Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘হর হর’ এগিয়ে রইল এ কালের ব্যোমকেশ সিরিজে

আবীর ভাল না যিশু ভাল, সে তর্ক বরং থাক। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়আবীর ভাল না যিশু ভাল, সে তর্ক বরং থাক। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫ ১২:২০
Share: Save:

অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় তিন-তিনটে ব্যোমকেশ করার পরে আবীর ফেলুদা সাজলেন। বছর পুরো ঘোরেনি। তিনি আবার ব্যোমকেশ। গোয়েন্দার ভূমিকায় মানানোর মতো খুব বেশি অভিনেতা এই মুহূর্তে বাংলায় নেই, এটা হয়তো সত্যি। কিন্তু আবীর যে নতুন প্রজন্মের দর্শকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন, সেটাও সমান সত্যি। আর এ সবের চেয়েও বড় সত্যি, বাংলা ছবির বাজারে ইদানীং গোয়েন্দা গল্পের কাটতি সবচেয়ে ভাল। ফেলু-ব্যোমকেশ-কাকাবাবু-শবর... দর্শক কাউকেই ফেরাচ্ছেন না। ক’দিন আগেই অঞ্জন নতুন ব্যোমকেশ করে ফেলেছেন যিশু সেনগুপ্তকে নিয়ে। দর্শক হইহই করে দেখেওছেন। ঠিক এই পটভূমিতেই মঞ্চে আবীরের পুনঃপ্রবেশ। তবে এ বার তাঁর সঙ্গের আর কেউই ব্যোমকেশের রাজত্বে পুনঃ নন। সক্কলেই ফার্স্ট টাইম। প্রাচীন আর নবীনের এই সমাহারে ‘হর হর ব্যোমকেশ’ কিন্তু জমে গিয়েছে।

আসুন! পুরনো আর নতুন কে কেমন, একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক!

নতুন অজিত

অরিন্দম শীল তাঁর ‘শবর’কে আর ‘অজিত’ হিসেবে রিপিট করেননি। এ বার ঋত্বিকের মতো অভিনেতা অজিত করলে ‘শাশ্বত ভাল না ঋত্বিক ভাল’, এ রকম একটা তর্ক তৈরি হওয়ার আশা করতে পারতেন দর্শক। কিন্তু অঞ্জন-সিরিজে অজিত যতটা জায়গা পেয়ে থাকেন, অরিন্দমের প্রথম ব্যোমকেশে অন্তত ঋত্বিক তা পাননি। ফলে আবীর-শাশ্বত বা যিশু-শাশ্বতর যে চমৎকার জুটি দর্শক দেখে অভ্যস্ত, সেটা আবীর-ঋত্বিকের বেলায় হল না। ঋত্বিকের মতো অভিনেতা বলেই সীমিত সুযোগেও তিনি একটা আদল তৈরি করেন। কিন্তু বারবারই তাঁকে নবপরিণীত ব্যোমকেশ-সত্যবতীকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে হয়। তবে এ যাবৎ ব্যোমকেশ নিয়ে যত ছবি হয়েছে, তার মধ্যে এই ছবিতেই অজিতের সাহিত্যিক মনটাকে আলাদা করে তুলে ধরার একটা চেষ্টা দেখলাম। সাহিত্যের রেফারেন্স অনেকখানি অজিতের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে। বেনারসকে যে অজিত নিজের মতো করেও অনেকটা দেখছে, সেই ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। শুধু চুলের স্টাইলটা একটু বদলালে হত না? কোঁকড়া চুলটায় কেমন যেন শৌখিন জমিদার-পুত্রের ‘লুক’!

নতুন সত্যবতী

উচ্ছলতা আর লাস্যে, মানে-অভিমানে, প্রেমে আর যৌনতায় সোহিনী সরকার এ ছবির অনেকখানি। শরদিন্দুর লেখায় সেই যে ‘অর্থমনর্থম’য়ের শেষে এক ঝলক ‘সত্য-অন্বেষী’ ব্যোমকেশকে দেখা গিয়েছিল, তার পর থেকে ব্যোমকেশ প্রেমিক কম। সংসারী বেশি। সেই শূন্যস্থানটাই ‘বহ্নিপতঙ্গ’য়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন অরিন্দম। গল্পে যে ব্যোমকেশ গীতগোবিন্দ আওড়ায় আর অভিসারের গুপ্তকথাটি খোঁজার চেষ্টা করে, ছবিতে সেই সূত্রগুলো ব্যোমকেশ খুঁজে পায় তার নিজস্ব দাম্পত্যলীলার মধ্যে দিয়ে। এখানে গীতগোবিন্দ সত্যবতীর হাতে। ক্ষণে ক্ষণে সে কখনও ব্যোমকেশ, কখনও অজিতকে শ্লোকের মানে জিজ্ঞেস করে বেড়ায়। দাম্পত্যশয্যায় তারই মুখে ‘রতিসুখসারে’ শুনে ব্যোমকেশের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। সোহিনীই ছবির নায়িকা। তবে তাঁর মধ্যে উচ্ছল লাস্যের হিল্লোল যতটা দেখি, সত্যবতীসুলভ সমীহ আদায় করার মতো ব্যক্তিত্ব ততটা দেখি না, এই যা!

পুরনো ব্যোমকেশ

চশমাটা পাল্টেছেন। পাশে নতুন সত্যবতীকে পেয়ে প্রেম করার প্রচুর সুযোগ পেয়েছেন। আবীরের বাকিটা আবীরের মতোই। ব্যোমকেশ তাঁর চেনাজানা চরিত্র। সেখান থেকে ফেলু মিত্তির হয়ে আবার যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকে শুরু করা— কাজটা সহজ নয় মোটেই। আবীর সেই কঠিন কাজটাই করে ফেলেছেন। পরিচালক বদলেছে, বাকি ইউনিট বদলেছে। আবীর কিন্তু বদলাননি। ফলে তাঁর আগের ব্যোমকেশ এবং এ বারের মধ্যে বেশ খানিকটা ধারাবাহিকতা আছে, খানিকটা পরিবর্তনও আছে। এই পরিবর্তন আর অ-পরিবর্তনের মাপতোল ঠিকঠাক রাখতে পারাটাই সম্ভবত আবীরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তিনি সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে। গোছানো চিত্রনাট্যের (পদ্মনাভ দাশগুপ্ত এবং অরিন্দম) সহযোগিতা সঙ্গে থাকায় তাঁর কাজটা কিছুটা সহজও হয়েছে।

এবং বাকিরা়

‘হর হর’-এ সবচেয়ে বড় আমদানি যদি হন আবেদনময়ী সত্যবতী, সবচেয়ে বড় বিস্ময় তবে নুসরত ‘শকুন্তলা’ জাহান। সোহিনী যদি হন ঘরোয়া গ্ল্যামারের বিস্ফোরণ, নুসরত তবে রাজকীয় সৌন্দর্যের কোহিনূর। দেখে মনে হয়, শকুন্তলার চরিত্রটা যেন তাঁর জন্যই তৈরি। চাঁদনির ভূমিকায় রেচেল হোয়াইট ভাল। তবে শরীরী ভাষার পর্দাটা আর একটু নিচুতারে বাঁধলে ভাল হত। খুব ভাল লাগে পুরন্দরের চরিত্রে হর্ষ ছায়া আর ডাক্তার পালিত দীপঙ্কর দে-কে। দেবনারায়ণে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তও মজাদার চমক। কিন্তু নর্মদাশঙ্কর আর রতিকান্তকে নিয়ে খেদ থেকে গেল। সুব্রত দত্ত ভাল অভিনয় করলেন নর্মদার, কিন্তু চরিত্রটা খাপছাড়া হয়েই থেকে গেল। বইয়ের পাতায় তেমন খটকা না লাগলেও পর্দায় এই অসম্পূর্ণতা একটু অস্বস্তির। একই কথা রতিকান্ত সম্পর্কে। সদাব কামালের চেহারা ভাল। অভিনয় তেমন পোক্ত নয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, শকুন্তলা-রতিকান্ত-নর্মদাকে নিয়ে একটা আস্ত নাটক তৈরির সুযোগ ছিল। ব্যোমকেশ-সত্যবতীর দাম্পত্যের পাশে পরকীয়া ত্রিকোণটি জমে উঠলে বহ্নির
শিখা আর পতঙ্গের গতি, দুইই বাড়ত। হল কই?

এবং পরিচালক

কিন্তু এই সব ভাল-মন্দ এবং আরও অনেক কিছু মিলিয়ে ‘হর হর ব্যোমকেশ’ যে সামগ্রিক ভাবে বেশ উপভোগ্য ছবি, তার কৃতিত্ব অবশ্যই পরিচালকের। সেখানে তিনি তুরুপের তাস হিসেবে পেয়েছেন বারাণসীকে। কাহিনির পটভূমি কাশীতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া মানেই ভিসুয়ালের একটা বিরাট সিন্দুক খুলে যাওয়া। গোটা ছবিটাকেই একটা বৃহৎ ক্যানভাসে এনে ফেলা। পরতে পরতে ফেলুনাথের নস্টালজিয়া ঝিকিয়ে তোলার সুযোগ পাওয়া। তাও তো কাশীর গলি-ঘুঁজি সে ভাবে কাজে লাগানো হয়নি। কিন্তু ইদানীং কালে বহু ছবিতেই স্পেস-এর ব্যবহার দেখে কান্না পায়। বাজেট বা চিন্তার দৈন্য, যে কারণেই হোক, ছবি দেখে মনে হয় চরিত্রদের সংলাপ বলানোর জন্য একটা জায়গা খাড়া করা চাই। অতএব মনিটরে ওয়ালপেপার সাঁটার মতো করে একটা স্পেস রইল। এর ঠিক উল্টো দিকে আছে পিরিয়ড পিস বানানোর উত্তেজনা। সেখানে আবার যত রকম ভাবে পারো, ছবির ফ্রেমটাকে একেবারে প্রপস-এর প্রদর্শনী করে ফেলো! লোকে দেখে যেন বলে, হ্যাঁ খাটনি আছে বটে! সৌভাগ্যের কথা, ‘হর হর..’ এর কোনওটাই নয়। এ ছবিতে
যেটা আছে, সেটা আগাগোড়া একটা যত্ন আর পারিপাট্যের ছাপ। একটা গল্পকে গুছিয়ে বলার চেষ্টা। খুব দমচাপা সাসপেন্স নেই। অতি পরিচিত গল্প, ফলে হুডানিট-এর উত্তেজনাও নেই। কিন্তু খানিকটা এলায়িত আরামে একটা নিটোল গল্প দেখতে পাওয়ার তৃপ্তি বড় কম নয়। সৌমিক হালদারের ক্যামেরা আর সুজয় দত্ত রায়ের কাঁচি যোগ্য সঙ্গত না করলে সেটা হত না। সঙ্গে চমৎকার গান আর সুন্দর আবহসঙ্গীত (বিক্রম ঘোষ)। আবীর ভাল না যিশু ভাল, তাই নিয়ে তর্ক থাকুক। কিন্তু ছবি হিসেবে এ কালের ব্যোমকেশ সিরিজে হর হর-কে আপাতত এগিয়ে রাখতে হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE