Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

‘এ বার ফেরালে, পড়া বন্ধ করলে, গলায় দড়ি দেব’

বাবা-মায়ের জেদ আর হুমকির মুখে বছর ষোলোর মেয়েটা বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়ার স্বপ্ন তার দু’চোখে।

কারিমা খাতুন

কারিমা খাতুন

নির্মল বসু
বাদুড়িয়া শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০২:৫৭
Share: Save:

বাবা বলেছিলেন, ‘‘বিয়ে না করলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব।’’

মেয়ে বলেছিল, ‘‘আমি পড়তে চাই।’’

বাবা-মায়ের জেদ আর হুমকির মুখে বছর ষোলোর মেয়েটা বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়ার স্বপ্ন তার দু’চোখে। বিয়ের তিন দিনের মাথায় ফিরে আসে বাপের বাড়িতে। বলে, ‘‘এ বার যদি ফেরত পাঠাও, পড়া বন্ধ করে দাও, গলায় দড়ি দেব।’’

বাবা-মায়ের অবশ্য তাতেও মন গলেনি। ঘরে আটকে রেখে শুরু হয় মারধর, ধমক। মেয়ে বুঝে নেয়, বেশি দিন লড়াইটা এ ভাবে চালানো যাবে না। সুযোগ বুঝে ফোনে বিষয়টা জানায় চাইল্ড লাইনে। শুক্রবার বিকেলে ঘরবন্দি কারিমা খাতুনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। মেয়ে এখন বলছে, ‘‘বড় হয়ে স্কুলে পড়াব। পেটে বিদ্যে না থাকলে কেউ মানুষ হয় না।’’

প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘পুরুলিয়ার রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দীর মতো কারিমার লড়াইটাও ভরসা জোগাবে অনেক মেয়েকে।’’

কারিমার বাড়ি বাদুড়িয়ার পোলতা গ্রামে। দশম শ্রেণিতে পড়ে সে। জানুয়ারি মাসে বিয়ের ঠিক করেন বাবা মোক্তার গাজি। মত ছিল মা মাফুজারও। পাত্র কে? তার আবার আগের পক্ষের স্ত্রী আছে। তবু তিনিই মোক্তারের চোখে ‘খাসা পাত্র।’ ‘বেয়াড়া মেয়ে’ স্কুলে গিয়ে কথাটা পাছে পাঁচকান করে, কারিমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন বাবা। মামা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তালাবন্ধ করে কয়েক দিন রাখা হয়েছিল সেখানেই। দিন কয়েক আগে বিয়ে হয় সেই ‘সুপাত্রের’ সঙ্গেই।

তিন দিনের মাথায় মোক্তারের কাছেই ফেরে কারিমা। এ বার মেয়ে আরও একরোখা। তাকে পড়াশোনা করতে দিতেই হবে। আর বাবার দাওয়াই একটাই, মারধর।

স্রেফ একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল মেয়েটা। শুক্রবার বাবা-মা যখন বাড়ির বাইরে, প্রতিবেশীর কাছ থেকে মোবাইল জোগাড় করে কারিমা ফোন করে চাইল্ড লাইনে। নম্বর এল কোথা থেকে? কারিমা জানায়, স্কুলে এসে পুলিশ কাকুরা একবার নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন।

ফোনে চাইল্ড লাইনের আধিকারিককে কারিমা বলে, ‘‘জোর করে বিয়ে দিয়ে আটকে রেখেছে। আমাকে উদ্ধার করুন। আমি পড়তে চাই। এ ভাবে চলতে থাকলে ক’দিন বাদে আমাকে আর বাঁচতেই দেবে না।’’ কথাটা পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকদের কানে ওঠে। কারিমার কাছ থেকে পাওয়া ঠিকানায় বিকেলেই হাজির হন পুলিশ, চাইল্ড লাইনের আধিকারিকেরা। মোক্তারেরা ততক্ষণে খবর পেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। মেয়েটিকে উদ্ধার করে মধ্যমগ্রামের একটি হোমে রাখা হয়েছে।

পোলতা গ্রামের বাসিন্দা সাহেব আলি গাজি জানিয়েছেন, কারিমাকে নিয়ে গ্রামে সালিশি বসেছিল। মেয়েটা জানিয়েছিল, বিয়ে করতে চায় না। তার বিয়ের বয়সও হয়নি। কিন্তু ওর বাবা খুব একগুঁয়ে।

এ বছর মাধ্যমিকে বসা হয়নি কারিমার। সেই আফসোস রয়েছে। কিন্তু জেদ তো তারও কম নয়। বলে, ‘‘একটা বছর নষ্ট হলে কিচ্ছু আসবে যাবে না। গোটা জীবনটাই তো নষ্ট হতে বসেছিল।’’ কারিমার এখন চিন্তা ছোট বোন রেশমাকে নিয়ে। সে পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। তাকেও অপরিণত বয়সে বিয়ে দেবে না তো বাবা? পুলিশকে সেটা দেখতে বলেছে কারিমা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE