Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বড় বড় ছেলেগুলো এ বার রাতেই খেলবে

গোলাপি বল। রাতের আলো। অফিস ফেরত জনতা। আর পাঁচটা স্লিপ। অ্যাডিলেডে টেস্ট ক্রিকেটের নতুন ‘অবতার’ দেখে এলেন দিলীপ প্রেমচন্দ্রনগোলাপি বল। রাতের আলো। অফিস ফেরত জনতা। আর পাঁচটা স্লিপ। অ্যাডিলেডে টেস্ট ক্রিকেটের নতুন ‘অবতার’ দেখে এলেন দিলীপ প্রেমচন্দ্রন

বড় বড় ছেলেগুলো এ বার রাতেই খেলবে

বড় বড় ছেলেগুলো এ বার রাতেই খেলবে

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৫১
Share: Save:

মাঠটা সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড। তারিখ ২৭ নভেম্বর, ১৯৭৯। আপাতদৃষ্টিতে আর একটা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। এক দিকে গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়া। অন্য দিকে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

কিন্তু সে আর নতুন কী! এ রকম তো কত ম্যাচেই এই দু’টো টিম খেলেছে। তা হলে বিশেষত্বটা কী? দিনটা স্পেশাল একটাই কারণে। ওই দিন থেকেই ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসটা যেন ক্রিকেট দেবতা অন্য ভাবে লেখা শুরু করলেন। সেটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম ডে-নাইট একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ।

সে দিন চ্যাপেলের নিজের করা ৭৪ রানের সৌজন্যে পাঁচ উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারায় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু কী আশ্চর্য! ঐতিহাসিক ওই ঘটনাটা উইজডেন-এর বিখ্যাত ক্রিকেট আলম্যানাকে দু’লাইনের বেশি জায়গা পায়নি।

কাট টু ২০১৫। সেই ম্যাচের ঠিক ৩৬ বছর পর আবার করে ক্রিকেট দেবতা যেন তাঁর পুরনো খাতাটা বের করলেন নতুন কিছু লেখার জন্য। যে খেলা নিয়ে এমনিতেই সাঙ্ঘাতিক গোঁড়ামি, যে খেলায় নতুন নিয়ম মানেই নাক সিঁটকানো — সেই খেলাটায় কি না এ রকম একটা ঘটনা ঘটে গেল! অ্যাডিলেড ওভালের নতুন করে বানানো মাঠে গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ খেলে ফেলল।

অনেকের ভয় ছিল, অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন হবে এই ‘এক্সপেরিমেন্ট’? যাঁদের এ রকম আশঙ্কা, তাঁদের সসম্মানে জানাচ্ছি, সে দিন খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বস্তাপচা সব ধারণা কিন্তু অ্যাডিলেডের ‘পিঙ্ক’ সানসেটের সঙ্গেই ডুবে গিয়েছিল।


সেই বিখ্যাত টি-শার্ট পরে ইমরান খান

ততক্ষণে মাঠে হাজির ৪৭,৪৪১ জন দর্শক সাদা পোশাক আর গোলাপি বলের টেস্ট ম্যাচে বিভোর। তৃতীয় দিন খেলা শেষ হওয়ার পর জেনেছিলাম এক লক্ষ তেইশ হাজার সাতশ’ চল্লিশজন খেলা দেখতে এসেছিলেন অ্যাডিলেডের ওভালে।

কিন্তু আসল ঘটনাটা বোধ হয় ঘটেছিল তার দিন দু’য়েক আগে, যখন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া আনুষ্ঠানিক ভাবে জানায়, সত্তর দশকের কেরি প্যাকারের সেই সিরিজের সব পরিসংখ্যান এ বার থেকে ‘অফিশিয়াল’ হল।

যে সিরিজ ক্রিকেটটাই বদলে দিয়েছিল, যে সিরিজ গ্রেগ চ্যাপেলের মতো অনেকের কাছেই ছিল ‘টাফেস্ট’, সেই সিরিজের সব পরিসংখ্যান এত বছর ছিল আনঅফিশিয়াল। এত দিনে সেই সিরিজের পরিসংখ্যানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল ক্রিকেট বিশ্ব।

নিঃসন্দেহে গ্রেগ চ্যাপেলের মতো অনেকের কাছে এটা দারুণ ভাল খবর। তবে চ্যাপেলের থেকেও বেশি খুশি হওয়ার কথা বোধহয় ব্যারি রিচার্ডসের। এত বছর ব্যারি রিচার্ডসের নামের পাশে লেখা থাকত ‘প্লেড ফোর অফিশিয়াল টেস্ট ম্যাচেস’। এই ঘোষণার পর সেটার সঙ্গে যোগ হবে, প্যাকার সিরিজের পাঁচটা সুপার টেস্ট। যে সিরিজে ব্যারি করেছিল দুর্ধর্ষ ৫৬৫ রান।


প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ

আজকে ভাবলে মনে হয়, কী সাহসের সঙ্গেই না ক্রিকেট বিশ্বের টুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন মিস্টার প্যাকার। শুধুই রঙিন জামা আর সাদা বল নয় কিন্তু, ক্রিকেটকে নিয়ে যে ওই মাত্রায় মার্কেটিং করা যায়, সেটাও প্রথম দেখিয়েছিলেন প্যাকার। আর এই বিপণনের আইকনিক ছবিটা বোধহয় ছিল ইমরান খানের। আজও অরিজিনাল কিং খান-এর টি-শার্টে লেখা ‘বিগ বয়েজ প্লে অ্যাট নাইট’ — কোনও ক্রিকেটপ্রেমী ভুলতেই পারেনি।

অ্যাডিলেডে ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ শুরু হওয়ার তিন দিন আগে থেকেই কিন্তু পুরো অস্টেলিয়া জুড়ে হইচই ছিল মাত্রাছাড়া। ম্যাচের তিন দিন আগেই ‘ফোটো অপ’‌য়ের জন্য সত্তর বছরের ব্যারি রিচার্ডস নামলেন ব্যাট হাতে। অন্য দিকে বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় ফাস্ট বোলার লেনি প্যাস্কো। চারদিকে তখন শুধুই ওয়ার্ল্ড সিরিজের নস্টালজিয়া।

‘‘কী মনে হয়, ভারতে শুরু হবে এ রকম ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচ?’’ হঠাৎ করে একদিন ডিনার খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন ডিন জোন্স। তারপর নিজেই যোগ করলেন, ‘‘যদি ডিউ ফ্যাক্টরটা ম্যানেজ করা যায়, তা হলে দিল্লির মতো জায়গায় করাই যায় এ রকম টেস্ট ম্যাচ।’’

অন্য দিকে, গ্লেন ম্যাকগ্রা
তখন বলছেন তিনি কতটা হতচকিত হয়ে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচের এই পাগলামি দেখে। ‘‘ইন্ডিয়া খেলছে না। ইংল্যান্ডও না। তাও পুরো অস্ট্রেলিয়া যেন
গমগম করছে। ফ্যাসিনেটিং,’’ বলে ওঠেন ম্যাকগ্রা।

তবে অ্যাডিলেডের এই প্রথম দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচটা কিন্তু ওই ম্যাচে খেলা ব্যাটসম্যানরা বহু দিন মনে না-ও রাখতে পারেন। একে পিচে ঘাস (আট মিলিমিটার লম্বা), তারপর লাইটের নীচে ও রকম সুইং!

তবে ম্যাচটার হাইলাইটটা ছিল বোধহয় ডিআরএস নিয়ে নাথান লায়ানের আউট নিয়ে থার্ড আম্পায়ার নাইজেল লংয়ের ভুল সিদ্ধান্ত। সে দিন খেলার শেষে প্রেস কনফারেন্সে নিউজিল্যান্ডের রস টেলরকে প্রশ্ন করা হয়, ভুল সিদ্ধান্তের পর নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাকালামের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? প্রশ্ন শুনে থার্ড আম্পায়ারকে তুলোধোনা করেন টেলর। খোলাখুলি সব কিছু বলে মিডিয়া ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আমার ম্যাচ ফি এখনও কাটা হয়নি তো?’’

তবে খেলার পর মাঠের সব তিক্ততা যেন মাঠেই ফেলে এসেছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাকালাম। দিনের শেষের আড্ডায় তাঁর কথায় শুধুই আগামী দিনের ভবিষ্যদ্বাণী।

‘‘এটা দুর্দান্ত কনসেপ্ট। একটা জিনিস পরিষ্কার, যত দিন যাবে ডে-নাইট টেস্ট ম্যাচের পিচে কোনও মতেই বেশি ঘাস রাখা ঠিক হবে না। লোকে রাতে বাড়ি ফিরে টেস্ট ম্যাচ দেখতে চায়। এত দিন যে ভাবে টেস্ট ম্যাচ হয়েছে সেই ধ্যানধারণা পাল্টাতে হবে। সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে কিন্তু চলবে না,’’ বলেন ব্রেন্ডন।

চার দশক আগে বিশ্ব ক্রিকেটকে একাই নাড়িয়ে দিয়েছিলেন কেরি প্যাকার। তাঁর দেশেই আবার শুরু হল ‘পিঙ্ক বল’ টেস্ট ম্যাচ।

পৃথিবীর সব দেশে অবশ্যই সম্ভব হবে না এই দিন-রাতের টেস্ট। কিন্তু একটা কথা এখনই জলের মতো পরিষ্কার: একটা প্রজন্ম এ বার অন্তত টেস্ট ম্যাচ দেখতে দেখতে বলতে পারবে, ‘‘সত্যি, বিগ বয়েজ প্লে অ্যাট নাইট।’’

(লেখক উইজডেন ইন্ডিয়ার এডিটর-ইন-চিফ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE