েছেন। তাই নথি পাঠিয়ে আপাতত বিষয়টি চাপা দিতে চাইছেন।’’

একই সুরে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘আগের দিন উনি (মমতা) সিংহের গর্জন শুনিয়েছিলেন। পরের দিনই আবার বিড়াল হয়ে গেলেন! ভোটের সময় বাজার গরম রাখতে তিনি নানা
রকম হুমকি দিচ্ছেন। কিন্তু আসলে বুঝতে পারছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে তদন্ত হচ্ছে সেখানে এ দিক-ও দিক করার কোনও সুযোগ নেই।’’ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের দাবি, ‘‘তৃণমূলের সামনে আত্মরক্ষার পথ নেই তাই আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। কিন্তু মান বাঁচাতে মুখে নানা রকম হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছেন তৃণমূল নেত্রী।’’

তৃণমূলের ‘যুবরাজ’ মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ দিনও পিসির সুরেই সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ায় নির্বাচনী প্রচার সভায় তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি নির্বাচনের আগে সিবিআই, ইডি, আয়কর-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য ধাতুতে গড়া। যারা ভাবছে সিবিআই, ইডি, আয়কর দফতরের জুজু দেখিয়ে জয়ললিতা, অখিলেশ যাদব, মায়াবতীর মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কাবু করা যাবে, তা হবে না।’’ বিরোধী, বিশেষত বিজেপি নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অভিষেক বলেন, ‘‘বাপের ব্যাটা হলে, ভোটে জয়ী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কুৎসা করে দেখাবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE