নদিয়ার নগর-উখড়া সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা গীতা সরকার। বয়স মেরেকেটে ৩৬। কিন্তু এই বয়সেই দিদিমা হয়েছেন।
গীতাদেবীর পরিবার ১৩ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে তাঁকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আর বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সেই পরপর দুই সন্তানের মা হন তিনি। মেয়েদের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই বিধবা হয়ে ফের বাপের বাড়িতে ভাইয়ের সংসারে ফিরে আসা।
কিন্তু নিজের জীবনের দুর্ভোগের সঙ্গেই গীতার গল্প শেষ নয়।
তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ১৭ বছর বয়সে এবং ছোট মেয়ের বয়স ১৬। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু পড়াশোনা করলেও গীতাদেবীর ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছেন আত্মীয়েরা।
একই ছন্দে জীবন কেটে চলেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের বাসিন্দা সাবিত্রী চক্রবর্তীর পরিবারেও। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় এবং পরের বছরেই সন্তানের মা। তবে সাবিত্রী নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি বলে মেয়ের পড়াশোনায় কোনও খামতি রাখতে চাননি। নিজে বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েও মাত্র ১৬-তেই মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার এ দু’টি কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমনকী গ্রামাঞ্চলের বা কোনও গণ্ডগ্রামে নয়। পরিসংখ্যান বলছে শহর, শহরতলির মতো জায়গাতেও রোজই কোনও না কোনও এলাকায় নাবালিকার বিয়ে হচ্ছে। আর তার জেরে ২০১৫-২০১৬ সালের জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের নাবালিকার বিয়ে ছাড়িয়েছে ৪০ শতাংশের উপরে! দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে!
কিন্তু কী করে? ইদানীং সরকারি-স্তরে সচেতনতা বেড়েছে। বাল্য-বিবাহ রোধে সরকার তৈরি করেছে কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প। এগিয়ে এসেছে একাধিক বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। এমনকী নিজেদের বিয়ে রুখতে মেয়েরা নিজেরাই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে স্কুল কিংবা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দ্বারস্থ হচ্ছে। অথচ তারপরেও পরিসংখ্যানের নিরিখে এ রাজ্যে নাবালিকার বিয়ে সব থেকে বেশি। ৪০.৭%। দেশের গড় ২৭%। কিন্তু কেন এই ফারাক?
সমীক্ষা বলছে, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দুই চব্বিশ পরগনার মতো সীমান্তবর্তী জেলা থেকে রোজই মেয়ে পাচারের মতো ঘটনা ঘটে। কোনও না কোনও উপায়ে মেয়েদের এ রাজ্য থেকে নিয়ে যাওয়ার ফাঁদ পেতে বসে থাকে পাচারকারীরা। এমনকী বিয়ের টোপ দিয়ে নিষিদ্ধপল্লিতে বিক্রির মতো ঘটনার বাস্তব ছবিও ধরা পড়ছে। ফলে মেয়ে একটু বড় হলেই তাদের নিরাপত্তা নিয়ে মা-বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। যেমন সাবিত্রীদেবী বলেন,‘‘ কে কোথায় ফুঁসলে নিয়ে যাবে, সেই ভয়ে কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।’’
আর এই নিরাপত্তার অভাববোধের সঙ্গে রয়েছে সামাজিক ও পারিবারিক চাপ। যে সমাজে এখনও মেয়ে মানে ‘বোঝা’। মেয়েদের পড়াশোনা তাই অনাবশ্যক সময় ও অর্থের অপচয়। গীতাদেবী সেই নিরন্তর চাপের শিকার। তিনি জানান, ছোট মেয়েকে ভাইয়ের বাড়িতে রেখে পড়াচ্ছেন। কিন্তু তাঁর ভাই ভাগ্নির বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার জন্য গীতাদেবী গঞ্জনা শুনছেন।
ফলে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলেই দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পাওয়ার এই ধারণা স্মার্ট ফোনের দিনেও কাজ করছে। যার জেরেই সচেতনতা বা়ড়লেও বাস্তবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়েনি। তাতে সমস্যায় পড়ছে নাবালিকারাই। কোথাও কম বয়সে বিয়ের পরেই সন্তান-ধারণে তাঁদের শারীরিক অবনতি হচ্ছে, কোথাও আবার পড়াশোনা না জানায় বিবাহিত জীবনে সমস্যা এলে ব্যাহত হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাও!
সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েছে সরকারও। তবে রাজ্য সরকারের এক শীর্ষ আমলার দাবি, ২০১১-১২ সালের তুলনায় রাজ্যের পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হয়েছে। সমস্যার মূলে পৌঁছতে লাগাতার সচেতনতা কর্মসূচি চালানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy