Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কেরলকে ধাক্কা দিয়ে বঙ্গ-বন্ধু ভিএস

আলিমুদ্দিনের পাশে এ বার অচ্যুতানন্দন! সিপিএমের কেরল শিবিরকে জোর ধাক্কা দিয়ে শনিবার প্রবীণ নেতা ভি এস অচ্যুতানন্দন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সমঝোতার পক্ষে মুখ খুললেন। কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধী দলনেতার মতে, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নেতৃত্ব মানুষের মনোবাঞ্ছার কথাই বলছেন।’’

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৬
Share: Save:

আলিমুদ্দিনের পাশে এ বার অচ্যুতানন্দন!

সিপিএমের কেরল শিবিরকে জোর ধাক্কা দিয়ে শনিবার প্রবীণ নেতা ভি এস অচ্যুতানন্দন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সমঝোতার পক্ষে মুখ খুললেন। কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধী দলনেতার মতে, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নেতৃত্ব মানুষের মনোবাঞ্ছার কথাই বলছেন।’’ জোটের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে তাঁর যুক্তি, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিটলার-মুসোলিনির থেকেও বেশি ফাসিস্ত!’’

আগামী সপ্তাহে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের আগে অচ্যুতানন্দনের এই সমর্থন অবশ্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্ত মিশ্রদের জন্য বড় প্রাপ্তি! কেরলের পিনারাই বিজয়ন, কোডিয়ারি বালকৃষ্ণনের মতো যে সব নেতা পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোটের ঘোর বিরোধী, ভি এস তাঁদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। প্রকাশ কারাটের অনুগামী কেরলের নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলে কেরলে তাঁদের অসুবিধায় পড়তে হবে। কারণ, কেরলে তাঁরা কংগ্রেস সরকারকে হঠিয়েই ক্ষমতায় আসতে চাইছেন। কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি ও আর্থিক নীতিই সেখানে তাঁদের বড় হাতিয়ার। এখন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলে কেরলে তাঁদের কংগ্রেস-বিরোধী আক্রমণ ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। ভি এস শনিবার মুখ খুলে কার্যত সেই যুক্তি ফুটো করে দিয়েছেন! তাঁর বক্তব্য, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিষয়ে এক এক রাজ্যে এক এক ধরনের মতামত থাকতেই পারে।’’ অর্থাৎ কেরলের বাধ্যবাধকতা বাংলায় সিপিএমের পথে বাধা হওয়া উচিত নয় বলে মনে করছেন দলের এই প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য।

নবতিপর ভি এস এখন পলিটব্যুরোয় নেই। কেন্দ্রীয় কমিটিতেও তিনি আমন্ত্রিত সদস্য। অর্থাৎ তাঁর ভোটাধিকার নেই। কিন্তু নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব চাইলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁকে মুখ খোলার সুযোগ দিতেই পারেন। কেরলে সিপিএমের গোষ্ঠী-রাজনীতিতে কোণঠাসা হলেও সে রাজ্যে জনপ্রিয়তায় ভি এস বিজয়নদের চেয়ে বহু যোজন এগিয়ে! দিল্লিতে তিন দিন পরে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিজয়নেরা যখন জোট-প্রশ্নের কড়া বিরোধিতা করবেন, সেই সময়ে ভি এস-কে বলার সুযোগ দেওয়া হলে তিনি যে চাঞ্চল্য তৈরি করতে পারেন, তার ইঙ্গিত মিলেছে এ দিনই। কারাট তাঁর প্রতি যতটা অপ্রসন্ন ছিলেন, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আবার ততটাই শ্রদ্ধাশীল! এই সমীকরণেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভি এস-কে ব্যাটিং করতে দেখা যেতে পারে বলে দলের একাংশের ধারণা।

বস্তুত, বঙ্গ সিপিএমের পাশে দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে ফেলেছেন ৯২ বছরের এই নেতা। প্রতিক্রিয়া এসেছে তৃণমূলের তরফে, প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাঁর নিজের দলেও। তৃণমূলের মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন পাল্টা আক্রমণ করে বলেছেন, ‘‘যে সিপিএম আমাদের ৫৫ হাজার কর্মীকে খুন করেছে এবং গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে, তারা গোয়েবল্স, মুসোলিনি বা অন্য একনায়কদের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হবে! যে মহিলাকে বাংলা এবং গোটা দেশ ভালবাসে, তাঁর সম্পর্কেও এমন মন্তব্য! সিপিএম এতটাই নির্লজ্জ!’’

আবার প্রত্যাশিত ভাবেই ভি এসের মতের উল্টো বিন্দুতে দাঁড়িয়ে কেরলে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বিজয়ন এ দিন কোল্লমে দাবি করেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য কমিটি কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের পক্ষে সায় দিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমই বিভ্রান্তি তৈরি করছে! এ সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পার্টি কংগ্রেসই সর্বোচ্চ। সেখানে এ বিষয়ে স্পষ্ট ভাষায় সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন কংগ্রেসের বিরোধিতায় যে লাইন নিয়ে আমরা চলছি, তাতে কোনও বদল হতে পারে না।’’ একই ভাবে কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বালকৃষ্ণন কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের প্রশ্ন শুনে উত্তর দিয়েছেন, ‘‘সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। ওই দলের সঙ্গে জোট করার ভাবনাচিন্তা এখন আমাদের আলোচ্যসূচিতে নেই!’’ তবে কেন্দ্রীয় কমিটি যে নির্বাচনী রণকৌশলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, তা-ও জানিয়েছেন তিনি।

আর এ সবের মধ্যে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী জোটের পক্ষে ভি এসের বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এবং এ রাজ্য থেকে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘অচ্যুতানন্দন মানুষের কথা বুঝতে পারেন।’’ যার নিট ফল দাঁড়াচ্ছে— কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আগেই বু়ড়ো হাড়ে খেলা জমিয়ে দিয়েছেন ভি এস!

কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনায় বসার আগে পরিস্থিতি টানটান বুঝেই আরও সক্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছেন ইয়েচুরি। আলিমুদ্দিনে বসে শুক্রবার বাংলার নেতাদের জোট-সওয়াল শুনেছেন। সকালে উঠেই চলে গিয়েছেন দিল্লি। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রাহুল গাঁধীর পাশে। যা থেকে ইয়েচুরির বার্তা পড়ে নিতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না! আবার জেএনইউ সেরেই সন্ধ্যার বিমানে তিরুঅনন্তপুরম। বিজয়নের নেতৃত্বে যে ‘নব্য কেরল যাত্রা’ চলছে, তার সমাপ্তি হবে আজ, রবিবার। সেখানে ইয়েচুরি থাকবেন। এবং সে অবসরেই কেরলের কিছু সমর্থন বাংলার দিকে টানার শেষ চেষ্টা চলবে।

বিজয়ন অবশ্য এখনও বুঝিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা বিনা যুদ্ধে এক চুল জমিও ছাড়বেন না! কংগ্রেসের উম্মেন চান্ডি সরকারকে সরিয়ে সিপিএম ক্ষমতায় এলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার স্বপ্ন দেখছেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে সেই রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ান, তা তিনি একেবারেই চান না! তাঁর স্পষ্ট যুক্তি, ‘‘আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে সমাজের বিপদ হিসেবে দেখি। তা-ই বলে আমরা জনবিরোধী উদার অর্থনীতির প্রবক্তাদের সঙ্গে হাত মেলানোর পক্ষে নই!’’ বাংলায় কারাটদের সামনে রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবু বলছেন তৃণমূলের মোকাবিলায় বৃহত্তর ঐক্যের চাহিদার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। এর সম্পূর্ণ উল্টো সুর তাঁর কেরল কমরেডদের গলায়! সূর্যবাবুদের সামনে এখন পরীক্ষা হল, কেরলের এই বাধা এড়িয়ে দলের শীর্ষ কমিটিতে জোটের পক্ষে সওয়াল করে সিলমোহর আদায় করে নেওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE