Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

গণপতি এ বছর আমাকে ছপ্পড় ফাড়কে দিয়েছেন

ড্রাইভার? হাওয়া। মধ্যরাতে অটো চেপেই দেব চললেন মুম্বইয়ের পার্টিতে। সাক্ষী থাকলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।রাত আড়াইটে। মায়ানগরী মুম্বই তখনও ঘুমোয়নি। হঠাত্‌ আন্ধেরী ওয়েস্ট-য়ের এক রেস্তোরাঁর সামনে একটা অটো থেকে নামলেন দেব! দেখে মনে হল যেন স্নান করে এসেছেন। কালো শার্টটা সপসপে ভিজে। তার একটু আগেই শেষ হয়েছে ‘বুনো হাঁস’য়ের মুম্বই প্রিমিয়ার।

দেব

দেব

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

রাত আড়াইটে। মায়ানগরী মুম্বই তখনও ঘুমোয়নি। হঠাত্‌ আন্ধেরী ওয়েস্ট-য়ের এক রেস্তোরাঁর সামনে একটা অটো থেকে নামলেন দেব! দেখে মনে হল যেন স্নান করে এসেছেন। কালো শার্টটা সপসপে ভিজে। তার একটু আগেই শেষ হয়েছে ‘বুনো হাঁস’য়ের মুম্বই প্রিমিয়ার।

শো শেষ করে মাল্টিপ্লেক্স থেকে গাড়ি করে গিয়েছিলেন হোটেলে। কিছুক্ষণ পর হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন গাড়ির চালক বিধ্বস্ত। দেড় দিনের গণেশ ঠাকুরের বিসর্জন শেষ হয়েছে শনিবার। বিসর্জনের উল্লাসে কাহিল গাড়িচালকের তখন আর স্টিয়ারিংয়ে বসার ক্ষমতা নেই। অগত্যা অটো! আর সে অটো ডাকতে গিয়েই মুম্বইয়ের রাস্তায় ভিজলেন তিনি।

রাতের অন্ধকারে অটোচালক কি বুঝেছিলেন যে তাঁর যাত্রী এক নব-নির্বাচিত সাংসদ? যাঁর জনপ্রিয়তায় পশ্চিমবঙ্গে নিমেষের মধ্যে ট্র্যাফিক থমকে দাঁড়ায়? আর তিনি কিনা মুম্বইতে নিরাপত্তারক্ষী বাদ দিয়ে অটো চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!

দেবের জন্ম মুম্বই শহরে। বড় হওয়া এখানেই। “এক সময় এই হলে বসে রবি কিনাগির সঙ্গে ‘শিবাজি’ দেখেছিলাম। রবিজি তখন বলেছিলেন, ‘চাপ নিস না। একদিন তোরও এই একই হলে প্রিমিয়ার হবে।’ আজ হলে জায়গা নেই বলে শ’খানেক লোক ফিরে গিয়েছে। কিছু দর্শক মাটিতেও বসে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে, সিঁড়িতে বসে ছবিটা দেখেছি...” বলে চলেন দেব। চোখদুটো চকচক করে ওঠে। পর্দায় তখন ভেসে যায় বনির গলায় ‘জিন্দেগি কহিঁ ভি থামতি নহি...’।

‘দবাং’, ‘বেশরম’ ছবির পরিচালক অভিনব কশ্যপ। রিলায়্যান্স এন্টারটেনমেন্টের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার শিবাশিস সরকার তাঁর বন্ধু। অভিনব দেখতে এসেছিলেন ‘বুনো হাঁস’। রিক্লাইনিং চেয়ারে পা তুলে বসে একমুঠো পপকর্ন হাতে নিয়ে বললেন, “যদি সাবটাইটেলটা না বুঝতে পারি, তা হলে আপনাকে জিজ্ঞেস করব। কলকাতাতে মণিরত্নমের ‘যুবা’ শ্যুটিংয়ের সময় কাজে এসেছিলাম। শহরটাকে আবার পর্দায় দেখতে ভাল লাগছে,” বলেন অভিনব।

না, সাবটাইটেল বুঝতে অসুবিধে হয়নি পরিচালকের। মাঝে শুধু একটাই প্রশ্ন। অমলের বৌদি, অর্থাত্‌ সুদীপ্তাকে নিয়ে। “হোয়াট ইজ দ্য নেম অব দ্য অ্যাকট্রেস? সু...দী...প্তা? খুব ভাল কাজ করেছে...”। প্রিমিয়ার শেষে সুদীপ্তাকে আলাদা করে ডেকে অভিনন্দনও জানান তিনি।

অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী, শান্তনু মৈত্র, তনুশ্রী। প্রিমিয়ারে

ও দিকে ‘এক হসিনা থি’, ‘জনি গদ্দার’, ‘এজেন্ট বিনোদ’য়ের পরিচালক শ্রীরাম রাঘবনও উপস্থিত। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি আর বরুণ ধবনকে নিয়ে সবে শেষ করেছেন ‘বদলাপুর’য়ের শ্যুটিং। ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’য়ের লেখক বিকাশ স্বরূপের ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল অ্যাপ্রেন্টিস’য়ের ভিত্তিতে তৈরি করবেন তাঁর পরের ছবি। হিন্দিতে থ্রিলার তৈরির মাস্টার শ্রীরাম। ছবি শেষে দেবকে বললেন, “জানতাম না যে বাংলাতে এ ধরনের থ্রিলার তৈরি হয়!”

প্রিমিয়ার শেষে আরও একজন পরিচালকের সঙ্গে দেখা। প্রদীপ সরকার। ‘মর্দানি’র সাফল্য নিয়ে চারদিকে আলোচনা। হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা বড় একটা দেখা হয় না। কেমন লেগেছে জানতে চাইতে বললেন, “ভাল।” তার পর কথা উঠল ‘মর্দানি’ প্রসঙ্গে। ‘বুনো হাঁস’য়ের প্রিমিয়ারে তিনি উপস্থিত। কিন্তু ‘মর্দানি’র প্রচারে প্রায়-অদৃশ্য কেন? “ছবিটা ভাল করছে। এটাই তো দরকার,” হেসে বললেন তিনি। এই যে বলা হচ্ছে ‘মর্দানি’তে প্রদীপ সরকারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? “এ রকম বলা হলে কী বলব বলুন তো? সব সময় এক রকমের ছবি বানিয়ে যেতে হবে নাকি?”

একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন ‘কহানি’র চিত্রগ্রাহক সেতু। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ‘চতুষ্কোণ’য়ের চিত্রগ্রাহক সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। কোঁচা দিয়ে ধুতি পরে এসেছিলেন প্রিমিয়ারে। ছবি দেখে খুশি। কিন্তু ছবির শেষেই দে-ছুট বলে চললেন বাড়ির দিকে। কাকভোরে প্লেন ধরে উড়ে যেতে হবে দিল্লি। সেখানে শ্যুটিং করবেন অক্ষয়কুমারের সঙ্গে।

হলিউড ছবি ‘আ মিলিয়ন ডলার আর্ম’য়ের অভিনেতা পীতবাস এসেছিলেন। আর ছিলেন সুব্রত দত্ত। “আজকাল মুম্বইতে ফিল্ম প্রিমিয়ার করার রেওয়াজটাই চলে গিয়েছে। ভাল লাগছে এ রকম আয়োজন দেখে,” বললেন জিত্‌ গঙ্গোপাধ্যায়। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অভিজিত্‌, মোনালি ঠাকুর। “দেব যেহেতু আমাকে পার্সোনালি এই ছবিটা দেখতে আসার অনুরোধ করেছিল, তাই গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কুড়ি মিনিট থেকে চলে যাব। কিন্তু শেষে গোটা ছবিটা দেখলাম। আমার বৌ অবাঙালি। এটাই ওর দেখা প্রথম বাংলা ছবি,” বলেন অভিজিত্‌।

প্রিমিয়ার শেষে তনুশ্রী খুব নস্টালজিক। বললেন, “মডেলিং করার সময় প্রদীপ সরকারের জন্য অনেক বার অডিশন দিয়েছি। আজ ওঁর পাশে বসে আমার অভিনীত ছবি দেখলাম। ওঁকে সেটা বললাম। উনি বললেন ছবিটা পছন্দ হয়েছে। এটা আমার বড় প্রাপ্তি। তবে আফটার-পার্টিতে যাব না। গণেশ চতুর্থীর সময় মুম্বইতে আছি। লালবাগ যাব।”

আফটার-পার্টিতে আড্ডা আরও জমে ওঠে। অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের রেস্তোরাঁয় একের পর এক চীনে খাবার পরিবেশিত হচ্ছে। স্পিন্যাচ দিয়ে স্টার্টার থেকে শুরু করে প্রন-চিকেনের বাহারি খাবার কী নেই! স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই অনিরুদ্ধ বললেন, “মাছটা একটু হাত খুলে দিন!” অমনি সবার অট্টহাসি। শান্তনু মৈত্র শুরু করলেন ভোজনরসিক পরিচালকের গল্প। “ওয়ার্ল্ডকাপের সময় ব্রাজিলে গিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম। একদিন আমি রান্না করছি। বাইরে দেখি টোনি (অনিরুদ্ধ) আরও দু’জন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে হেলথ্‌ফুড নিয়ে আলোচনা করছে! আমি তাজ্জব। যে টোনি মারাকানা স্টেডিয়ামে ঢুকেই প্রথমে বলে হটডগ কিনব, সে হেল্থফুড নিয়ে আলোচনা করছে!” বলেই হেসে ফেললেন শান্তনু।

সারাদিন অমিতাভ বচ্চন আর দীপিকা পাড়ুকোনকে নিয়ে সুজিত সরকার ‘পিকু’র শ্যুটিং করেছেন মাধ আইল্যান্ডে। শ্যুটিং সেরেও ছবির প্রিমিয়ারে এসেছিলেন। চোখ লাল হয়ে এসেছে। তবু আড্ডা দেওয়া নিয়ে নো কম্প্রোমাইজ। শুরু হল কলকাতা নিয়ে নানা ধরনের মজার গল্প। “সল্টলেকে আকছার হয় যে আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর দূর থেকে একজন এসে বললেন: ‘ঠিক চিনতে পেরেছি। সুজয় ঘোষ, না?’ আমি বলি, ‘না’। তার পর আবার গেসওয়াকর্। ‘দাঁড়ান, আপনি তো মশাই প্রদীপ সরকার।’ তখনও আমি মাথা নাড়াই। সেখানেও থামে না। দিবাকর, অনুরাগ সবার নাম বলে। কিন্তু আমার নামটাই বলে না। তবু কথা বলা চাই!” হাসতে হাসতে বলেন সুজিত।

শান্তনু সঙ্গে সঙ্গে শুরু করেন আরও একটা গল্প। “এক বার কলকাতা এয়ারপোর্টে একজন এসে অটোগ্রাফ চাইছেন। আমি কলম দিয়ে সবে ‘এস’ লিখব। অমনি শুনলাম ‘আপনার ‘যব উই মেট’টা দারুণ লেগেছে!’ আমি বললাম, ‘ওটায় আমি সুর করিনি।’ তার পরের প্রশ্ন, ‘আপনি প্রীতম নন?’”

ইতিমধ্যে মেনকোর্স এসে গিয়েছে। না চিনতে পারার অভিজ্ঞতা অনিরুদ্ধরও কম নেই। একবার দেবকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছেন তিনি। “দেবকে সবাই চেনে। কিন্তু আমার মুখ অচেনা। আমি সেটা বুঝতে পেরে ভাবলাম একটু মজা করি। স্টেজে তখন ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘এ বার আপনাদের সামনে আসছেন পরিচালক...’। বলতে বলতে আটকে গেলেন অ্যাঙ্কর। আমি পাশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু অ্যাঙ্কর আমাকে চিনতে পারছেন না। ব্যাকুল হয়ে খুঁজতে শুরু করেন একজনকে যিনি আমাকে আইডেনটিফাই করে দেবেন!”

একের পর এক গল্প চলতেই থাকে। এক বার অনিরুদ্ধ পার্টিতে গিয়েছিলেন তাঁর দুই সেলিব্রিটি বন্ধুকে নিয়ে। “ঠিক হয়েছিল সবাই গান গাইবেন। যে যার মতো বেসুরো গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে চলেছি। শেষে গান ধরলেন এক অভিনেত্রী। তা শুনে এক ফ্যান এসে বলেন: ‘সবই কি মিথ্যে? ছবিতে দেখি আপনি এত ভাল গান। কিন্তু আজ শুনে বুঝলাম সবই মায়া!’।”

অনিরুদ্ধর গল্প শুনে শান্তনুর মনে পড়ে ‘লগে রহো মুন্নাভাই’য়ের প্রিমিয়ারের কথা। সেই সময় নাকি প্রিমিয়ারের পর এই রেস্তোরাঁয় বিদ্যা বালন এসে টেবিলের ওপর নেচেছিলেন আনন্দে। “আমার তো সঞ্জু নেই। বিদ্যাও নেই। তবে আমরাও হুল্লোড় করি,” হেসে বললেন অনিরুদ্ধ। তার পর মোবাইল থেকে দেখালেন বিদ্যা, রাজু হিরানির পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তা। বরকে নিয়ে লং উইকএন্ড কাটাতে মুম্বইয়ের বাইরে গিয়েছেন বিদ্যা। শহরে ফিরেই ছবিটা দেখবেন। রাজু ব্যস্ত ‘পিকে’র কিছু প্যাচওয়ার্ক নিয়ে। তাই অনুপস্থিত। সব থেকে মজার ইমেল এসেছিল বিধু বিনোদ চোপড়ার কাছ থেকে। ট্রেলর দেখে ‘জাদু কা ঝাপ্পি’ দেবেন বলেছেন পরিচালককে।

ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ২.৩০ ছুঁইছুঁই। ইতিমধ্যে অটো চেপে হাজির দেব-যিশু। এ বার মুম্বই সফরে দেবের সবথেকে বড় পাওনা কী? “ছবিটা মুম্বইতে হাউসফুল হচ্ছে। দিল্লি আর বেঙ্গালুরুতেও খুব ভাল রেসপন্স। দর্শক আমাকে এ বার অভিনেতা হিসেবে গ্রহণ করল। নন-অ্যাক্টর স্ট্যাম্পটা চলে গেল। লোক ক্যালকুলেটেড রিস্ক নেয়। আমি তা করিনি। এ ছবিতে আমার বিপরীতে বাঘা-বাঘা অভিনেতা। তবু দর্শকের আমার কাজ ভাল লেগেছে।”

গলার স্বর ভিজে আসে আবেগে। তারপর বলেন, “গত ১৭ বছর ধরে মুম্বইয়ের বাড়িতে আমরা গণেশ পুজো করতাম। একটা মানত ছিল। এ বছর বাড়িতে পুজো হয়নি। ক্লাবে হয়েছে। তবে অটোতে আসতে আসতে ভাবছিলাম গণপতি আমাকে এ বছর ছপ্পড় ফাড়কে দিয়েছেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mumbai party dev priyanka dasgupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE