কাঞ্চননগরে এখানেই হবে ল্যাংচা-তীর্থ। নিজস্ব চিত্র।
বর্ধমানের রাজার আমন্ত্রণে শহরে আসছেন লর্ড কার্জন। ১৯০৫ সাল। চারদিকে হই হই ব্যাপার। তৈরি হল বিজয় তোরণ। কিন্তু, কী মিষ্টি দিয়ে স্বাগত জানানো হবে বড়লাটকে? বিপাকে পড়ে রাজা বিজয়চন্দ ডেকে পাঠালেন প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক ভৈরবচন্দ্র নাগকে। রাজ-নির্দেশে তিনি এমন মিষ্টি বানালেন, যা খেয়ে কার্যত মজে গেলেন সস্ত্রীক কার্জন।
সীতাভোগ আর মিহিদানার চলার পথের সেই শুরু। যার স্বাদ চেখে ধন্য ধন্য করেছেন দেশ-বিদেশের মানুষ, ওইটুকুই। শতাধিক বছরের পুরনো এই ‘যমজ’ মিষ্টিকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্যাকেটজাত করে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা সে ভাবে হয়নি। একই অবস্থা আর এক বিখ্যাত মিষ্টি শক্তিগড়ের ল্যাংচারও।
বাংলার বিখ্যাত এই তিন মিষ্টিকে এ বার এক ছাদের তলায় তৈরি করে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেছে রাজ্য সরকার। সেই মতো বর্ধমানের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের সংগঠনের কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে শহরের এক প্রান্তে দামোদর লাগোয়া কাঞ্চননগরের ৯৬ শতক জায়গার উপরে ‘ল্যাংচা তীর্থ’ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি বর্ধমানের সাধনপুরে মাটি উৎসবের উদ্বোধনে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৭ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ল্যাংচা তীর্থের কথা ঘোষণা করেন। ওই দিন মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তারা কার্জন গেটের অনুকরণে তৈরি সীতাভোগ, মিহিদানা ও ল্যাংচার প্যাকেট তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। আপ্লুত মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব ছিল, “এ ভাবেই ছোট ছোট প্যাকেটে বিশ্ববাংলা বিপণিতে সীতাভোগ, মিহিদানা বা ল্যাংচা রাখা যেতে পারে।”
‘‘ওই তিন মিষ্টি ‘প্যাকেজিং’-র জন্য কলকাতার বাইরে পা রাখতে পারছে না’’— বলছেন মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্যাকেটজাত করা না গেলে ভিন রাজ্যে বা দেশে রফতানি অসম্ভব। প্রয়োজন ভৌগলিক সূচক শংসাপত্র বা ‘জিআই পেটেন্ট’ (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন)। তা পেতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতর চেষ্টা শুরু করেছে।
বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্যাকেট তৈরি করতে কেন্দ্রীয় খাদ্য ও প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্রের সাহায্য নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বর্ধমানের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক প্রদীপ ভকত। ব্যবসায়ীদের এক প্রতিনিধি দল মহীশূরের ওই কেন্দ্রে গিয়ে প্রাথমিক কাজও সেরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘‘মিহিদানা প্যাকেটজাত করতে অসুবিধা নেই। তবে সীতাভোগ ও ল্যাংচা দুগ্ধজাত বলে সমস্যা হতে পারে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বছর দশেক আগেই কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতর জানিয়েছিল বহু দেশ বাংলার মিষ্টি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত প্যাকেটজাত করতে না পারায় রফতানি করা যায়নি।’’ শক্তিগড়ের বেশ কিছু ল্যাংচা কারিগরেরও সন্দেহ, অন্যত্র তৈরি করলে ল্যাংচার ওই বিশেষ স্বাদ থাকবে কি না। কারণ জল, তৈরির ধরন, কারিগরের হাতের গুণে একই মিষ্টির স্বাদ আলাদা আলাদা হয়ে যায়, বলে তাঁদের দাবি।
ওই সমিতি সূত্রে খবর, সীতাভোগ-মিহিদানার জন্য ১৬ হাজার ২০০ বর্গফুট ও ল্যাংচার জন্য ৫২০০ বর্গফুট, মোট ২১ হাজার ৪০০ বর্গফুটের কারখানা তৈরি হবে। এ ছাড়াও ন্যূনতম ৪৮ জন কর্মীর থাকার জন্য ২৪টি ঘর তৈরির দাবি করেছে সমিতি। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ক্লাস্টার তৈরি করে ল্যাংচা তীর্থ পরিচালনা করা হবে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, রাজ্য সরকার কাঁচামাল কিনতে পরিচালন কমিটিকে ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। বাকি খরচ পরিচালন সমিতিকেই বহন করতে হবে।
রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগে খুশি ব্যবসায়ী সমিতি। প্রদীপবাবু বলেন, “এখন মূলত স্থানীয় মানুষজন দোকান থেকে মিষ্টিগুলি কেনেন। রফতানি করা গেলে বিক্রি বহু গুণ বাড়বে।’’ কাঞ্চননগরের তৃণমূলের কাউন্সিলর খোকন দাসের প্রতিক্রিয়া, “মিষ্টির দৌলতে বিশ্ববাজারে বর্ধমানের নাম যেমন হবে, তেমনি ওই হাবকে ঘিরে কর্মসংস্থানও হবে।”
ল্যাংচা তীর্থের কাজ কবে থেকে শুরু হবে? প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, কী ভাবে কী হবে সেই পরিকল্পনা নিয়ে মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আর এক দফা আলোচনা হবে। সেখানে দু’পক্ষ এক মত হলে টাকা মিলবে। তারপরেই কাজ শুরু হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy