নবদম্পতি: বিয়ের পরে রুনা এবং বুদ্ধদেব। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
মঞ্চের মেঝেয় পায়ের বুড়ো আঙুলটা এলোমেলো ঘষে চলেছে ‘নন্দিনী’।
কোনাকুনি আলো পড়েছে মুখে, নন্দিনী বলছে— ‘‘পাগল ভাই, এই বন্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার-আমার মাঝখানটিতেই একখানা আকাশ বেঁচে আছে...।’’
সেই সন্ধেটা এখনও মনে আছে রুনা বিবির। হাততালিতে ফেটে পড়ছে হলঘর। ডুমো আলোয় ভেসে যাচ্ছে মঞ্চ, আর নিশ্চুপে কোথাও যেন জমা হচ্ছে একটুকরো মনখারাপ!
বছর দশেক আগে, ‘রক্তকরবী’ শেষে সাজঘরে বসে যে মনখারাপের মেঘ জমেছিল রুনা বিবির, মঙ্গলবার বিকেলে সেই কষ্টের উপরেই কিঞ্চিৎ স্বস্তির প্রলেপ পড়ল যেন।
আরও পড়ুন: ‘মেয়ে পুলিশ’ মারবে! ভয়ে ছিল খুনিও
‘বিশু পাগল’-এর সঙ্গে নতুন করে ফের জীবন গাঁথলেন ‘নন্দিনী’, মানে বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের যাবজ্জীবন সেলের বুদ্ধদেব মেটে আর মহিলা সেলের রুনা বিবি।
প্রথম জন, পড়শির হাতে বাবাকে রক্তাক্ত হতে দেখে খেটো বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সাড়ে তিন বছর ধরে মামলা চলার পরে সাজা ঘোষণা হয়েছিল— যাবজ্জীবন কারাবাস। আর, বিয়ের দু’মাসের মধ্যেই দেওরের মেয়েকে খুনের দায়ে জড়িয়ে পড়ে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছিলেন দ্বিতীয় জন।
বীরভূমের আবাদ গ্রামের বুদ্ধদেব মেটে আর জলঙ্গির সাদিখাঁরদিয়াড়ের রুনা বিবি, যাঁদের জীবনের দ্বিতীয় ভাগ শুরু হয়েছিল বহরমপুর জেলখানায়। জেলের চাতাল ছাড়িয়ে সবুজ মাঠ, জলা-পুকুর, তার পরে শ্যাওলা-ধরা দেওয়াল নিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থমথম করছে ‘উইমেনস সেল’— মহিলা হাজত। বুদ্ধদেব বলছেন, ‘‘ওর সঙ্গে প্রথম আলাপ ‘তাসের দেশ’ করতে গিয়ে। কিন্তু নাটক শেষ, আমাদের দেখা সাক্ষাৎও ফুরিয়ে গেল। কী করব, আমি হাঁ করে জলা পুকুরের ধারে ওই মহিলা সেলের দিকে তাকিয়ে থাকতাম!’
জেল-বন্দিদের নিয়ে বহরমপুর রেপার্টরির ‘তাসের দেশ’ করার পর্বে রুনা-বুদ্ধর সম্পর্ক থমকে ছিল শুধু নাটকেই। নির্দেশক প্রদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘ওঁদের আসল পরিচয় বোধহয়, রক্তকরবী-র মহলায়। নাটকটা যেন দাঁড়িয়েছিল অজ-গাঁয়ের দু’টি মানুষের না-পাওয়া ভালবাসার উপরেই!’’ প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কখনও কলকাতায়, কখনও দিল্লিতে রক্তকরবী ফুটিয়ে এসেছেন রুনা-বুদ্ধ। কিন্তু বাকিটা থমকেছে অনুশাসনে।
রুনা বলছেন, ‘‘চোদ্দো বছর ধরে জেল খাটছি, বাড়ির কথা ফিকে হয়ে এসেছে কবেই। কিন্তু, নতুন করে কিছু ভাবতেই ভয় করত!’’ সেই ভয়টাই মুছে দিয়েছেন বুদ্ধদেব। এক লহমায় যেন অনেকটা পিছিয়ে যাচ্ছেন রুনা, বলছেন, ‘‘রিহার্সালের সময় বুদ্ধ যখন গেয়ে উঠত, ‘ওগো দুখজাগানিয়া’ তখন বুকটা ধক করে উঠত!’’
প্যারোলের এক মুঠো মুক্তিতেই যে দেখাশোনা থমকে ছিল, মঙ্গলবার সেটাই বুঝি বিস্তৃত হয়ে উঠল। কিন্তু এর পর? জেলকর্তারা বলছেন, ‘‘দেখা যাক, বিয়ের পরে ওঁদের মুক্ত কারাগারে পাঠানো যায় কি না।’’
যেখানে অন্তত নন্দিনীকে বলতে হবে না— ‘কত কাল খোঁজ পাই না, কোথায় তুমি গেলে বল তো!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy