Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নেতার রোষে রাতভর থানায় আটক ফেসবুক-প্রতিবাদী

চার বছরেও বদলায়নি ট্র্যাডিশন। বুঝিয়ে দিল সেই ইন্টারনেটই! মুখ্যমন্ত্রী ও দুই তৃণমূল সাংসদকে ঘিরে তৈরি একটি ব্যঙ্গচিত্র ই-মেলে ফরোয়ার্ড করে রাতারাতি গ্রেফতার হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র। সেটা ছিল ২০১২।

তৃণমূল নেতা পুলিন গোলদার, যাঁর বিরুদ্ধে এই পোস্ট বলে দাবি।

তৃণমূল নেতা পুলিন গোলদার, যাঁর বিরুদ্ধে এই পোস্ট বলে দাবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৫
Share: Save:

চার বছরেও বদলায়নি ট্র্যাডিশন। বুঝিয়ে দিল সেই ইন্টারনেটই!

মুখ্যমন্ত্রী ও দুই তৃণমূল সাংসদকে ঘিরে তৈরি একটি ব্যঙ্গচিত্র ই-মেলে ফরোয়ার্ড করে রাতারাতি গ্রেফতার হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র। সেটা ছিল ২০১২। বিধানসভা ভোটের দোরগোড়ায় ফের প্রায় একই ঘটনা দেখল মালবাজার। এ বার পুলিশ তুলে নিয়ে গেল ডুয়ার্সের যুবক রোহিত পাশিকে। একটি ফেসবুক পোস্টে রোহিত তাঁর সম্মানহানি করেছেন বলে গত শুক্রবার থানায় অভিযোগ করেছিলেন মালবাজারেরই দাপুটে তৃণমূল নেতা পুলিন গোলদার। রোহিতের অভিযোগ, এর পরেই মালবাজার থানার পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে এক ঘণ্টা লকআপে আটকে রাখে। তার পর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলার পরে সারারাত তাঁকে থানার এক কোণে বসিয়ে রাখা হয়।

এই অভিযোগ অবশ্য মানতে চায়নি মালবাজার থানা। অফিসারদের দাবি, লক-আপের বাইরেই বসিয়ে রাখা হয়েছিল রোহিতকে। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার আকাশ মেঘারিয়া বলেন, ‘‘রোহিত পাশিকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। আইন-শৃঙ্খলার সমস্যার আশঙ্কায় তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ।’’ পুলিশ সুপার জানান, প্রাথমিক তদন্তের পর এ দিন রোহিতকে মহকুমা আদালতে তোলা হয়। সেখানে ১০৭ ধারায় ব্যক্তিগত মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ আগামী ছ’মাস রোহিত যে এলাকায় কোনও রকম ‘বিশৃঙ্খলা’ ছড়াবেন না, সেই কথাই লিখিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে দিয়ে। কিন্তু কীসের ‘বিশৃঙ্খলা’? পুলিশের একাংশের বক্তব্য, লিখিত অভিযোগে ‘আইন-শৃঙ্খলার’ অবনতিরই আশঙ্কা করেছিলেন পুলিন। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলও রোহিতের ওই পোস্টকে প্ররোচনামূলক বলে মনে করছে।

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বরের এক ঘটনা ঘিরে জটিলতার শুরু। সে দিন মালবাজারের মহকুমা শাসকের দফতরের সামনে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে একটি মোটরবাইক ও স্কুটির সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে গুরুতর জখম হন রোহিতের বন্ধু ফ্লোরা গুরদীপ সিংহ (৪০)। স্কুটিতে ছিলেন মালবাজারের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অভিজিৎ বণিক এবং তাঁর বোন মাশমি। আর ছিল অভিজিৎদের পোষা স্পিৎজ কুকুরটিও। অভিযোগ, দুর্ঘটনার পরে সোজা মালবাজার মহকুমা হাসপাতালে ঢুকে গুরদীপের উপরে চড়াও হন অভিজিৎ। তাঁর কুকুরটির কেন খোঁজ মিলছে না, এই নিয়ে বচসা শুরু করে তিনি আহত গুরদীপের মাথায় হেলমেট দিয়ে আঘাত করেন।

সেই দিনই অভিজিতের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন গুরদীপের স্ত্রী ফ্লোরা রোজি সিংহ। ৩১ ডিসেম্বর শিলিগুড়ির নার্সিংহোমে মারা যান গুরদীপ। ১ জানুয়ারি পুলিশ অভিজিৎকে গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধে ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলাও হয়। তখন থেকেই গুরদীপের জন্য ‘সুবিচার’ চেয়ে ফেসবুকে সরব হন রোহিত। গত শুক্রবার সেই মামলারই শুনানি ছিল জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে। কোর্টে গিয়েছিলেন রোহিত। তার পরেই ওই ফেসবুক পোস্ট। যাতে রোহিত দাবি করেন, অভিযুক্তের বাবা-মাকে নিজের গাড়িতে কোর্টে এনেছিলেন মালবাজারের ‘এক নেতা’। রোহিতের কথায়, ‘নেতা কী, অভিনেতা বললেও হবে, যে ভাল বাঁশি বাজাতে জানে, যে ভাল গাইতে পারে আবার ঘনঘন দলবদলও করতে পারে। যে মারা গেল তার বাড়িতে গিয়ে একটু সহানুভূতি দেখাতে গেল না আর আসামিকে বাঁচানোর জন্যে জলপাইগুড়ি কোর্টে ছোটাছুটি করছে। এটা সমাজের লজ্জা।’

কোথাও পুলিনের নাম নেই। তবে কেন থানায় গেলেন? পুলিনের বক্তব্য, ‘‘সকলেই জানে, আমিই মালবাজারের একমাত্র নেতা যে বাঁশি ও গান দুটোই জানে। আমিই গত শুক্রবার মালবাজারের একমাত্র নেতা হিসেবে জলপাইগুড়ির আদালতে ছিলাম। তবে পুরনো একটি সড়ক অবরোধের মামলায় জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম।’ অভিযুক্তের বাবা-মাকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন পুলিন। তবে মেনে নিয়েছেন, অভিজিতের বাবা-মা তাঁর মুখচেনা।

রোহিতের ঘটনায় তৃণমূলের অন্দরেও জলঘোলা শুরু হয়েছে। কারণ পুলিন যেমন মালবাজারের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর এবং তৃণমূলের চা শ্রমিক সংগঠন ‘তরাই ডুয়ার্স প্লানটেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর সাধারণ সম্পাদক, তেমনই রোহিতের দাদা রাজু পাশি মালবাজারের ওয়ার্ড কমিটির সদস্য এবং যুব তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। আর রোহিত বলেছেন, ‘‘আমি ছাত্রাবস্থায় মালবাজার পরিমল মিত্র স্মৃতি কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের হয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম।’’

পুলিনের অবশ্য দাবি, রোহিত সিপিএম করেন। মালবাজারের টাউন তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি মানসকান্তি সরকার, পুরসভার চেয়ারম্যান স্বপন সাহা— সকলেই অবশ্য মনে করেন, দলকে কালিমালিপ্ত করার উদ্দেশ্যেই পুলিনের নাম না করে ফেসবুকে ‘অপমানজনক’ কথা লেখা হয়েছে। তবে মালবাজার প্রাক্তন ব্লক তৃণমূল সভাপতি শুভাশিস ঘোষ বলেছেন, ‘‘এটা ঘরোয়া স্তরেই মিটিয়ে নিলে ভাল হতো।’’ মালবাজার থানা সূত্রও বলছে, সাম্প্রতিক অতীতে এলাকায় সাইবার সংক্রান্ত অধিকাংশ অভিযোগেরই সরাসরি মহকুমা আদালতে মিটমাট হয়ে গিয়েছে। অভিযুক্তকে সারারাত থানায় বসিয়ে রাখার মতো ঘটনা কিন্তু দেখা যায়নি।

এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যে্রার বিরুদ্ধে উঠেছে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র টুইটারে লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারী মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুলে রোহিত গ্রেফতার হলেন। সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে!’ আর অম্বিকেশের কথায়, ‘‘আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুলিশমন্ত্রীও বটে। তিনি নিজেই অসহিষ্ণু এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ। সেই কারণে তাঁর দলের সকলে এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।’’ যদিও এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘কিছু স্থানীয় চ্যানেল খবর যাচাই না করেই তাকে বিকৃত করছে। এটা কি ইচ্ছাকৃত? মালবাজারে ফেসবুক পোস্টের জন্য কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE