Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

একই উন্নয়ন যন্ত্রণা: সাকুর বস্তি, সিঙ্গুর কিংবা শান্তিনিকেতন

নিঃশব্দ উচ্ছেদ এখানে আমরা আগেও দেখেছি। বোলপুরের প্রান্তে একটি উপনগরী তৈরি হওয়ার সময় আদিবাসী জনজাতি ও অন্য অনেক চাষিবাসী মানুষের জমি গেছে। পরিবেশ হারিয়েছে তার অপূর্ব বৈচিত্র্য। কিন্তু একেবারে বুলডোজার দিয়ে রাজপথের দু’ধারে শত শত মানুষকে জীবিকাচ্যুত করতে আমরা সত্যিই দেখিনি।

শান্তিনিকেতনের ফুটপাথে বুলডোজার চালিয়ে উচ্ছেদ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরি।

শান্তিনিকেতনের ফুটপাথে বুলডোজার চালিয়ে উচ্ছেদ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরি।

সৌম্য চক্রবর্তী ও তন্ময় সিংহ মহাপাত্র
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৮:৪৪
Share: Save:

শীত এসে গেল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালির অন্যতম সাংস্কৃতিক হটস্পট শান্তিনিকেতন মেতে উঠেছে পৌষমেলার আয়োজনে! কিন্তু এই সব কিছুকে ছাপিয়ে, পৌষমেলার আনন্দ-আয়োজনকে ম্লান করে দিয়ে আমাদের, মানে শান্তিনিকেতনবাসীর কাছে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়েছে আধুনিক সমাজজীবনের সম্ভবত সবচেয়ে বড় অসুখ— উচ্ছেদ (যা অনেকটা ইন্টারনেট, সেলফোন কিংবা শপিং মলের মতোই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠছে ক্রমশ)। একেই বোধহয় বলে, কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ!

নিঃশব্দ উচ্ছেদ এখানে আমরা আগেও দেখেছি। বোলপুরের প্রান্তে একটি উপনগরী তৈরি হওয়ার সময় আদিবাসী জনজাতি ও অন্য অনেক চাষিবাসী মানুষের জমি গেছে। পরিবেশ হারিয়েছে তার অপূর্ব বৈচিত্র্য। কিন্তু একেবারে বুলডোজার দিয়ে রাজপথের দু’ধারে শত শত মানুষকে জীবিকাচ্যুত করতে আমরা সত্যিই দেখিনি। সেখানে পড়ে আছে কঙ্কালের মত ’শয়ে ’শয়ে ধ্বংসস্তূপ। পৌষমেলার প্রাকমুহূর্তে আক্ষরিক অর্থেই শিশুঘাতী ‘উন্নয়ন’-এর এমন বীভৎসতা ‘দিবে আর নিবে/মিলাবে মিলিবে’-র শান্তিনিকেতনে আমরা বড় একটা অনুভব করিনি এর আগে কখনওই। যে পৌষমেলা শুরুই হয়েছিল জ্ঞান ও কর্মের মিলন, জ্ঞানচর্চা ও পল্লিগ্রামের উন্নয়নের মিলন, সমবায়িক মিলনের অনুসারী হয়ে, সেই পৌষমেলার (সৌন্দর্যায়নের) দোহাই দিয়ে এমন সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি খুবই অদ্ভুত। আর সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা, যাঁরা দিল্লি কিংবা সিঙ্গুরের দাম্ভিক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁরাই হয়ত এই উচ্ছেদের সাথী। এরই ফলে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাসের বাতাবরণ। নির্মিত হচ্ছে যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির বিন্যাস। অথচ বদলাচ্ছে না কিছুই। সুতরাং এই রকম কয়েকটি যুক্তিকেই আরও একবার তৌল করে নেওয়া প্রয়োজন।

যুক্তি ১: ‘এরা উড়ে এসে জুড়ে বসা পরগাছা’

এই যুক্তির যাঁরা পৃষ্ঠপোষক তাঁরা হয়তো খেয়াল করেন না যে, শান্তিনিকেতনের কিংবা যে-কোনও শহরের এক বিরাট অংশের মানুষই কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা। যুক্তিবাগীশ নিজেও এর অন্তর্ভুক্ত, এমন সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। আসলে বহু-দশক বা শতাব্দী ধরে এই সব অঞ্চলের অগণিত খেটে-খাওয়া মানুষের সম্পদ এবং প্রকৃতির সম্পদ নিঃশব্দে/সশব্দে আর্থিক-রাজনৈতিক-সামাজিক আধিপত্য/জোর-এর সাহায্যে হস্তান্তর (বা হস্তগত করার) মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে এবং উঠছে আজকের শহরগুলো।

যুক্তি ২: ‘মানুষের অসুবিধে ঘটাচ্ছে তাই এঁরা অবাঞ্ছিত’

কিছু জায়গায় এঁরা অন্যের জমি বা আর্থ-সামাজিক পরিসর দখল করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাটা একেবারেই সত্যি নয়, বরং এঁদের উপস্থিতি ভীষণ বাঞ্ছিত। যেখানে সস্তা পরিষেবার অনটন, কোনও সরকারি/বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক পরিষেবা-সহায়তা প্রায় নেই, সংগঠিত যানবাহন নেই, ঠিকঠাক বাজার নেই, খাবার দোকান, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ, সেলুন, সাইকেল সারাই, চায়ের দোকান, সব্জির দোকান কিচ্ছু নেই, ত্রিসীমানায় কোনও সরকারি/বড় বেসরকারি সাহায্য মেলে না, সেখানে এঁদের প্রয়োজন তো অত্যন্ত বেশি! এঁরা ছোট-মাঝারি শহরের মধ্যবিত্তের বিপুল চাহিদা মেটান। আর এই ভাবে মূলত সততার সঙ্গে নিজের ও পরিবারের অন্নসংস্থান করেন। যেখানে সরকার প্রায় অনুপস্থিত, বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও লাভ-ক্ষতি হিসেব করে বিনিয়োগে মোটেই ইচ্ছুক বা সক্ষম নয়, সেখানে তো এঁরা আর্থ-সামাজিক জীবনের একেবারে অবিচ্ছেদ্য অংশ।

যেখানে কর্ম-সংস্থান নেই, ন্যূনতম বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই, জগতবিখ্যাত হাতের কাজের উন্নতির তেমন একটা চেষ্টা নেই, কৃষি ও শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের কোনও বালাই নেই সেখানে স্বভাবতই কাল্পনিক উন্নয়নের গল্পের চর্বিতচর্বণ আমরা অবিশ্বাস করতে বাধ্য।

যুক্তি ৩: ‘এঁরা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে বাধা। উন্নয়ন হলে সবার উন্নতি। এঁদেরও...”

এটা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির একটা অদ্ভুত যুক্তি, যা নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর! এই যুক্তি অদ্ভুত ভাবে উচ্ছেদ-খিদে-মৃত্যু সব কিছুকে উন্নয়নের প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে হাজির করে— অবশ্যই কিছু মানবিক মুখোশের আড়ালে (যেমন সুষ্ঠু পুনর্বাসন ইত্যাদি)।

প্রথমত, এই সব উচ্ছেদ বেশির ভাগ সময়ে কোনও পুনর্বাসন ছাড়াই প্রয়োগ হয়। কালক্রমে বোঝা যায়, পুনর্বাসন ছিল নেহাৎই ছেলেভোলানো গল্প। না হলে, এমন শীতের মুখে, পৌষমেলা উপলক্ষ্যে দু-পয়সা রোজগার করার সুযোগ থেকে হাজার হাজার মানুষকে হঠাৎ বঞ্চিত করা যায়!

আর এমন বিচিত্র উন্নয়ন মডেলের পরাকাষ্ঠা আমরা আগেই দেখেছি। শান্তিনিকেতনের কাছের ওই উপনগরীই তো আজ প্রেতের শহর (Ghost Land)। সবচেয়ে মজার কথা, ওই উপনগরীকে উপলক্ষ্য করে স্টেশন চত্বরে যা একটু-আধটু, অল্পস্বল্প ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে উঠেছিল, সেগুলো সমূলে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অথচ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, করুণ চোখগুলোর ঠিক পাশেই, গজিয়ে ওঠা মন্দিরটাকে অক্ষত থাকতে দেখে খুবই অবাক লাগল। আমাদের কাছে কোনটা বেশি জরুরি? শহরের সৌন্দর্যায়নে লাভ কার? পিচমোড়া চওড়া রাস্তা হলে মূলত কাদের লাভ? যদি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নই মূল লক্ষ্য, তবে গ্রাম-শহরের ও বিশেষত, মানুষ ও পরিবেশের ভারসাম্য মেনেই পরিকল্পনা করা হয় না কেন? আর তা হয় না বলেই, নগরায়ন-উন্নয়ন-আধুনিকীকরণ-উচ্ছেদ-পুনর্বাসন— জীবন সংগ্রাম এবং আবারও উচ্ছেদ। এই চক্রের শেষ কোথায়?

উচ্ছেদ শহরের গতি বাড়াবে, আসবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। অপেক্ষা করে থাকা, কবে লাভ-ক্ষতির জটিল হিসেব পেরিয়ে আসবে বড় বিনিয়োগ। কিন্তু, বিনিয়োগ যদি আসেও, তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ যে প্রায় নেই তা আজকের আধুনিক কলকারখানার বিপুল যান্ত্রিকতার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। অথচ, বসে আছি বাজারেরই আশায়। অন্য দিকে ভাবছি, সরকার শুধু কিছু ভাতা, ঋণ, ১০০ দিনের কাজ আর স্বচ্ছতা— এ সব নিয়েই মাথা ঘামাক। দারিদ্রকে ‘ম্যানেজ’ করাই যেন তার একমাত্র কাজ।

যুক্তি ৪: ‘উচ্ছেদ অন্যায় নয়। পুনর্বাসন জরুরি। উচ্ছেদ-উন্নয়ন-পুনর্বাসন-পুনর্গঠন। এটাই সঠিক পথ।’

আধুনিক সমাজে স্বাধীনতা-স্বক্ষমতা-র সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রবক্তা অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের শহরেই (তাঁর বাসস্থানের দোরগোড়ায়) এমন উচ্ছেদ-হরণ-পরাধীনতা! সত্যিই ভাগ্যের কি নিদারুণ পরিহাস! কিছু দিন আগে অধ্যাপক সেন এ রকমই একটি ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। স্বভাবতই কেউ কর্ণপাত করিনি!

উন্নয়ন-পুনর্বাসন-পুনর্গঠন হবেই, সুতরাং আজ উচ্ছেদ। এই বিচিত্র যুক্তি কি আর মেনে নেওয়া যায়? এ শুধু দুর্বল যুক্তি ও কুযুক্তিই নয়, ভীষণ অকেজোও বটে। ইতিহাসই তা বলে দেয়। মরিচঝাঁপি-সিঙ্গুর-নবি মুম্বই-বেদান্ত-পসকো-অপারেশন সানশাইন কিংবা প্রান্তিক-রাজারহাট— কোথাও আমরা এই গল্প/আশ্বাসের কোনও সত্যিকারের প্রতিফলন দেখিনি। কোনও রকম দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা ছাড়াই উচ্ছিন্ন মানুষকে বসানো হয়েছিল শহরগুলোর আনাচে-কানাচে। মানুষও বাঁচার তাগিদে তা করতে বাধ্য হয়েছিল। আজ সেই দায়সারা ভুলকে আরও বড় ভুলের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সব জায়গায়। উচ্ছিন্নরা এর পর কোথায় যাবে? বলতে পারেন?

যুক্তি ৫: ‘স্মার্ট হতে গেলে এটুকু ক্ষয়ক্ষতি মানতেই হবে। অল্পের ক্ষতি বনাম জনগণের প্রগতি।’

মনে পড়ে যায় চ্যাপলিনের সেই বিখ্যাত ভাষণ, ‘One murder makes a man a villain, millions a hero.’ কী অদ্ভুত দর্শনে মজে যাচ্ছি আমরা! স্মার্টনেসের অনুসারী কি হতেই হবে নিষ্ঠুরতাকে? আজ যারা সমাজের নানা রকম সুযোগ-সুবিধার ভাগীদার, তাদের কাছে এই সব ‘ছোটখাটো’ ঘটনার হয়তো তেমন একটা গুরুত্ব নেই, কিন্তু এমন চলতে থাকলে অচিরেই আমাদেরও বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।

যুক্তি ৬: ‘বড্ড প্যানপ্যানে ব্যাপার। পুরনোকে আঁকড়ে থাকা যায়?’

ঠিক তাই। গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে আমরা এটা একদম বরদাস্ত করতে পারি না। যে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন পশ্চিমের দিকে চেয়েছিলেন অনেক আশা নিয়ে, তিনিই যদি জীবনের একেবারে শেষে, সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারেন নিজের সেই ভাবনাকে, ভ্রান্ত মনে করে, সমস্ত কিছু আবার নতুন করে ভাবার কথা বলেন, তবে আমরা কেন বস্তাপচা-ধার করা উন্নয়ন মডেলকে বর্জন করতে পারব না? কেন আমরা ভুলে যাব আজকের তথাকথিত উন্নয়ন মডেলে, ‘কল্যাণকে (ব্যক্তি বা কিছু মানুষের) স্বার্থের অনুবর্তী করা হয়েছে, তাকে পুরোবর্তী করা হয়নি।...কল্যাণের দাবি হচ্ছে স্বার্থের বিপরীত এবং স্বার্থের দাবির চেয়ে তা উপরের জিনিস।” কেন আমরা ভুলে যাব যে, “সাধারণের দারিদ্রহরণের শক্তি ধনীর ধনে নেই (কেননা, তা কেবল হরণ করে)...সে আছে সাধারণের শক্তির মধ্যেই।’ (‘সমবায় নীতি’)

রবীন্দ্রনাথ অন্য রকমের জ্ঞান ও কর্মের খোঁজে কলকাতা ছেড়ে এসেছিলেন এই শান্তিনিকেতনে। অন্য রকমের উন্নয়ন মডেলের কথা ভেবেছেন। চেষ্টা করেছেন বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটানোর। মানুষের আত্মশক্তির যৌথ জাগরণের উপরে বিশ্বাস করেছেন। শুধু সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চা নয়, প্রান্তিক মানুষের সার্বিক উন্নতিতে জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন। প্রান্তিক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া ও তার উন্নতিতে আত্মনিয়োগ করেছেন। কিন্তু আমরা, আধুনিকতাবাদীরা গুরুদেবকে ছাড়িনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ছেড়েছি। উন্নয়নের ফেরিওয়ালা হয়ে এসে দাঁড়িয়েছি তাঁর সাধের আবিষ্কার প্রক্রিয়ার একেবারে সামনে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন চ্যালেঞ্জ করছি, যেন বলেই ফেলছি, ‘গুরুদেব দীর্ঘজীবী হোন...রবীন্দ্রনাথ আজ অস্তমিত’!

(সৌম্য চক্রবর্তী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক)

(তন্ময় সিংহ মহাপাত্র দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE