বানভাসি বর্ধমানের রায়না। নিজস্ব চিত্র
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার রাতে মারা যান ঘাটাল শহরের গম্ভীরনগরের বাসিন্দা শ্যামল সাঁতরা (৭৩)। তবে, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর সৎকার করতে পারেননি পরিবারের লোকেরা। কারণ, শ্মশান চলে গিয়েছে জলের তলায়। কয়েকটি শ্মশান ঘুরেও সৎকারের ব্যবস্থা করা যায়নি।
গত ১০ বছরে এমনটা দেখেননি পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল শহর। পানীয় জলের সমস্যা ও বিদ্যুৎ না থাকায় সঙ্কট আরও বেড়েছে। সন্ধ্যা নামলেই চারপাশ ভরে যাচ্ছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে। প্লাবিত এলাকায় নেই রান্নার জ্বালানিও। পাঁশকুড়া সড়ক ছাড়া ঘাটালের সঙ্গে অন্য সমস্ত সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এ দিন দুপুর থেকেই মহকুমা প্রশাসনের তরফে মাইকে মানুষকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়, রূপনারায়ণ ও শিলাবতী নদীর বাঁধের অবস্থা সঙ্কটজনক। যে কোনও সময় তা ভেঙে যেতে পারে।
আরও পড়ুন- এ বারও বন্যা ‘ম্যানমেড’? প্রশ্ন বামেদের, মমতার আঙুল ঝাড়খণ্ডের দিকে
শুধু মেদিনীপুর নয়, এটা এখন গোটা দক্ষিণবঙ্গের চিত্র। যেমন দামোদরে জল বাড়ছে শুনে দুঃশ্চিন্তা নিয়েই মঙ্গলবার রাতে ওঁরা ঘুমাতে গিয়েছিলেন। বুধবার ভোরে দামোদরের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেই বুঝেছিলেন গ্রামে জল ঢুকতে আর দেরি নেই। সেটাই হল। বেলা গড়়াতেই পাড় ছাপিয়ে দামোদরের জল লাগোয়া বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন গ্রামে হু হু করে ঢুকতে শুরু করে। সোনামুখী ব্লকের রাধামোহনপুর পঞ্চায়েতের নিত্যানন্দপুর, পান্ডে পাড়া, মানা সমিতি, কেনেটি মানা, রাঙামাটি মানা প্রভৃতি গ্রামে এ দিন বেলার দিকে দেখা গিয়েছে বাড়ির উঠোনে জল বইছে। ফি বছরের অভ্যাস মতো এ বারও দুর্গাপুর ব্যারাজের প্রচুর জল ছাড়ার খবরে বুধবার সকাল থেকেই বেশ কিছু মানাচরের বাসিন্দারা তল্পিতল্পা গোছাতে শুরু করেছিলেন। গবাদিপশু নিয়ে তাঁরা ত্রাণ শিবিরে উঠতে শুরু করেন। ঘুটগোড়িয়া মানার সীতারামপুর কলোনীতেও দামোদরের জল ঢোকা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বাড়ি জলের তলায় চলেও গিয়েছে। সোনামুখী ব্লকের লালবাবার চর ও উত্তরচর মানার বেশ কিছু গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। ত্রাণ কার্যের জন্য সোনামুখী ব্লকে একটি স্পিডবোটও পাঠিয়েছে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন।
জলমগ্ন মেমারি।— নিজস্ব চিত্র
অন্য দিকে, টানা বৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পূর্ব বর্ধমানে। বুধবার বিকেল থেকে জেলার বিভিন্ন নদীর জল বিপজ্জনক ভাবে বাড়তে শুরু করেছে। জল না নামতে পারায় প্রায় ৫০টি গ্রাম জলমগ্ন। কুনুর নদীর জল উপচে ডুবেছে গুসকরা শহরের কিছু অংশ। সেচ দফতর সূত্রে জানা যায়, বর্ধমান শহরের কাছে দামোদরের জল প্রাথমিক বিপদসীমার অনেকটা নীচে। তবে কাটোয়ার কাছে অজয় ও ভাগীরথীর জল প্রাথমিক বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। জামালপুরে মুণ্ডেশ্বরী নদীর জল ঢোকা আটকাতে কাজ করছে হুগলি সেচ দফতর। জামালপুরের অমরপুরেও বাঁধ উঁচু করছে জেলা প্রশাসন।
বুধবারের পাঞ্চেত।—নিজস্ব চিত্র।
বুধবারের পাঞ্চেত।—নিজস্ব চিত্র।
এ দিন বিকেলে বর্ধমানের কাছে দামোদর দিয়ে ১ লক্ষ ৮০ হাজার কিউসেক জল গিয়েছে। বিপদসঙ্কেত জারি করেছে প্রশাসন। রায়না ২ ব্লকের দামোদরের ধারে বড় বৈনান, গোতান পঞ্চায়েত এলাকার ১৮টি গ্রাম জলমগ্ন। দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে থাকা ওই ব্লকের উচালনের ৭টি গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শিবির করে উদ্ধার কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। কুনুরের জল বাড়ায় গুসকরা শহরের একাংশে জল ঢুকতে শুরু করেছে। জলবন্দি শহরের শান্তিপুর, রটন্তী, বিহারীপাড়া এলাকা। বেহুলা নদী ও ডিভিসি সেচখালের জল উপচে মেমারির দেঁহা-সহ বেশ কিছু গ্রামও জলমগ্ন।
তবে এ দিন বীরভূমে তেমন বৃষ্টি হয়নি। ইতিমধ্যেই জেলায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। লাভপুর বাদে জেলার সামগ্রিক জল-ছবির ক্রমশ উন্নতিও হচ্ছে। নদীর জল নামছে। তবে, বিস্তীর্ণ এলাকার ধান খেত এখনও জলের তলায়। মঙ্গলবার লাভপুরের লাঘাটা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলেও, এ দিন সকাল থেকেই ফের জলের তলায় চলে গিয়েছে লাঘাটা। বন্ধ হয়েছে যান চলাচল। প্রায় তিন ফুট জল রয়েছে শাল নদীর উপরে বেলসারা কজওয়েতে। জল জমেছে কংকালীতলার মন্দিরেও।
আরামবাগের দ্বারকেশ্বরের নদীবাঁধের ভাঙনে বুধবার সকালে ফের ডোবে হুগলির আরামবাগ শহর। টানা বৃষ্টিতে শনিবারই প্লাবিত হয়েছিল শহরের অধিকাংশ এলাকা। তার পরে তিন দিন ধরে জল নামতে থাকায় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন মানুষ। কিন্তু তা স্থায়ী হল না। মঙ্গলবার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জুবিলি পার্কের গায়ে ওই বাঁধ চুইয়ে জল ঢুকছে দেখে সেচ দফতর বালির বস্তা দিয়ে তা সামলানোর চেষ্টা করে। রাতে পাহারাও দেওয়া হয়। কিন্তু বুধবার ভোর ৫টা নাগাদ বাঁধের ২০ ফুটেরও বেশি অংশ ভেঙে যায়। স্রোতের মতো জল ঢুকতে থাকে শহরে। আতঙ্কে ভুগতে থাকেন মানুষ। একতলা দোকান থেকে মালপত্র সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। বহু একতলা বাড়িতেও জল ঢুকে যায়। জল ঢোকে আরামবাগ উপ-সংশোধনাগারে। কয়েদিদের বাঁকড়া জেলে স্থানান্তরিত করানো হয়। বিকেলের পর থেকে অবশ্য জল নামতে থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy