যন্ত্রণাক্লিষ্ট রোগীকে নিষ্কৃতির অধিকার না দেওয়াটা তার প্রতি বৈষম্যের সামিল।—স্টিফেন হকিং
দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত একমাত্র সন্তানের শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলেন না বৃদ্ধ বাবা-মা। ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, কোনও পরিস্থিতিতেই সুস্থ হওয়ার আশা নেই তার। বাবা-মা চেয়েছিলেন কোনও ওষুধ বা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তাঁদের সন্তানের শেষ পরিণতিটা ত্বরান্বিত করা হোক।
কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ওই তরুণের নিষ্কৃতির জন্য বাবা-মায়ের এই আর্জি মানতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। কারণ, এ দেশে নিষ্কৃতি মৃত্যুর প্রত্যক্ষ আইনি স্বীকৃতি নেই।
রিষড়ার অন্তিম পর্যায়ের ক্যানসার রোগীদের জন্য একটি হসপিস চালান শান্তনু চক্রবর্তী। তিনি বললেন, “এই মুহূর্তে এখানকার অন্তত তিন-চার জন রোগীর পরিবারের কথা বলতে পারি, যাঁরা তাঁদের প্রিয়জনের নিষ্কৃতি-মৃত্যু চান।”
রোগ-যন্ত্রণায় কাতর একাধিক পরিবারের তরফেই বিভিন্ন সময়ে এমন আবেদন জমা পড়েছে স্বাস্থ্য ভবনে। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে নিষ্কৃতি-মৃত্যু সম্পর্কে তাদের মতামত জানাতে বলায় বিষয়টি আরও একবার সামনে এল। দেড় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে ওই মতামত জানাতে হবে।
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানিয়েছেন, শীঘ্রই এ ব্যাপারে একটি কমিটি তৈরি হবে। ওই কমিটি প্রাসঙ্গিক সব দিক খতিয়ে দেখে রাজ্যের অবস্থান ঠিক করবে। শতপথী বলেন, “দু’টি বিষয় ভাবার রয়েছে। প্রথমত, কোনও চিকিৎসাতেই যাঁদের সুস্থ হওয়ার আশা নেই, এমন রোগীদের যন্ত্রণা লাঘবের জন্য ইচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দেওয়া উচিত কি না। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় সংস্কৃতি ও আবেগের সঙ্গে এই মৃত্যুর ধারণাটা খাপ খাচ্ছে কি না।”
পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার স্বীকৃত। আবার বহু দেশে এর সপক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলছে। ব্রিটেন তার মধ্যে অন্যতম।
এ দিন বিষয়টি নিয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-ও, যিনি নিজে মোটর নিউরোন ডিজিজ-এর রোগী, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী।
হকিং বলেছেন, মৃত্যু বেছে নেওয়ার অধিকার অবশ্যই থাকা উচিত। যন্ত্রণাক্লিষ্ট রোগীকে নিষ্কৃতির অধিকার না দেওয়াটা তার প্রতি বৈষম্যের সামিল। অসুস্থের প্রতি সুস্থের বৈষম্য। নিজের উদাহরণ দিয়ে হকিং জানিয়েছেন, ১৯৮৫ সালে ট্রাকিওসটমি অপারেশনের পর যখন তাঁর গলার আওয়াজও চিরতরে চলে গেল, তিনি শ্বাসবন্ধ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
ভারতে ২০১১ সালে অরুণা শনবাগ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট অরুণার মৃত্যুর অধিকার না দিলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যু বা প্যাসিভ ইউথেনেশিয়ার অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল। যার অর্থ, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার।
কেন্দ্রীয় সরকার এর কিছু দিন পরই এ ব্যাপারে একটি পৃথক আইন আনার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে। প্রস্তাবিত আইনে প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুর অনুমোদন অর্থাৎ প্রাণঘাতী ওষুধ ব্যবহারের পথও রাখা যায় কি না সে ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়। তখনও বিভিন্ন রাজ্যের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে এ রাজ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা হয়। ওই কমিটি নিষ্কৃতি-মৃত্যুর পরোক্ষ অধিকারের পক্ষে সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সরকারের মধ্যে একটি অংশ তাতে সহমত হতে পারেনি।
এখন সুপ্রিম কোর্ট আবার মত জানতে চাওয়ার পরে নতুন করে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হবে। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করবে রাজ্য সরকার।
আইন বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ মনে করেন, রোগীর শারীরিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন, তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত করা কোনও চিকিৎসকের পক্ষে নৈতিক ভাবে সম্ভব নয়। অন্য মতটিও যথেষ্ট জোরালো।
এই দলে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “অন্যের কোনও ক্ষতি না করে এক জন মানুষ যদি নিজের অসহ্য যন্ত্রণা কমানোর জন্য জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা অপরাধ কেন হবে? এক জনের উপরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকবে, সেটা এ বার ভাবার সময় এসেছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy