দলিত সাহিত্য নিয়ে অন্য রাজ্যে যত সংকলন, অনুবাদ, গবেষণার কাজ হয়েছে, তার তুলনায় এ রাজ্যে কমই হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গে এ কাজটি নিয়মিত ভাবে করছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, দ্বিতীয় দফার কাজের জন্য ৯৫ লক্ষ টাকা অনুদান দিচ্ছে ইউজিসি। দলিতদের যে সব শিল্প-সাহিত্য রচনা এখনও অলিখিত, অগ্রন্থিত, যা লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে রয়ে গিয়েছে, তার লিখিত নথি তৈরি করা, অনুবাদ, এবং প্রচার এই প্রকল্পের কাজ।
কিন্তু ‘দলিত সাহিত্য’ বলতে ঠিক কী বোঝায়— তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। কারও মতে, দলিত জনগোষ্ঠীর সদস্যদের রচনাকেই বলে ‘দলিত সাহিত্য’। দলিত চেতনা সেই লেখার মধ্যে পরিস্ফুট হতে হবে। কারও বক্তব্য, দলিতদের জীবনধারা বর্ণিত হতে পারে একজন অ-দলিতের কলমেও। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে দু’ধরনের সাহিত্যই গুরুত্ব পাচ্ছে, জানালেন অধ্যাপকরা।
বঞ্চনা, দারিদ্রের ইতিহাস দলিত লেখক-শিল্পীদের শিল্প-সাহিত্য চর্চাতেও উঠে এসেছে। এতে যেমন নামী দলিত সাহিত্যিক আছেন, তেমনই আছেন বহু অনামীও। তাঁদের লেখার নান্দনিক গুণ কম নয়, তবে ভাষা আঞ্চলিক হওয়ায় পাঠকদের একটা বড় অংশের কাছে তা অজানা থেকে যাচ্ছিল। এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক ইন্দ্রনীল আচার্য বলেন, ‘‘প্রায়ই দেখা যায, যাঁরা মূলস্রোতের অদলিত লেখক, তাঁদের দলিত-সম্পর্কিত সাহিত্য বড় প্রকাশকরা বার করছেন। অভিজ্ঞ, প্রতিষ্ঠিত অনুবাদকরা তার অনুবাদ করায় দেশে বিদেশে পরিচিতি পাচ্ছেন। কিন্তু দলিত লেখকদের বই প্রকাশ করতে বড় প্রকাশকদের অনীহা বেশি দেখা যায়। অনুবাদ হয় যৎসামান্য, তা-ও অধিকাংশ এ রাজ্যের বাংলা প্রকাশকরা। পরিচিতিও হয় না।’’
ধারাবাহিক ভাবে দলিত সাহিত্যের অনুসন্ধান, সংকলন, অনুবাদ, ও গবেষণামূলক কাজের প্রয়োজনটা অনেক দিন ধরেই অনুভূত হচ্ছিল। ২০০৮-০৯ সালে এই কাজটি শুরু করে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ। রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা দলিত সাহিত্যগুলিকে সংগ্রহ করে বইয়ের আকারে প্রকাশ করতে প্রকল্প নেওয়া হয়। ইউজিসি ৩৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। গবেষণায় সাহায্যের জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগেরও অনুমোদন মেলে। তারপর ৫ বছর ধরে রাজ্যের নানা এলাকায় চলে গবেষণার কাজ।
গোড়ায় প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন অধ্যাপক শঙ্করপ্রসাদ সিংহ। শঙ্করবাবু জানান, এ কাজে সাহায্য করেছেন মহাশ্বেতা দেবী, নলিনী বেরা, রামদয়াল মুন্ডা, সম্প্রতি প্রয়াত অনিল ঘড়াইয়ের মতো ব্যক্তিরা। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অচিন্ত্য বিশ্বাস, বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার পক্ষে মনোহরমৌলি বিশ্বাস প্রমুখ মানুষ নানা ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
গবেষণার কাজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি আলোচনাসভা হয়। প্রথম পর্যায়ে দু’টি বই প্রকাশ হয়। একটি ‘সার্ভাইভাল অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। এতে ১৮টি বাংলা দলিত গল্পের অনুবাদ রয়েছে। দলিত সাহিত্য নিয়ে গবেষকদের প্রবন্ধের সংকলন ‘টুওয়ার্ডস সোশ্যাল চেঞ্জ, এসেজ অন দলিত রাইটিংস’ বই প্রকাশ হয় গত বছর।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ। দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য গবেষক বরাদ্দ হয়েছে দু’জন। প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর, এবং বর্তমান বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই সাহিত্যের গল্পের পর, এ বার কবিতার অনুবাদ করছেন তাঁরা। দলিত সাহিত্যের সামাজিক, নান্দনিক মূল্য নিয়ে প্রবন্ধ সংকলনও হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy