Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সমুদ্র উজিয়ে যদিদং হৃদয়ং

পাটায়ার রিসর্টে বিয়ের ভোজ। বা কেরলের ব্যাকওয়াটারে সাত পাক। বাঙালির ছাদনাতলায় এবার ডেস্টিনেশন ওয়েডিং। লিখছেন সুচন্দ্রা ঘটকনীল আর পারোর বিয়ে। সাত দিনের ছুটি চাই ডিসেম্বরে। যেতে হবে মরিশাস। সেকী? বর-কনের সঙ্গে মাসি-পিসিও হানিমুনে যাবেন নাকি? একেই তো তারা থাকে দু’জনে দু’দেশে। কী সেকেলে কাণ্ড রে বাবা!

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

নীল আর পারোর বিয়ে। সাত দিনের ছুটি চাই ডিসেম্বরে। যেতে হবে মরিশাস।

সেকী? বর-কনের সঙ্গে মাসি-পিসিও হানিমুনে যাবেন নাকি? একেই তো তারা থাকে দু’জনে দু’দেশে। কী সেকেলে কাণ্ড রে বাবা!

সে যা-ই হোক, বিয়ের পরে তবে মরিশাস?

ধুর ধুর, বিয়ের পরে আবার কী? এ প্রশ্ন তো ক্লিশে। আরে, জিজ্ঞেস করুন বিয়েটা কোথায়?

আমহার্স্ট স্ট্রিটের মেয়ে পারমিতা আর কসবার ছেলে (আপাতত বার্লিনবাসী) নীলের বিয়েটাই যে হচ্ছে মরিশাসের এক রিসর্টে। গায়ে হলুদ থেকে বৌভাত, সব সেখানেই। এক সপ্তাহ মুখুজ্জে আর চাটুজ্জেদের হোল ফ্যামিলির বিদেশ পাড়ি।

ওরেব্বাস, এ তো পুরো ফিল্মি!

কে বলেছে? আরে এটাই তো ট্রেন্ড। নীলের বন্ধু টিয়া-অর্ণব তো ফিফি আইল্যান্ডের সমুদ্র সৈকতে কুঞ্জ সাজিয়ে মালাবদল-সিঁদুর দান, সব করল। ওদেরই আর এক বন্ধু স্বাগতম আর মিলির বৌভাত হয়েছিল ব্যাংককে। বধূবরণ সেরেই দমদম থেকে রাতের ফ্লাইট ধরেছিলেন ৮০ জন, একসঙ্গে।

বলো কী? সব হাই-ফাই বন্ধু দেখছি নীলের।

এক্কেবারে ভুল। ওরা সবাই চাকরি করে। তাই তো বিয়ের ছুতোয় কয়েকটা দিনের ব্রেক।

আরে ঝাঁ চকচকে ব্যাঙ্কোয়েট হলে বলিউডি কায়দায় বিবাহ যে ইতিমধ্যেই সেকেলে। বিয়ের পরে সুইৎজারল্যান্ড-প্যারিসে মধুচন্দ্রিমাও এখন তেমন বড় ব্যাপার নয়। বহু মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির বর-কনেরাই এখন সপরিবার বিদেশ যাচ্ছেন বিয়ে করতে। তারই পোশাকি নাম ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’।

বাঙালি বিয়েতেই ফিল্মি টুইস্ট?

লারা দত্ত আর মহেশ ভূপতি গিয়েছিলেন গোয়া। কুনাল কপূর আর নয়না বচ্চন গিয়েছিলেন সেশেলস্।

এমনকী পাপারাজ্জি থেকে বাঁচতে ইতালির ছোট শহরে গিয়েছিলেন রানি মুখোপাধ্যায় এবং আদিত্য চোপড়া।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ওঁদের মতোই হচ্ছে। দিব্যি সাধ্যের মধ্যে। সব রকম হোটেল-রিসর্টেই এখন নানা দামের ওয়েডিং প্যাকেজ। পছন্দ পাহাড় হোক বা সমুদ্র। চলে যাওয়া যায়, যে দিকে দু’চোখ চায়।

সাত পাকে বাঁধা পড়ার ছুতোয় কয়েকটা দিন জমজমাট পার্টি।

রোম্যান্টিক পরিবেশে ঘটে যেতে পারে আরও একটা সাত পাকের ব্যবস্থা। যেমনটা হয়েছিল ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ ছবিতে কল্কি কোয়েচলিনের বিয়েতে রণবীর কপূর আর দীপিকা পাড়ুকোনের মধ্যে।

আরও দূরে চলো যাই

বিয়ে করতে বাঙালি যাচ্ছে বিদেশের নানা শহরেই। তুরস্ক, চিন, ইতালিও এখন বেশ পছন্দের বিবাহ-ডেস্টিনেশন বাঙালিদের। মিতুদিদির বিয়ের আগের রাতে ‘বেলি ডান্স’ এখনও ভুলতে পারেন না আইটি কর্মী রিমা। ইস্তানবুলে হাতে গোনা কয়েক জন অতিথিকে নিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার বর-কনে মিতু আর রাজ। বিয়ের সময়ে অতিরিক্ত ভিড়ভাট্টা তাঁদের পছন্দ নয়। তাই হটকে বিবাহ বাসর সেজেছিল এক তুরস্কবাসী বন্ধুর সাহায্যে। কনের সাজগোজেও ছিল তুরস্কের শিল্পের ছোঁয়া। সেখানকার কাবাব আর মিষ্টি এখনও মুখে লেগে আছে আত্মীয়-বন্ধুদের। ফিরে এসে রিমা বলেন, ‘‘কিছু কিছু জিনিস ওখানে মিস করেছি। যেমন সব বিয়েতে আলপনা দেওয়া নিয়েও চলে মা-মাসিদের উৎসব। সেটা এ বার হল না। তবে আমিও সামনের জানুয়ারিতে ও পথেই যাচ্ছি। এক্কেবারে বলিউড কায়দায় বিয়ে করব মরিশাসের রিসর্টে। মাত্র ৫০ জন অতিথি নিয়ে।’’

শহরের এক নামী এমএনসি-র বড়কর্তার মেয়ে দোয়েলের সব সময়েই খুব পছন্দ ছিল সমুদ্রের ধারের পার্টি। তাই বাবা-মা নতুন জীবনের শুরুতে তাঁকে সেই উপহারই দিয়েছেন। এক সপ্তাহের ‘বিচ পার্টি’। বিয়ের সাত-সতেরো সবই হল পাটায়ার এক রিসর্টে। কলকাতা থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল শ’দুয়েক অতিথিকে। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বাবা-মা-কনের অফিসের সহকর্মী, সকলেই গেলেন পাটায়ায় এক সপ্তাহের উৎসবে মাততে। বর-কনে দারুণ খুশি। তবে মন ওঠেনি কনের মায়ের। মিসেস মিত্র বললেন, ‘‘মেয়ের বিয়েতে গঙ্গাকে নিমন্ত্রণ কি না করতে হবে পাটায়ার সমুদ্রের ধারে! এতটা মেনে নেওয়া যায় না। তবে আনন্দ করেছি খুব।’’

ফিউশন মতে সাত পাক

বহু সাহেব-মেমরা আসেন জয়পুরের রাজবাড়িতে বিয়ে করতে। লেহেঙ্গা আর শেরওয়ানি পরে দিব্যি সঙ্গীত আর মেহেন্দি উৎসবে মাতেন তাঁরা। আবার মার্কিন মুলুকের বাঙালি ডাক্তার ডোডো এসেছিলেন কলকাতায় বসে জার্মান বান্ধবীকে বিয়ে করার পরিকল্পনা নিয়ে। তাঁর জন্য শহরের এক নামী পাঁচতারা হোটেলেই ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় এক ‘গালা ইন্ডিয়ান ওয়েডিং’-এর। বিভিন্ন জায়গার আচার-অনুষ্ঠানের মিশেলে তৈরি ছিল প্যাকেজ। যেমন হয়েছে কনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, তেমনই আবার ঘোড়ায় চড়ে বর ঢুকেছেন নাচে উদ্দাম বরাত নিয়ে। জার্মান মেয়ে শিনা নিজের বিয়েতে পেয়েছেন গোটা ভারতের বিয়ের অনুষ্ঠানের স্বাদ।

নিন্দকেরা অবশ্য এই ব্যবস্থাকে আবার খোঁটা দিয়ে বলে থাকেন ‘সিরিয়াল মতে’ বিয়ে করা। তবে বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশেলই এখন ভারতীয় বিবাহে ‘ইন থিং’। সেই ফিউশনকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের নতুন ভাবনা। যেখানে যাচ্ছি, সেখানকার সাজগোজ-খাওয়াদাওয়া-আচার, সবই আপন করে নিয়েই হবে বিয়ে। লহেঙ্গা পরে হলই বা
আগুনে খই ফেলা! ব্যাঙ্ককর্মী সায়নী বলেন, ‘‘আমিও নিজের বিয়েতে একদিন উত্তর ভারতীয়দের মতো সালোয়ার-কামিজ, এক দিন শাড়ি, এক দিন লহেঙ্গা-চোলি, এক দিন ককটেল ড্রেস পরেছি। ক্ষতি কী? বিয়ে তো এক বারই করছি। নিজের যা যা শখ, সে সব না করলে হয়!’’ কেরলে গিয়ে সেখানকার সোনালি পাড়ের সাদা শাড়ির সঙ্গে ঢালাও সোনার গয়না আর দক্ষিণী স্বাদের চিংড়ি-কারি, চিংড়ির আচারে বিয়েতেও মাতছেন বহু বাঙালি।

বাড়ির পাশে আরশিনগর

নিজের পছন্দ মতো বিয়ের ব্যবস্থা মানেই কি তবে ‘গ্র্যান্ড অ্যাফেয়ার’? সব সময়েই কি বহু দূরে গিয়েই হবে স্বপ্নপূরণ? স্বপ্নে যদি থাকে বাড়ির কাছে নিরিবিলি কোনও গন্তব্য, সেখানেও করা যায় বিয়ের ব্যবস্থা। কম খরচেও হচ্ছে ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের পরিকল্পনা। যেমন বহু বাঙালিই এখন চলে যাচ্ছেন পুরী, মন্দারমণি, শান্তিনিকেতন। সেখানেই কোনও রিসর্টে সারছেন সাত পাকে বাঁধা পড়ার সাত সতেরো। বাউল গান, পোস্তর বড়া, মাটির গন্ধেই যে তাঁদের স্বপ্ন উড়ানের পথ তৈরি! অতিথি তালিকায় যাঁরা থাকছেন, তাঁদেরকেও বলে দেওয়া হচ্ছে মানানসই সাজগোজের কথা। পছন্দ যদি হয় আরও সাধারণ কোনও গন্তব্য, চলে যাওয়া যায় নিজেদের গ্রামের বাড়িতেও। সেখানেই এক্কেবারে চাক-চিক্য ছাড়া সেরে ফেলা যায় বাঙালি মতে আটপৌরে বিয়ে। সাধারণ ভাবে শাড়ি আর ধুতি।
শাঁখা-সিঁদুর, মানানসই ডাল-ভাত-বেগুন ভাজা-কচি পাঁঠার ঝোলের মজাও অন্য রকম। শপিংমল-মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতিতে ক্লান্ত বহু শহুরে বাঙালির এখন এমনটাই পছন্দ। কয়েকটা দিন গ্ল্যামারের থেকে দূরে।

বিয়ের ব্যবস্থা

নেট জগতে ঢুকলেই হল। যে কোনও জায়গায় করে ফেলা যায় যে কোনও ধর্ম মতে বিয়ের ব্যবস্থা। সর্বত্র হোটেল-রিসর্টে রয়েছে বিয়ের নানা প্যাকেজের তালিকা। কনের সাজ থেকে বিয়ের কুঞ্জ, সব ব্যবস্থাই করে ফেলা যায় বিদেশি রিসর্টের বিবাহ পরিকল্পকের সাহায্যে। চাইলে নিজেদের পছন্দের খাবারের তালিকাও দিয়ে দেওয়া যায় সেখানে। যেমন করেছিলেন দোয়েলের বাবা-মা। অতিথিদের এক জন জানাচ্ছেন, ‘‘কে বলবে ভিন্ দেশে বিয়ে হচ্ছে মেয়ের? নেমন্তন্ন বাড়ির লুচি-তরকারি, ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি থেকে শুরু করে সর্ষে বাটা দিয়ে মাছের ঝাল— সব খেয়েছি ওই বিয়েবাড়িতে। সঙ্গে আবার স্বাদ বদলও হয়েছে। ককটেল নাইটে গোটাটাই ছিল অচেনা সি-ফুডের সম্ভার।’’ গ্লোবালাইজড ভারতীয়রা এখন ‌ভাল ভাবেই আয়ত্তে এনে ফেলেছেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। এক ওয়েডিং প্ল্যানিং সংস্থার কর্ণধার কিরণ তিওয়ারি ভুয়ালকা বললেন, ‘‘এই মরসুমে আমরা ১২টা ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের আয়োজন করছি। ওয়েডিং প্ল্যানাররাই সাধারণত ভিন্ দেশে বিয়ের পরিকল্পনা করে থাকে। ইন্টারনেটে গিয়ে সার্চ করলেই বেরিয়ে পড়বে গাদা গাদা ওয়েডিং প্ল্যানার সংস্থার নাম, যারা ভিনদেশে বিয়ের রাজসিক ব্যবস্থা করে দেবে।’’ কমপক্ষে চার লক্ষ থেকে দেড় কোটি টাকায় হতে পারে এমন বিয়ে।

কিন্তু মন্ত্র পড়বে কে?

পারিবারিক পুরোহিত মশাইকেও তো উড়িয়ে নিয়ে চলে যাওয়া হচ্ছে বর-কনের পছন্দের ডেস্টিনেশনে। মেহেন্দি থেকে গায়ে হলুদ, সবই হচ্ছে সেখানে বসে। পারিবারিক পছন্দের কোনও রান্নার ঠাকুর থাকলে, তাঁকেও নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। বিয়ের সময়ের বিশেষ কিছু পদ করে ফেলা হচ্ছে তাঁরই নজরদারিতে। আর অতিথিপরায়ণ রিসর্ট বেছে নিলে তো কথাই নেই। হাওয়াইতেই হোক বা হাঙ্গেরি, স্বপ্নের মতো বিয়ের বাসর সাজানো সম্ভব সর্বত্রই। আর এই বিশাল আয়োজন ফ্রেমবন্দি করে নিতে সঙ্গে যাচ্ছেন ওয়েডিং ফোটোগ্রাফার। ভোরের সাজ, দুপুরের গায়ে হলুদ, সন্ধ্যার সম্প্রদান ভিন্ দেশে বসে কেমন দেখায়, তাঁরা ক্যামেরায় ধরে রাখেন সবটাই। যেমন কলকাতার ফোটোগ্রাফার অনির্বাণ ব্রহ্ম বলছিলেন উদয়পুর প্রাসাদে বাঙালি কনে আর কানাডিয়ান বরের বিয়ের কথা। সেই তিন দিনের সব হুল্লোড় অ্যালবামে সাজিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিয়ের ফোটোগ্রাফির কাজে নতুন অনন্যা পাত্র আবার এ বছরই প্রথম যাচ্ছেন ডেস্টিনেশন বিবাহ শ্যুট করতে, সোজা মালয়েশিয়া।

বহু দিন ধরে মনের কোণে অল্পঅল্প বাড়তে থাকা স্বপ্নটাকে আর একটু উস্কে দিলেই তা চলে আসবে হাতের নাগালে। একটু ভাবনা আর কয়েকটা ফোন-কল, বিয়েটাই হয়ে যাবে পুরো হনিমুন-মতে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE