Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

নিজেদের জয়েন্টেও কেন পিছিয়ে বাংলা

বাইরের পরীক্ষায় সে-ভাবে এঁটে উঠতে না-পারার কারণ তবু বোঝা যায়। কিন্তু আপন ঘরের পরীক্ষাতেও বাংলার ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে পড়ছেন কেন?

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

বাইরের পরীক্ষায় সে-ভাবে এঁটে উঠতে না-পারার কারণ তবু বোঝা যায়। কিন্তু আপন ঘরের পরীক্ষাতেও বাংলার ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে পড়ছেন কেন?

প্রশ্নটা তুলে দিয়েছে রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টের ফলাফলই। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পড়ুয়ারা পিছিয়ে পড়ছে, এটা নিছক অভিযোগ নয়, বাস্তব। ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টের ফল বেরোতে দেখা গেল, রাজ্যের এই পরীক্ষাতেও সিবিএসই, আইএসসি বোর্ডের পড়ুয়াদের থেকে পিছিয়ে পড়ছেন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পাঠ্যক্রমের ছাত্রছাত্রীরা। দেশজোড়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বাংলার পিছিয়ে থাকার কথা শিক্ষামহলের কর্তারা মেনে নিয়েছিলেন। দৌড়ে টিকে থাকার জন্য পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজা হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের নিজস্ব পরীক্ষাতেও মুখরক্ষা হল না উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের।

রবিবার প্রকাশিত রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মেধা-তালিকার শীর্ষে সে-ভাবে জায়গাই পাননি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পাঠ্যক্রম পড়ে পাশ করা পড়ুয়ারা। রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে ঠাঁই পাওয়ার এই পরীক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে কেন? পাঠ্যক্রম এবং প্রশ্নের ধরনই কি এই পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে, উঠছে এই সব প্রশ্ন।

সর্বভারতীয় পরীক্ষায় এই রাজ্যের পড়ুয়ারা যাতে সমান তালে দৌড়তে পারেন, সেই জন্য ইতিমধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রমে রদবদল করা হয়েছে। পরিবর্তন আসছে আগামী বছরের মাধ্যমিকেও। শুধু পাঠ্যক্রমে নয়, বদলানো হচ্ছে প্রশ্নের ধাঁচ এবং উত্তর লেখার ধরনও। এ রাজ্যের স্কুল পরীক্ষাতেও জোর দেওয়া হচ্ছে ‘মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন’ বা এমসিকিউ-এর উপরেই। সিবিএসই বোর্ডের আদলেই সাজানো হচ্ছে এ রাজ্যের স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আশা, এর ফলে স্কুল থেকেই পড়ুয়ারা বৃহত্তর ক্ষেত্রের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কোমর বেঁধে নামার কায়দা শিখে যাবেন।

কিন্তু এত করেও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির পরীক্ষার ফলাফলে পিছিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের পড়ুয়ারা। উচ্চ মাধ্যমিকের মেধা-তালিকায় যাঁরা ছিলেন প্রথম দিকে, এই প্রবেশিকার সফল-তালিকার শীর্ষে তাঁদের অনেকেরই ঠাঁই হয়নি।

শিক্ষকমহলের একাংশ অবশ্য এটাকে পিছিয়ে পড়া বলতে রাজি নন। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভানেত্রী মহুয়া দাস জানান, নতুন পাঠ্যক্রম শুরু হয়েছে সবে বছর দুয়েক হল। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধার সামগ্রিক বিচার চলতে পারে না। ‘‘কারণ, জয়েন্ট হোক বা অন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, সব ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি থাকে। অঙ্ক কত অল্প সময়ে কষে ফেলা যায়, এগুলো সেই বিশেষ পদ্ধতির অঙ্গ। এগুলোর সঙ্গে সাধারণ পাঠ্যক্রমের পরীক্ষার তফাত তো থাকবেই,’’ ব্যাখ্যা মহুয়াদেবীর। তিনি জানান, কেউ কেউ উচ্চ মাধ্যমিককেই পাখির চোখ করেন। অনেকে আবার যাবতীয় মনোযোগ দেন জয়েন্টের প্রস্তুতিতে। এটা পড়ুয়ার ব্যক্তিগত কেরিয়ার নির্বাচন। সে-ভাবেই নিজেদের তৈরি করেন তাঁরা। তার সঙ্গে মেধায় পিছিয়ে পড়ার সম্পর্ক নেই।

রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ডের চেয়ারম্যান সজল দাশগুপ্ত অবশ্য মনে করেন, পাঠ্যক্রম নয়, প্রবেশিকা পরীক্ষার ক্ষেত্রে পড়ুয়ার মেধাই শেষ কথা। তিনি বলেন, ‘‘জয়েন্টের ক্ষেত্রে বলতে পারি, সিবিএসই, আইএসসি এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ মিলিয়েই এই প্রবেশিকার পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়। এখানে কে কোন বোর্ডে পড়ছে, সেটা কোনও ব্যাপারই নয়। কে কতটা পড়ছে, সেটাই সাফল্য-ব্যর্থতা ঠিক করে দেয়।’’

জয়েন্টের প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা প্রশিক্ষণ দেয়। কলকাতার এমনই একটি প্রশিক্ষণ সংস্থার তরফে চিরঞ্জিত ঘোষ জানান, স্কুলের পড়াশোনার সঙ্গে এই প্রস্তুতিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ‘‘প্রবেশিকার প্রস্তুতি চালাতে হলে পাঠ্যক্রমের ঊর্ধ্বে গিয়ে পড়তে হয়। আমরা একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণি থেকেই বিশেষ ভাবে প্রস্তুতির ব্যবস্থা করি। অতিরিক্ত ক্লাস করাই, নিয়মিত পরীক্ষা নিই। স্কুলের পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যেগুলো আদৌ সম্ভব হয় না,’’ বলছেন চিরঞ্জিতবাবু।

সরকারি স্কুলেও এই বিশেষ প্রস্তুতির বন্দোবস্ত হয় না কেন?

সংসদ-সভানেত্রী জানাচ্ছেন, উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম ভীষণ ব্যাপ্ত। সেটা শেষ করা সময়সাপেক্ষ। তাই অতিরিক্ত ক্লাস করানোটাও বেশ সমস্যার। মধ্যবিত্ত পড়ুয়াদের অনেকে টাকা দিয়ে বাইরে থেকে ওই প্রশিক্ষণ নিতেও পারে না। ‘‘তাই আমরা আলোচনা করে দেখছি, স্কুলেই এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির বন্দোবস্ত করা যায় কি না,’’ আশ্বাস দিয়েছেন মহুয়াদেবী।

স্কুলেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছেন পাঠভবন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা রায়। তিনি বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নেই ঠিকই। তবে সব পড়ুয়ার কথা মাথায় রেখে সরকার থেকেই যদি প্রস্তুতির ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে খুবই ভাল হয়।’’ তবে যে-ভাবে ছুটির উত্সবে ক্লাসের সময় কমে আসছে, তাতে নতুন করে কিছু করা এক রকম দুরূহ বলেই অভিমত শিক্ষা শিবিরের।

স্কুলের পাঠ্যক্রম এক রকম আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার পাঠ অন্য— অনেক আগেই এই বিভেদ ঘুচিয়ে ফেলেছে সর্বভারতীয় বোর্ড। যেমন অভিনব ভারতী স্কুলের শিক্ষিকা শ্রাবণী সামন্ত জানাচ্ছেন, সিবিএসই বোর্ড সব সময়েই সর্বভারতীয় পরীক্ষার কথা ভেবে পাঠ্যক্রম তৈরি করে। তার সঙ্গে তাল মেলাতে না-পারলে অন্য বোর্ডের পড়ুয়ারা পিছিয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। ‘‘আমার মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। নইলে এ রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হতে থাকবে,’’ সতর্ক করে দিচ্ছেন শ্রাবণীদেবী।

তবে নিছক পাঠ্যক্রমের কারণেই পড়ুয়ারা পিছিয়ে রয়েছেন, এটা মানতে চাননি রাজ্য পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার। ‘‘সেরা সিলেবাস বলে কিছু হয় না। পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই সিলেবাস তৈরি হয়,’’ বলেন তিনি।

পাঠ্যক্রমের ঘাটতি পূরণ করলেই সমস্যার সুরাহা হতে পারে বলে মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু। তাঁর মতে, ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টে উচ্চ মাধ্যমিক সংসদের পড়ুয়াদের অনুজ্জ্বল ফল একটা অশনি সঙ্কেত। ‘‘অবিলম্বে সরকারের উচিত বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করা। পাঠ্যক্রমে বিন্দুমাত্র তারতম্য থাকলে সেটাও ঘোচাতে হবে। আগে তো স্কুলেই সব শেখানো হতো। কোচিং-নির্ভরতা কমাতে সরকার যদি স্কুলেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তা হলে তো ভালই হয়,’’ বলেন অশোকনাথবাবু।

সমস্যার গোড়ার কথা তুলছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব এলে ভালই। কিন্তু প্রশিক্ষণটা দেবে কে? যথাযথ ভাবে শিক্ষক নিয়োগই তো হয় না!’’ সমস্যা মেটাতে সরকার সার্বিক পরিকল্পনা না-করলে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বাংলার পড়ুয়াদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে— মন্তব্য আনন্দবাবুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal JEE
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE