পরের যাত্রাভঙ্গ হচ্ছে না। তবু নিজের নাক কাটতে পিছপা নয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার!
নরেন্দ্র মোদীর প্রচার হবে, এই আশঙ্কায় জার্মানির হ্যানোভারে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য মেলা ‘হ্যানোভার মেসে’ যোগ দিচ্ছে না রাজ্য। যে মেলায় যোগ দিলে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে আন্তর্জাতিক শিল্পমহলের সামনে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরার সুযোগ মিলত। কিন্তু অন্যান্য বহু বারের মতো এ বারও শিল্পের তুলনায় রাজনীতিকেই গুরুত্ব দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
তবে দোষ অবশ্য একা পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া যাবে না। রাজনীতির অঙ্কে হ্যানোভার-যাত্রা এড়াচ্ছে কংগ্রেসশাসিত সব রাজ্যই। যাচ্ছে না পড়শি ওড়িশাও। ১২ এপ্রিল থেকে শুরু হতে চলা ওই বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে সব রাজ্যকেই চিঠি পাঠিয়েছিল মোদী সরকার। সাড়া মিলেছে সাতটি রাজ্যের কাছ থেকে— পঞ্জাব, বিহার, গুজরাত, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও উত্তরপ্রদেশ। যাদের অধিকাংশই হয় এনডিএ-শাসিত, না হয় তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলে। ব্যতিক্রম বলতে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ।
সরকারি ভাবে অবশ্য কোনও রাজ্যই মোদীর প্রচারে শরিক হতে না-চাওয়ার কথা বলছে না। পশ্চিমবঙ্গের তরফে যেমন বলা হয়েছে, অন্য বার হ্যানোভারের বাণিজ্য মেলায় যোগ দেওয়ার আংশিক খরচ (মূলত স্টল ভাড়া নেওয়ার খরচ) কেন্দ্র দিত। কিন্তু এ বছর কেন্দ্র আর সেই টাকা দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। পুরো খরচই বহন করতে হবে রাজ্যকে। সেটা করা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সম্ভব নয়।
রাজ্য সরকারের হিসেব অনুযায়ী, হ্যানোভারের মেলায় যোগ দিতে খরচ পড়ত প্রায় ১ কোটি টাকা। যে রাজ্যে মেলা, উৎসব, পুরস্কার, দান-খয়রাতিতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বেরিয়ে যায়, সেখানে লগ্নি টানার জন্য এই সামান্য টাকা খরচ করতে না-চাওয়াটা শিল্পের প্রতি সরকারের মনোভাবেরই প্রতিফলন বলে শিল্পমহলের বড় অংশের মত। লগ্নি টানার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অনীহা অবশ্য নতুন কিছু নয়। বাম আমলের শেষ দিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিছুটা উদ্যোগী হলেও রাজনীতির চক্রে অচিরেই তা হারিয়ে যায়। ন্যানো কারখানার বিরোধিতা করে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের আমলে পরিস্থিতি তো পাল্টায়নিই, বরং আরও খারাপ হয়েছে। জমি নিয়ে অনড় মনোভাব শুরু করে গানবাজনা, তেলেভাজাকেও শিল্প তালিকাভুক্ত করে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ভুল বার্তা দিয়েছে সর্বত্র।
শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মতে অবশ্য টাকাটা কোনও কারণই নয়। তাঁদের বক্তব্য, হ্যানোভারে আসলে যেটা হবে, তা হল নরেন্দ্র মোদীর প্রচার। ভারত এ বার হ্যানোভার মেলার অংশীদার দেশ। ইতিমধ্যেই হ্যানোভারের বাসে, রাস্তায়, মেলার বিজ্ঞাপনে জ্বলজ্বল করছে মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচার কর্মসূচির লোগো সিংহ! ইতিমধ্যেই ওই মেলার সরকারি ওয়েবসাইটে নরেন্দ্র মোদীর প্রস্তাবিত ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত লেখাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে মেলায় উপস্থিত থাকবেন ১২ ও ১৩ এপ্রিল। এই মোদী-যজ্ঞে সামিল হতে আগ্রহী নন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক তৃণমূল নেতার কথা, ‘‘খরচ করে রাজ্য যাবে, কিন্তু প্রচারের সব ক্ষীরটাই তো খেয়ে নেবেন নরেন্দ্র মোদী!’’ মোটামুটি ভাবে একই যুক্তি বিজেপি-বিরোধী রাজ্যগুলির।
রাজনীতির অঙ্ক কষে লগ্নি টানার এমন সুযোগ হাতছাড়া করাটা কোনও বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলেই অবশ্য মনে করছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের এক অফিসার বলেন, ‘‘যে হেতু ভারত এ বার অংশীদার দেশ, তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কর্তাদের সামনে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ অন্য বারের তুলনায় অনেক বেশি পাওয়া যাবে।’’ রাজ্যের তরফে সরকারি ভাবে যে কারণ দেখানো হয়েছে, তা খণ্ডন করে কেন্দ্রের কর্তারা বলছেন, মাত্র ১ কোটি টাকা খরচের জন্য এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করাটা অর্থহীন। বিদেশে লগ্নি টানার জন্য প্রচারে এমন টাকা তো হামেশাই খরচ হয়। এমনকী, দেশেও বিভিন্ন রাজ্য যখন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন করে, তখনও খরচের অঙ্ক এর কাছাকাছিই পৌঁছয়।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদেরও মতে, রাজ্যের জন্য বড় মাপের লগ্নি টানতে পারলে কংগ্রেস বা তৃণমূল তো সেটা নিজেদের রাজনৈতিক প্রচারেই কাজে লাগাতে পারে। সেই কাজে হ্যানোভারের মতো মঞ্চ কমই রয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সামরিক সরকারের সঙ্গে সহযোগিতায় একটি অক্ষত ফ্যাক্টরি বিল্ডিং-এ শুরু হয়েছিল হ্যানোভার মেলা। এখন সেখানে ফি বছর উপস্থিত থাকেন নানা দেশের প্রায় ২ লক্ষ বাণিজ্যকর্তা। আসেন বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরাও। এ বার প্রায় ৩০০টি ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা উপস্থিত থাকছে মেলায়। কেন ভারতকে অংশীদার দেশ নির্বাচিত করা হল তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মেলা বোর্ডের অন্যতম সদস্য দোচেন ককলার বলেন, ‘‘বিশ্বের অন্যতম বড় আর্থিক শক্তি হিসেবে উঠে আসছে ভারত। সেখানে শিল্প ও ব্যবসা করার সুযোগসুবিধার কথা জার্মানি ও অন্যান্য দেশের সামনে তুলে ধরতে চাই আমরা।’’
হ্যানোভারের মেলায় মোট ২৫টি ক্ষেত্রকে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরার ব্যাপারে জোর দিচ্ছে মোদী সরকার। কোন ক্ষেত্রে কী কী সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তার প্রচারে আলাদা আলাদা পুস্তিকাও তৈরি হয়েছে। এই বিষয়গুলি অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে কী ভাবে তুলে ধরা হবে তার জন্য চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। মেলায় অংশ নেওয়া প্রত্যেকটি রাজ্যের জন্য পৃথক বিনিয়োগ সংক্রান্ত সম্মেলনের পাশাপাশি থাকছে ভারতে স্মার্ট সিটি থেকে ভারী শিল্প, অপ্রচলিত শক্তি থেকে বৈদ্যুতিন ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি নিয়ে আলোচনাচক্র। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, বহুজাতিক সংস্থাগুলি যদি এশিয়ার কোনও দেশে বিনিয়োগ করতে চায়, তা হলে যেন তারা ভারতকেই বিনিয়োগের জন্য বেছে নেয়, এই লক্ষ্যেই ঝাঁপাতে নির্দেশে দিয়েছেন মোদী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy