Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

খাওয়া ভুলে রোগী দেখছেন মনিরুল

অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া দু’টো ঘরের ছোট্ট চেম্বার। সামনে এক ফালি বারান্দা। শনিবার মনিরুলের সেই চেম্বারে গিয়ে দেখে গেল, বাইরে কাতারে কাতারে লোকের ভিড়।

চিকিৎসারত মনিরুল। ছবি: শান্তনু হালদার।

চিকিৎসারত মনিরুল। ছবি: শান্তনু হালদার।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:৫৪
Share: Save:

নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, রাতের ঘুম উড়েছে— বলতে বলতে উদ্‌ভ্রান্তের মতো কেঁদে ফেললেন বছর চল্লিশের মনিরুল ইসলাম। বললেন, ‘‘আমি একা হাতে আর পেরে উঠছি না।’’

গত আড়াই মাস ধরে যিনি একাই সামাল দিচ্ছেন প্রত্যন্ত এলাকার জ্বরে আক্রান্ত হাজার হাজার রোগীকে।

জায়গাটা হাবরার মারাকপুর। আশেপাশে গোটা চারেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সব ক’টি বন্ধ। সব থেকে কাছে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটি দেগঙ্গায়। দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। বহু মানুষ সেখানে গিয়েছিলেন জ্বর নিয়ে। কেউ আরও দূরের বারাসত জেলা হাসপাতাল বা হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও গিয়েছেন। অভিযোগ, কোথাও দু’চার দিন চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফিরে ধুম জ্বরে গা পুড়ছে। কারও অভিযোগ, শুধুমাত্র কিছু ওষুধপত্র দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন বড় হাসপাতালের ডাক্তারবাবু। ফের জ্বর আসায় এখন তাঁদের ভরসা ‘মনিরুল ডাক্তার’ই।

অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া দু’টো ঘরের ছোট্ট চেম্বার। সামনে এক ফালি বারান্দা। শনিবার মনিরুলের সেই চেম্বারে গিয়ে দেখে গেল, বাইরে কাতারে কাতারে লোকের ভিড়। ছোট্ট ঘরে কয়েকজনকে শুইয়ে রাখা হয়েছে স্যালাইন দিয়ে। বারান্দায় শুয়ে-বসে অনেকে। স্যালাইনের চ্যানেল করা তাঁদের হাতেও। রাস্তার উল্টো দিকে ডাক্তারবাবুর বাড়ি। সেই ঘরদোরও উপচে পড়ছে রোগীর ভিড়ে।

‘ফিজ’ নিচ্ছেন না ডাক্তারবাবু। শুধু ওষুধপত্র, স্যালাইনের দামটুকু চাইছেন। বললেন, ‘‘কী করে মানুষগুলোর থেকে টাকা নিই বলুন তো? এক পরিবারের কয়েকজন হয় তো অসুস্থ। রোজগারপাতি বন্ধ।’’

মনিরুল জানালেন, বারাসত ও দেগঙ্গার দু’টি প্যাথলজি সেন্টারের লোক সর্বক্ষণ বসে থাকছে তাঁর চেম্বারে। রক্তের নমুনা সংগ্রহ করছে। রিপোর্টও দিয়ে যাচ্ছে। মনিরুল জানান, কত জনের রক্তে যে ডেঙ্গির জীবাণু মিলেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা, হাবরা, গাইঘাটা, স্বরূপনগর— উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায় জ্বরের প্রকোপ দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মারা গিয়েছেন ৫৫-৬০ জন। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর, প্রশাসন।

এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার মনিরুলের চেম্বারে যান বাউগাছির বিএমওএইচ সজল বিশ্বাস। মনিরুলকে জানান, চিকিৎসা বন্ধ করুন। এ ভাবে ওষুধপত্র, স্যালাইন দিতে পারেন না আপনি। সে কথা শুনে মনিরুল বলেছেন, ‘‘আমিও তো তাই চাইছি। আপনারাই দায়িত্ব নিন। না হলে লোকগুলো বিনা চিকিৎসায় মরে যাবে।’’ কথা কানে যেতে রে রে করে ওঠেন রোগী ও তাঁদের আত্মীয়েরা। আব্দুল করিম নামে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘‘আমি হাতজোড় করছি। উনি দায়িত্ব না নিলে আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’’ বিএমওএইচকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ হয়। শুরু হয় পথ অবরোধ।

উত্তর ২৪ পরগনার সিএমওএইচ রাঘবেশ মজুমদার জানিয়েছেন, সকলে সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই আসুন। যা শুনে মারাকপুর বলছে, ‘‘এ সব কথার কথা। আমাদের প্রাণের দায় ওঁরা কেউ নেবেন না।’’ স্থানীয় শিক্ষক মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘‘মনিরুল ডাক্তার না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হত।’’ লিভার ফাউন্ডেশনের সচিব অভিজিৎ চৌধুরীও বলেন, ‘‘চিকিৎসা শাস্ত্রে স্যালাইন দেওয়ার অধিকার একমাত্র চিকিৎসক ছাড়া নার্স বা অন্য কারও নেই। কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ওই ব্যক্তি এই কাজ করছেন। ওঁকে সাধুবাদ জানাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

treatment doctor মনিরুল ইসলাম
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE