Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

যুদ্ধে জয়ী, তবু অনিশ্চিত ওঁদের ভবিষ্যৎ

কোথাও শারীরিক অসুস্থতা, কোথাও বা আর্থিক প্রতিবন্ধকতা! উচ্চমাধ্যমিকের বন্ধুর রাস্তা সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে এসে আর দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না ওঁরা। যেমন, মানসী বাউড়ি বা পূজা মণ্ডল। দু’জনেই কলা বিভাগের ছাত্রী। দুবরাজপুর গার্লসের ছাত্রী মানসী পেয়েছেন ৪৫৭ নম্বর। আর ৪৪০ পেয়েছেন খয়রাশোলের বাবুইজোড় ধরণীধর হাইস্কুলের ছাত্রী পূজা। কিন্তু তাঁরা আর এগোতে পারবেন কি না, তা নিয়ে এখন চিন্তিত ওঁরা দু’জনেই। এত ভাল ফলের পরেও উচ্চশিক্ষার পথে দু’জনেরই প্রধান বাধা— পরিবারের অর্থনৈতিক হাল। তফশিলি জাতির মেয়ে মানসীর বাবা নদের চাঁদ বাউড়ির সামান্য এক ফসলি জমি। সেখানে চাষ করে সারা বছরের চালটুকুও জোটে না। মা সন্ধ্যাদেবী অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকা। আয় মাসে ২৮৫০ টাকা। তা দিয়ে হাঁড়ি চড়াবেন, নাকি মেয়ের পড়ার পিছনে খরচ করবেন, ভেবে কূল পান না মা।

মানসী বাওড়ি, বুধাদিত্য বক্সী ও পূজা মণ্ডল

মানসী বাওড়ি, বুধাদিত্য বক্সী ও পূজা মণ্ডল

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০৩:১৭
Share: Save:

কোথাও শারীরিক অসুস্থতা, কোথাও বা আর্থিক প্রতিবন্ধকতা! উচ্চমাধ্যমিকের বন্ধুর রাস্তা সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে এসে আর দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না ওঁরা।

যেমন, মানসী বাউড়ি বা পূজা মণ্ডল। দু’জনেই কলা বিভাগের ছাত্রী। দুবরাজপুর গার্লসের ছাত্রী মানসী পেয়েছেন ৪৫৭ নম্বর। আর ৪৪০ পেয়েছেন খয়রাশোলের বাবুইজোড় ধরণীধর হাইস্কুলের ছাত্রী পূজা। কিন্তু তাঁরা আর এগোতে পারবেন কি না, তা নিয়ে এখন চিন্তিত ওঁরা দু’জনেই।

এত ভাল ফলের পরেও উচ্চশিক্ষার পথে দু’জনেরই প্রধান বাধা— পরিবারের অর্থনৈতিক হাল। তফশিলি জাতির মেয়ে মানসীর বাবা নদের চাঁদ বাউড়ির সামান্য এক ফসলি জমি। সেখানে চাষ করে সারা বছরের চালটুকুও জোটে না। মা সন্ধ্যাদেবী অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকা। আয় মাসে ২৮৫০ টাকা। তা দিয়ে হাঁড়ি চড়াবেন, নাকি মেয়ের পড়ার পিছনে খরচ করবেন, ভেবে কূল পান না মা।

শুক্রবার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরে সন্ধ্যাদেবী কাঁদছিলেন, ‘‘মাধ্যমিকে ভাল ফল করার পরে দিদির কাছে থেকে মেয়ে পড়াশোনা করেছে। এক জন অবসরপ্রাপ্ত দিদিমণির টাকায় টিউশন পড়েছে। এ বার কী হবে, বুঝে উঠতে পারছি না।’’

পূজার সমস্যাটাও একই ধরনের। বিড়ি বানানোর তামাক দুবরাজপুর থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে গ্রামে বিক্রি করে সংসার চালান পূজার বাবা বিশ্বনাথ মণ্ডল। তিনি বলছেন, ‘‘সংসার চালাতেই নাভিশ্বাস। মেয়েটা এত ভাল ফল করল। কিন্তু কী ভাবে ওকে আরও পড়াব, জানি না।’’

মানসী তবুও বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের কলেজে ভর্তি হতে পারবেন। পূজার ক্ষেত্রে সেটাও সম্ভব নয়। বাড়ি থেকে খয়রাশোল কলেজ প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। দু’জনেই বলছেন, ‘‘স্বপ্ন ছিল বিশ্বভারতীতে ভর্তি হওয়ার। এখন কী যে হবে, কে জানে!’’ মেয়েদের বাইরের কলেজে পড়িয়ে, বইপত্র কিনে, কী করে খরচ চালানো যাবে, জানা নেই দু’টি পরিবারেরই।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতার হরিণরাঙা হাইস্কুলের মৌসুমী মণ্ডলের সমস্যাটা আবার শারীরিক এবং আর্থিক, দুটোই। আড়াই বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়েছিল মৌসুমীর। মা রিতাদেবী জানালেন, মেয়ের চিকিৎসার জন্য মাসের মোট আয়ের অর্ধেকটা বেরিয়ে যেত। এক দিকে শারীরিক অসুস্থতা, অন্য দিকে অভাবের সংসার। তার মধ্যে পড়াশোনা তো দূরের কথা, খাওয়া দাওয়া কী করে হবে, তা নিয়েই চিন্তায় ছিল পরিবারটি।

কিন্তু হার মানেননি মৌসুমী। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময়ে ফের শরীর খারাপ হয়। মার্চ মাসে সংস্কৃত পরীক্ষার আগের দিন হঠাৎই পেটে ব্যথা শুরু হয়। কোনও রকমে ওযুধ খেয়ে পরীক্ষা দেন তিনি। তিনটে পরীক্ষা পারও করেন। তার পর ধরা পড়ে, গলব্লাডারে স্টোন হয়েছে। অপারেশনও করাতে হয়। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে মৌসুমী পেয়েছেন ৮৯ শতাংশ নম্বর।

কিন্তু এ বার কী হবে?

মৌসুমীর মা বললেন, ‘‘ওর বাবা কারখানায় কাজ করেন। মাসে চার হাজার টাকা বেতন। পড়াশোনা চালিয়ে, ওষুধ কিনে, কী ভাবে সব চলবে, বুঝতে পারছি না।’’

কাকদ্বীপের বিশালাক্ষীপুর গ্রামের শুভঙ্কর মান্না অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত। মাসে দু’বার রক্ত দিতে হয় তাঁকে। তার ওপর পরীক্ষার ১৫ দিন আগে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হওয়ায় হিমোগ্লোবিন আরও কমে গিয়েছিল। পদার্থবিদ্যার পরীক্ষার আগে ভয়ঙ্কর পেটের ব্যথা হয়। তাই নিয়েই পরীক্ষায় বসেছিলেন কাকদ্বীপ বীরেন্দ্র বিদ্যানিকেতনের ছাত্র শুভঙ্কর। ৮৩% নম্বর পেয়েছেন। পদার্থবিদ্যা ছাড়া সব বিষয়েই লেটার। তাঁর ইচ্ছে, কলকাতায় এসে বায়োসায়েন্স পড়বেন। কিন্তু এত সমস্যার মধ্যে তা কি সম্ভব? জবাব নেই শুভঙ্করের কাছেও।

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন পুরুলিয়া বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের বুধাদিত্য বক্সীও। বুধাদিত্য দৃষ্টিহীন। উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছেন ৭৫ শতাংশ নম্বর। বুধাদিত্য জানালেন, স্কুল ও প্রাইভেট টিউশনের শিক্ষকদের সমস্ত কথা তিনি রেকর্ড করে রাখতেন। পরে তা শুনে শুনে মুখস্ত করতেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এ বার সামনের দিকে এগোতে চান পুরুলিয়ার ছেলেটি।

নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে জয় হাসিল করার পরে এখন আর হাল ছাড়তে নারাজ শ্রেয়সী দাস ও কল্যাণী চক্রবর্তী। বাবা-মা কোথায় জানেন না শ্রেয়সী। আর বাবা-মা থেকেও নেই কল্যাণীর। ছোটবেলায় বিয়ে ঠিক করেছিল পরিবার। অনেক লড়াই করে সেখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় রংধামালি গ্রামের ওই মেয়ে। আপাতত দু’জনেই জলপাইগুড়ি ক্লাব রোডের অনুভব হোমের বাসিন্দা। দু’জনেই এ বার কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। সোনালি বালিকা বিদ্যালয় থেকে শ্রেয়সী ৬৪ শতাংশ নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। পাচিরাম নাহাটা হাইস্কুলের ছাত্রী কল্যাণী পেয়েছেন ৭২ শতাংশ নম্বর।

ফেলে আসা দিন নিয়ে মুখ খুলতে চান না কল্যাণী। শুধু বললেন, “এমন কিছু করতে হবে, যাতে মর্যাদা নিয়ে মানুষের মতো বাঁচতে পারি। হোমের দিদিরা যে স্বপ্ন মনে গেঁথে দিয়েছেন, সেটা সফল করার জন্য লড়াই করছি। আরও অনেক দূর যেতে হবে।” অভিযান যে শেষ হয়নি, জানেন শ্রেয়সীও। শিলিগুড়ি থেকে চার বছর আগে হোমে এসেছিলেন। তাঁর কথায়, “লেখাপড়ার মধ্যে থাকব। যাতে স্বাবলম্বী হতে পারি, এমন কিছু করতেই হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE