মাটি কেঁপে উঠতেই পথে নেমে এল আতঙ্কিত সেক্টর ফাইভ। বুধবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
৩২ তলার ফ্ল্যাট থেকে কাঁপুনির স্বাদটা ঠিক কী রকম?
প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের আবাসনে বসে সেটা টের পেয়েছেন ৭৩ বছরের বৃদ্ধা রিনা বসু। ফ্ল্যাটের বারান্দার কাচের ‘স্লাইডিং ডোর’, ঘরময় দেওয়ালে সাজানো কাচের ফ্রেম-বন্দি ‘পেন্টিং’ ঝনঝনিয়ে উঠছে। তাঁর মনে হচ্ছে, আবাসনের সামনের টাওয়ারটাও যেন দুলছে।
তবু বয়স্ক হাঁটু সামলে তড়িঘড়ি নামতে অঘটনের শঙ্কাও সমানে তাড়া করছিল! তাই পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করলেও নীচে নামার ঝুঁকি নেননি বৃদ্ধা। কোনওমতে সোফার হাতল ধরে ঘরেই বসে ছিলেন। বুধবার বিকেল চারটে বেজে আট-দশ মিনিট গড়িয়েছে। গোটা শহর জুড়ে বহুতলে বহুতলে তখন শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পড়ি-কি-মরি করে নীচে নেমে আসার মিছিলে সামিল হয়েছে অজস্র অফিসবাড়িও।
রাজ্যে ক্ষমতার খাসতালুক নবান্ন-এর ১৪তলা অবধি সেই আতঙ্কের শরিক হয়েছে। ‘পাবলিক অ্যাড্রেস’ সিস্টেমের ঘোষণায় রীতিমতো ‘ত্রাহি-ত্রাহি’ ভাব। মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি-সহ উঁচুতলার আমলারা ভিআইপি লিফ্ট ধরে ঝটপট নামছেন। কয়েক মিনিটে গোটা নবান্নই প্রায় বাইরের উঠোনে। নির্ধারিত সময়ের মিনিট ৪০ আগে বিকেল ৪টে ২০ মিনিটের মধ্যেই ছুটি ঘোষণা অবধি হয়ে গেল রাজ্য প্রশাসনের ‘নীল-সাদা বাড়ি’তে। সৌজন্যে ভূমিকম্পের ঝটকা।
ভূমিকম্প মালুম হতেই জরুরি সতর্কতার ভোঁ শোনা গিয়েছে বহু কর্পোরেট অফিসেই। কয়েকটি শপিং মলও দ্রুত খালি করা হয়। সেক্টর ফাইভ থেকে ধর্মতলা-বি বা দী বাগের সাবেক অফিসপাড়া— সর্বত্র বহুতলের নীচে কর্মীদের জটলাটাই যেন ভূমিকম্পগ্রস্ত শহরের ছবি।
বিকেলের অফিস-টাইমের মুখে মেট্রো পরিষেবাও খানিক ক্ষণের জন্য ধাক্কা খেয়েছিল শহরে। যাত্রীদের নামিয়ে মেট্রো খালি করে দেওয়া হয়। তার পরে রেললাইন খুঁটিয়ে দেখে কোথাও কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, জরিপ করা হয়। এই ভাবে মিনিট কুড়ি পার হয়। তার পরেই ফের মেট্রো চলাচল জারি হয়।
শহরের একটি মাল্টিপ্লেক্সের কর্তাও তখন উদ্বিগ্ন ভাবে ফোন করে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে খোঁজ নিচ্ছিলেন। ভূমিকম্পের আতঙ্কে কোথাও কোনও ‘শো’ পণ্ড হল না তো! অন্ধকার হল থেকে ‘পাবলিক’কে বার করতে গিয়ে অঘটন ঘটেনি তো কোথাও! চাঁদনি চক পাড়ায় প্রিন্সেপ স্ট্রিটের একটি পুরনো মসজিদের গম্বুজ থেকে চাঙড় খসে পড়ার ঘটনা ঘটে। তাতে মহম্মদ আকবর আলি নামে স্থানীয় এক প্রবীণ ব্যক্তি পায়ে চোট পেয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এটুকু বাদ দিলে সতর্কতা ও আতঙ্কের আবহটুকুই যা কলকাতার বরাতে ঘনিয়েছে। এ যাত্রাও বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে শহর। তবে শহরের ‘আফটর শক’-এর মাত্রা তাতে ফিকে হচ্ছে না। প্রিয়জনেরা নিরাপদ কি না, জানতে ফোনের কি-প্যাডে ব্যস্ত ‘টাইপিং’য়ের ধুম। ৩২ তলার বাসিন্দা রিনাদেবীর কন্যা উমা মিত্রও বিকেলটা মায়ের কথা ভেবে ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলেন কিছু ক্ষণ। গোলপার্কে আর একটি বহুতলে খানিকটা ঘাবড়েছিলেন মৌসুমী ঘোষও। ওই বহুতলের এক-একটি ফ্লোর প্রায় দেড় তলার সমান। ১৬ তলা মানে প্রায় ২৫০ মিটারের কাছাকাছি। পুষ্যি ‘গোল্ডেন রিট্রিভার’-এর টানটান কান ও অস্থির ভাব দেখেই কিছু একটা ঘটতে চলেছে বলে আঁচ করেন মৌসুমীদেবী। তবে ভয় পেলেও ভরসা ছিলেন, একেলে ভূমিকম্প রোধক ক্ষমতাসম্পন্ন বাড়ি দুলবে ঠিকই, তবে পড়বে না।
বহুতলের উঁচুতলার জীবনযাপনে ক্রমশ অভ্যস্ত হওয়ার দিনকালে এক ধরনের ভয় নিয়ে বসবাস করাটা এখন জীবনের অঙ্গ বলে ধরে নিয়েছেন বহু কলকাতাবাসীই।
নিউ টাউনের একটি আবাসনের ২২ তলার বাসিন্দা দীপঙ্কর সেনগুপ্ত যেমন বলছিলেন, উঁচুতে নাগাড়ে ভূমিকম্পের ভয়ের কথা ভেবেই আমরা বাধ্য হয়ে দমদমে আর একটি দোতলা ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত করেছি। বাড়িতে বয়স্করা অনেকেই হাঁটু সামলে নীচে নামতে বেশ সমস্যায় পড়েন। অত উপর থেকে কম্পনটাও ঢের বেশি মালুম হয়।
কম্পন বেশ মালুম হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ওয়ালে’ও! ভূমিকম্প কে টের পেলেন এবং কে পেলেন না, তার খতিয়ানে যথারীতি ফেসবুক সরগরম। গত কয়েক বছরে নেপাল, সিকিম, মণিপুরের ভূমিকম্প-স্মৃতি নিয়ে তুমুল চর্চা। দ্রুত পা চালিয়ে অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে স্টেটাসের ছড়াছড়ি নিয়ে রসিকতাও বাদ পড়েনি। কেউ ঠেস দিয়ে লিখেছেন, ফেসবুকই ভূমিকম্পের ‘এপিসেন্টার’ বলে মনে হচ্ছে।
প্রকৃতির খেয়ালের জেরে আওয়াজখানা এ বার বর্মা থেকে বাংলা হানা দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy