কলকাতা কি মুম্বই হবে? বানভাসি হবে রাঢ়বঙ্গ?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সপার্ষদ লন্ডনযাত্রার আগে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশাসনিক কর্তাদের মাথায়। সৌজন্যে শনিবার দুপুরে নবান্নে আসা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের সতর্কবার্তা।
গত মাসে অতি ভারী বৃষ্টিতে বানভাসি হয়েছিল মুম্বই। থমকে গিয়েছিল বাণিজ্য-রাজধানীর জনজীবন। দিল্লির জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী থেকে যে সতর্কবার্তা নবান্নে এসেছে, তাতে বলা হয়েছে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গেও অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। যার পিছনে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের একটি নিম্নচাপ। হাওয়া অফিসের খবর, সেটি আরও শক্তি বাড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
হাওয়া অফিসের খবর, শুক্রবার রাতে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূলে ঘূর্ণাবর্তটি দানা বাঁধার পর থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তার জেরে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, হুগলি-সহ দক্ষিণবঙ্গের অনেক জেলাতেই বানভাসি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ দিনই বানভাসি মানুষজনের ত্রাণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যেন পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করে লন্ডন রওনা হন।’’
নবান্নের খবর, আজ, রবিবার সকালেই লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগে এমন দুর্যোগের পূর্বাভাসে এ দিন ঘনিষ্ঠ মহলে উদ্বেগও প্রকাশ করেন তিনি। এ দিন দুপুরে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের আটটি জেলার জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য স্বরাষ্ট্রসচিবকে মাথায় রেখে একটি কমিটিও গড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সরকারি সূত্রের খবর, বানভাসি পরিস্থিতি হলে কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে এ দিন দুপুরে বৈঠক করেন কলকাতা পুরসভার কর্তারাও। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিপর্যয় মোকাবিলা ও সেচ দফতরও প্রস্তুত রয়েছে। নিম্নচাপের মতিগতি বুঝতে উপগ্রহ-চিত্রে চোখ রাখছেন আবহবিজ্ঞানীরাও।
বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের জেরে কতটা বৃষ্টি হতে পারে?
আবহাওয়া দফতরের মাপকাঠি বলছে, ভারী বৃষ্টির ক্ষেত্রে ন্যূনতম মাত্রা ৬৪.৪ মিলিমিটার। অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সর্বাধিক মাত্রা ২৪৪.৪ মিলিমিটার। এ দিন নবান্নে যে বার্তা পৌঁছেছে তাতে বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বাধিক ২৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে। এমন পূর্বাভাস দেখেই চোখ কপালে উঠেছে অনেকের। হাওয়া অফিসের নথি বলছে, ১৯০৫ সালের ২৮ জুলাই কলকাতায় এক দিনে ১৮৩.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এ যাবৎকালের মধ্যে জুলাই মাসের কোনও এক দিনে সেটাই সর্বাধিক বৃষ্টিপাত। প্রশ্ন উঠেছে, এ বার কি ১১০ বছর আগের ওই রেকর্ডও ভেঙে যাবে?
আবহবিদেরা কিন্তু তেমনটা নিশ্চিত করে বলছেন না। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলছেন, সতর্কবার্তার ক্ষেত্রে একটা মাত্রা দেওয়া থাকে। কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের সতর্কতার ক্ষেত্রেও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির মাত্রা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কোন জায়গায় ঠিক কতটা বৃষ্টি হবে, তার নিশ্চিত কোনও মাপ দেওয়া সম্ভব নয়। উপগ্রহ-চিত্রে নিম্নচাপের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে আবহাওয়া দফতরের অনেকেই বলছেন, ২৪০ মিলিমিটারের মতো এতটা বেশি মাত্রায় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তবে আবহবিদ এবং কলকাতার পুরকর্তাদের অনেকেই বলছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও বানভাসি হয়ে পড়বে কলকাতা। সেচ দফতরের কর্তাদের মতে, দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে
শুক্রবার যা বৃষ্টি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলে আশঙ্কার কারণ রয়েছে। হাওয়া অফিস সূত্রের খবর, নিম্নচাপটির যা মতিগতি বোঝা যাচ্ছে, তাতে এক দিনে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু তাই নয়, নিম্নচাপটি সহজে দুর্বল হবে না বলেও আবহবিদদের পূর্বাভাস। কেন?
আবহাওয়া দফতর বলছে, নিম্নচাপ হওয়ার পরে সেটি সাধারণত স্থলভূমির দিকে এগিয়ে আসে। স্থলভূমিতে ঢোকার পরে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে সেটি। কিন্তু এই নিম্নচাপটি বঙ্গোপসাগরেই দাঁড়িয়ে থাকবে। খুব বেশি নড়াচড়া করবে না। এর কারণ হিসেবে আলিপুর হাওয়া অফিসের ব্যাখ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের উপরে একটি নিম্নচাপ রয়েছে। সেখান থেকে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। অর্থাৎ অক্ষরেখার এক দিকে পশ্চিম ভারতের নিম্নচাপ, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ। এক আবহবিদের কথায়, ‘‘সাধারণত অক্ষরেখার এক দিকে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণাবর্ত থাকে। তার ফলেই সেটি অক্ষরেখা বরাবর সরতে থাকে। এ ক্ষেত্রে দু’দিকে দু’টি থাকায় নিম্নচাপটি নড়াচড়া করতে পারবে না।’’ তাঁর মতে, নিম্নচাপটি যত ক্ষণ সাগরে থাকবে, ততই তাঁর শক্তি বাড়বে। যত শক্তি বাড়বে, ততই বৃষ্টি হবে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে।
এই পূর্বাভাসই আরও চিন্তা বাড়িয়েছে পুরসভা ও প্রশাসনিক কর্তাদের। তাঁরা বলছেন, গত ১৫ দিন ধরে দক্ষিণ শহরতলির যে সব বাসিন্দা হাঁটুজল পেরিয়ে যাতায়াত করছেন, তাঁদের কাছে এটা তো দুঃসংবাদ বটেই। খাস মহানগরের অনেক এলাকাই ফের জলমগ্ন হতে পারে। হাওয়া অফিসের খবর, শুক্রবার রাত থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত কলকাতায় ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তাতেই উত্তর ও মধ্য কলকাতা-সহ বেশ কিছু জায়গায় অল্পবিস্তর জল জমেছে। জল জমেছে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভেও।
নবান্ন সূত্রের খবর, উপকূলীয় এলাকা-সহ দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবারের বৃষ্টির জেরে লাভপুর থেকে হাজার পাঁচেক বাসিন্দাকে নিরাপদ জায়গায় সরানো হয়েছে। সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক এলাকায় দফতরের অফিসারদের থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, প্রতিটি পাম্পিং স্টেশনে রাতে এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়াররা হাজির থাকবেন। উপকূলরক্ষী বাহিনীর মুখপাত্র অ্যাসিস্ট্যান্ট কম্যান্ডান্ট অভিনন্দন মিত্র জানান, মৎস্যজীবীদের সাগরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বিপদে পড়লে ‘১৫৫৪’ নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে।
শুক্রবার রাত থেকে বৃষ্টির জেরে বেহাল হয়ে পড়েছে মুর্শিদাবাদের সূতির বেশ কয়েকটি গ্রাম। ত্রাণ নিয়ে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা। সূতি-১ ব্লকের বিডিও দীপঙ্কর রায় জানান, জেলা প্রশাসনের কাছে ত্রাণের আবেদন জানিয়ে শুধু ত্রিপল মিলেছে।
জলমগ্ন পাড়ুই, সাত্তোরের বহু গ্রাম। সাঁইথিয়া, মহম্মদবাজার ও ইলামবাজার ব্লকেও একই চিত্র। ভেঙে পড়েছে প্রচুর বাড়ি। শনিবার সাঁইথিয়ার বিডিও অতনু ঝুরি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্লকে ৫০০-র বেশি বাড়ি পড়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পাড়ুইয়ের বুধরা গ্রাম। ২০-২২টি গ্রামে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বর্ধমানের খণ্ডঘোষ, গুসকরা, পশ্চিম ভাতার, কালনা, মন্তেশ্বরের কিছু এলাকা এবং পূর্বস্থলীর নাদনঘাট এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষের জমি জলের তলায় চলে গিয়েছে। শনিবার সকালে টানা বৃষ্টির জেরে হুগলির কোন্নগর, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটি, চুঁচুড়া, পাণ্ডুয়া-সহ বেশ কয়েকটি এলাকাও জলমগ্ন। জল জমেছে নবদ্বীপ পুরসভার বেশ কিছু ওয়ার্ডও।
বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে শনিবার পাঁচ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়া শুরু হয়েছে। রানিবাঁধ ও খাতড়ার মধ্যে কেচোন্দাঘাটের কজওয়ে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। তুমুল বৃষ্টিতে বিষ্ণুপুর শহরের কয়েকটি নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy