বুথের মধ্যেই শাসক দলের পক্ষে ভোট না দিলে ‘লাইফ হেল’ করে দেওয়ার শাসানি শুনে থতমত খেয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন মহিলা।
বুথের বাইরে এসে পুলিশ কর্তাকে সে নালিশ জানাতেই উর্দিধারীর সক্রিয় হয়ে ওঠা দেখেছিলেন তিনি।
তৃণমূলের ওই কর্মীকে বুথের ভিতর থেকে কলার চেপে মারতে মারতে বের করে এনে সটান নিজের জিপে তুলে দেওয়ার আগে ওই পুলিশ কর্তাকে বলতেও শোনা গিয়েছিল, ‘‘চোখ বুজে থাকলেই চলবে, উর্দির একটা দাম নেই!’’
স্বগতোক্তি নাকি কোনও বার্তা দিয়েছেন তিনি?
উত্তর মেলেনি, তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা এলাকায় কর্তব্যরত ওই পুলিশ কর্তা যে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’-এর শিরোপা পাচ্ছেন না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত বিরোধীরা।
এক সপ্তাহ আগে, কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের পরে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ হিসেবে পুলিশকেই বেছে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রবল সন্ত্রাস, এমনকী শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা পরিচিত দুষ্কৃতীর গুলিতে এক পুলিশ কর্মীর গুরুতর জখম হওয়ার ঘটনার পরেও তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা দাবি করেছিলেন, নির্বাচন হয়েছে ‘শান্তিপূর্ণ’ ভাবে। পুলিশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ৯১টি পুরসভায় নির্বাচনের আগেও পুলিশ কতার্দের সিংহভাগই তাঁদের নিচুতলার সহকর্মীদের কাছে স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছিলেন— নির্বাচন নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে ওঠা কোনও অভিযোগই যেন ‘গুরুত্ব’ না পায়, পক্ষান্তরে বিরোধীদের অভিযোগ, ‘গুজব’ বলে আমল না দিলেও চলবে।
এ দিন অধিকাংশ এলাকায় পুলিশের কখনও ‘উদাসী’, কখনও ‘নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকা ছিল। কিন্তু চোখে পড়েছে কয়েকটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগও। মহেশতলার ঘটনাটি সেই তালিকায় অন্যতম। শনিবার ওই এলাকায় দিনভর সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে টহল দিতে দেখা গিয়েছে বেশ কয়েক জন পুলিশ কর্তাকে। তাঁদের এই ব্যতিক্রমী ‘সক্রিয়তার’ ফলে মহেশতলা এবং বজবজে তেমন বড় কোনও গণ্ডগোলও চোখে পড়েনি। বিরোধীদের একাংশ তেমনই রায় দিয়েছেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার ওই এলাকায় পুলিশের ওই সক্রিয় ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল।
বুথ-জ্যাম, বিরোধী এজেন্টকে বের করে দেওয়া, বহিরাগতদের এলাকা দাপানো বা ভোটদানে বাধার অভিযোগ পেলেই ওই পুলিশ কর্তাদের নেতৃত্বে ছুটে গিয়েছে সাঁজোয়া বাহিনী। কখনও ধমকধামক দিয়ে কখনও বা রীতিমতো লাঠি চালিয়ে বড় গণ্ডগোল বাধার আগেই তা মিটিয়েও দিয়েছেন তাঁরা।
নির্বাচনের দিন কয়েক আগে থেকে গণ্ডগোলের আবহ ছিল উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটিতেও। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশদের বুথ ঘুরে আগাম বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘বিরোধী দলের এজেন্ট বের করে দিলে কিন্তু ভাল হবে না।’’ শাসক দলের কর্মীরা অবশ্য সে হুঁশিয়ারিতে প্রাথমিক ভাবে আমল দেননি। উল্টে পুলিশকে হুমকি দিয়েছিলেন। যা শুনে গুটিয়ে যাওয়ার বদলে রীতিমতো লাঠিপেটা করে তৃণমূল কর্মীদের বুথের সামনে থেকে হটিয়ে দেওয়ার পরে এক পুলিশ কর্তাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘গুন্ডামি করবে আর পুলিশ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বসে থাকবে, এমন চাকরি তো করতে আসিনি।’’
কাটোয়ায় দিনভর মাস্কেট বাহিনীর দাপট আর গুলির লড়াই দেখেও পুলিশের দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়েনি। অথচ ছবিটা ঠিক উল্টো চন্দননগরে। বিরোধীদের অভিযোগ, এ দিন বিকেলে শূন্যে গুলি চালিয়ে সেখানে একটি বুথ দখলের চেষ্টা করেছিল শাসক দলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা। একটুও দেরি না করে বেধড়ক লাঠি চালিয়ে সমাজবিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। লাঠির ঘা পড়ে তৃণমূল প্রার্থীর পিঠেও। অশান্তির আশঙ্কা ছিল খড়্গপুরেও। কিন্তু আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে দিনভর টহল দিয়ে কোনও গণ্ডগোলই পাকতে দেননি।’
মুর্শিদাবাদে পুলিশের সদর্থক ভুমিকা প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘পুলিশ জানত এখানে শাসকের পক্ষ নিয়ে লাভ নেই। তাই নিজের কাজ করেছে।’’ যা শুনে এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘আমাদের চাকরিটা শাঁখের করাতের মতো। সক্রিয় হলেও দোষ, না হলেও আরও দোষ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy