Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Satyajit Ray

মানিক-দর্শন

কলকাতার যাবতীয় কন্ডাক্টেড ট্যুরের মধ্যে ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড নেই। তিনি নেই— কেমন আছে বাড়ির ভেতরটা? রায়-পরিবারের অনুমতি নিয়ে সেই সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়লেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে সময় আজও থমকে আছে!কলকাতার যাবতীয় কন্ডাক্টেড ট্যুরের মধ্যে ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড নেই। যার অধিবাসী বেঁচে থাকলে আগামী কাল বয়স হত চুরানব্বই। তিনি নেই— কেমন আছে বাড়ির ভেতরটা? রায়-পরিবারের অনুমতি নিয়ে সেই সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়লেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে সময় আজও থমকে আছে!

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

আধখোলা সবুজ গেটটা পেরিয়ে বোগেনভিলিয়ার সারির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাঁ দিকে তাকাতেই সিকিওরিটি বললেন তৃতীয় দরজা খুলে ঢুকে যান আট নম্বর ফ্ল্যাটে। ব্রিটিশ আমলের পেল্লায় আকাশছোঁয়া বাড়িতে কেউ ঢুকলে ধরেই নেওয়া হয় ভিজিটর অনিবার্য ভাবে বাড়ির আট নম্বর ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছেন।

শিস-টা আজ আর নেই

কী আছে এই আট নম্বর ফ্ল্যাটে? কার্পেট মোড়া চওড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়। পাশাপাশি চলেছে আর একটা সাবেক আমলের লিফট। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ দিকে সাদা দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাঁ দিকের এই বন্ধ দরজাতেই এক সময় বেজে উঠত কলিং বেল। কলিং বেল নিয়ে একটা মজার গল্প আছে এই বাড়িতে। বেল বাজলে সাদা পাঞ্জাবি আর আলিগড়ি পায়জামা পরা দীর্ঘকায় সুপুরুষ শিস দিতে দিতে দরজা খুলতেন। তিনি— সত্যজিৎ রায়।

আজ সেই শিস নেই। সেই দরজা বন্ধ। কলিংবেলও বাজে না। সত্যজিৎ রায় অসুস্থ হওয়ার পরেই বাড়ির এনট্রান্সটা বদলে ফেলা হয়। তাঁর স্টাডি রুমের দরজাটা বন্ধ করে আট নম্বর লেখা দরজা দিয়ে যাওয়া-আসা শুরু হয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আট নম্বর ফ্ল্যাটের দিকে এগোতে হয়। ঢুকেই ডান দিকে ফ্রেমবন্দি সুকুমার রায়ের পোর্ট্রেট। তাঁর পাশেই সুপ্রভা রায়ের নিজের হাতে তৈরি মূর্তি।

বসার ঘরের ভিসিআর

সুকুমার রায়ের ছবি পেরিয়ে ডান হাতে একটা বিশাল ঘর। ঘরের বাঁ দিকে সাবেকি ডিজাইনের কাঠের শোকেস-এর উপর এখন রাখা ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’র পুরস্কার। বলা যেতে পারে এই ঘর এখন সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপের অফিস। ফেলুদার চিত্রনাট্য শুনতে এখানেই আসেন আবীর চট্টোপাধ্যায়।

আগে এখানকার ঘরের ভিসিআর-এ নিজের ছবি দেখতে খুব পছন্দ করতেন সত্যজিৎ রায়। ‘‘আমার মনে আছে এনএফডিসি থেকে ‘পথের পাঁচালী’ যখন ভিএইচএস ফরম্যাটে বেরোল, বাবা তখন প্রচণ্ড খুশি। দুলাল দত্তকে ডেকে টিমের সবাইকে নিয়ে এই ঘরে ‘পথের পাঁচালী’ দেখছেন আর বলছেন ‘ইস দুলালবাবু, এই শটটা যদি অন্য অ্যাঙ্গল থেকে নেওয়া যেত! শেষে আমরা সকলে বাবাকে ধমক দিয়ে চুপ করাই,’’ বললেন সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়।

সুর তুলতেন ওই পিয়ানোটায়

এখন বসার ঘর পেরিয়েই যেতে হয় সেই স্টাডি রুমে। শ্যুটিং না থাকলে ঘুম থেকে উঠে রাত পর্যন্ত এখানেই অবিরাম কাজ করে যেতেন সত্যজিৎ রায়। সেই ঘরে ঢুকে বাঁ হাতে চোখে পড়ল পিয়ানোটা। ব্র্যাগেঞ্জা থেকে ১৯৬০ সালে ভাড়া করে আনিয়েছিলেন সত্যজিৎ।
তবে মিউজিক কম্পোজ করা ছাড়া এই বাড়ির কেউ তাঁকে পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতে দেখেননি। পিয়ানোয় এখন মাঝে মাঝে সুর তোলেন সত্যজিৎ-দৌহিত্র সৌরদীপ।

পিয়ানোর দিকে তাকিয়ে সন্দীপ রায় বললেন, ‘‘বাবা পিয়ানোয় সুর তুলছেন আর মা পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে স্পুলে রেকর্ড করে দিচ্ছেন ‘চারুলতা’র গান। সেই রেকর্ড শুনে মুম্বইতে ‘চারুলতা’র গান তুলেছিলেন কিশোরকুমার।’’

পুরনো ম্যাগাজিনে ঠাসা সেই আলমারিটা

সন্দীপ বললেন, ‘‘চলচ্চিত্র বিষয়ক পুরনো ম্যাগাজিনের খুব শখ ছিল বাবার। আর ‘সন্দেশ’ না হলে তো বাবার এত গল্প-উপন্যাস আমরা পেতামই না—’’। এখন রায়বাড়ির টেবিলে দেখা গেল আনন্দমেলা, দেশ, আনন্দলোক-য়ের নতুন সংস্করণ। বইয়ের সংগ্রহের পাশেই সংরক্ষিত রয়েছে সত্যজিতের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রিয় রেকর্ডগুলো।

গদিওয়ালা চেয়ার আজও সেখানে

স্টাডিরুমের মাঝে আলো করে আছে মেরুন রঙের গদিওয়ালা চেয়ার। একই জায়গায়। ১৯৯২-এর জানুয়ারির শেষে অসুস্থতার জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। সে দিন কিছু পরেই বিজয়া রায় সত্যজিৎকে বিদায় সম্ভাষণ জানালে, সত্যজিৎ উঠে বসে বলেছিলেন, ‘‘এ কী, তুমি চললে? আমাকে নিয়ে যাবে না? এখানে আমি কিছুতেই ভাল হব না। বাড়ি গেলেই ভাল হয়ে যাব।’’
আসলে সত্যজিৎ ছিলেন পুরোদস্তুর ফ্যামিলি ম্যান। বাড়ি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতেন না।

ন’নম্বর বাড়ির স্টাডি রুমের আড্ডা

কোনও দিনই টেবিলে লেখা পছন্দ করতেন না। লেখার জন্য অক্সফোর্ডের নোটস লেখার বড় খাতা আর কালি- কলম ছিল ওঁর পছন্দের। একটানা লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে পা ছড়িয়ে দিতেন লম্বা খাটে। সেই খাট আজ আর নেই। ‘‘ওখানেই বহু বার লেখার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে। সকালে আনন্দমেলার পুজোসংখ্যার জন্য তাড়া মেরে নীরেনদার ফোন আসত। দুপুরের মধ্যেই বাবার লেখা শেষ! অসম্ভব দ্রুত লিখতেন। নীরেনদারও তর সইত না। এসেই পুরো লেখাটা বাবার সামনে পড়তেন। কত বার দেখেছি উনি লেখা পড়ছেন। আর বাবা হয়তো তখন ‘আনন্দমেলা’র শঙ্কুর জন্য ছবি এঁকে ফেলেছেন। কখনও বসে থাকতে দেখিনি ওঁকে,’’ বিস্ময়ে বলেন সন্দীপ।

রবিবারের আড্ডাও বসত এই স্টাডিরুমে। এ রকম একদিন হঠাৎই ‘শতরঞ্জ কী খিলাড়ি’র চিত্রনাট্য শুনতে চলে এসেছিলেন সঞ্জীবকুমার। সন্দীপ বললেন আরও একটা ঘটনা। সত্যজিৎ রায়ের স্টাডিরুমে ‘হীরক রাজার দেশে’ ফুল কাস্ট চিত্রনাট্য শুনতে এসেছে। শুরু হল চিত্রনাট্য পড়া। সংলাপের সঙ্গে প্রত্যেকটা গান নিজে গেয়ে শুনিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক। ছবিতে ইন্টারভ্যালের কথা মাথায় রেখে থামলেন তিনি… ততক্ষণে বিজয়া রায় সকলের জন্য চা আর মাংসের চপের আয়োজন করে ফেলেছেন।

সন্ধে নেমেছে বিশপ লেফ্রয় রোডে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র লুক আর পোশাক নিয়ে মুম্বই থেকে কথা বলতে এসেছেন শর্মিলা ঠাকুর। কলিংবেলটা বেজে উঠল। সত্যজিৎ দরজা খুললেন। সামনে কোট-টাই পরা এক অচেনা পুরুষ। বললেন, ‘‘নমস্কার, আমার নাম দীপঙ্কর দে। শুনলাম আপনি ‘সীমাবদ্ধ’ করছেন। আমি রুণু সান্যালের চরিত্রে অভিনয় করতে চাই।’’ সে দিনই সেই অচেনা মানুষের স্কেচ এঁকে রেখেছিলেন সত্যজিৎ তাঁর খেরোর খাতায়। পরে ‘সীমাবদ্ধ’তে ডাক পেলেন দীপঙ্কর।

পুজোসংখ্যার লেখার চাপ, অন্য দিকে শ্যুটিংয়ের ব্যস্ততা থাকলেও রবিবারের এই আড্ডা কোনও দিন বাতিল করেননি সত্যজিৎ রায়। সকলে হয়তো চুটিয়ে আড্ডা মারছে। চায়ের সঙ্গে জোর কদমে টা চলছে। আর উনি আড্ডা মারতে মারতে ছবি আঁকার কাজটা সেরে ফেলছেন। উনি বলতেন ছবি আঁকায় লেখার মতো তো আর মাথা দিতে হয় না...

সেই আড্ডার জায়গায় আজ ঢুকেছে কম্পিউটার। ওটাই এখন রে সোসাইটির কর্মক্ষেত্র। বইয়ের আলমারি ঘেরা এই ঘরে ছড়িয়ে আছে অ্যাসিড পেপার, ফাইলের মতো নানা জিনিসপত্র।

অস্কারটা তো নেই

রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির ঘটনা এই বাড়িতে আর ঘটবে না। কারণ অস্কার বাড়িতে রেখে ঝামেলা বাড়াতে চাননি রায়-পরিবার। ওটা এখন পারিবারিক লকার-বন্দি।

বেডরুমের মাঝে খাটটা

স্টাডি রুম থেকে বসার ঘর পেরোলেই লম্বা করিডর। সেই করিডর দিয়ে হাঁটতে ডান হাতে দ্বিতীয় ঘরটাই সত্যজিৎ আর বিজয়া রায়ের বেডরুম। ঘরের মাঝে সাবেকি খাট। খাটের ওপরের দেওয়ালে ছোট্ট বাবুকে নিয়ে সত্যজিৎ আর বিজয়ার ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’। খাট পেরিয়ে ড্রেসিং টেবিল— আজও একই আছে সব। ‘‘রাতে শোওয়া ছাড়া কখনই দেখিনি বাবাকে বেডরুমে। স্টাডিরুম ফাঁকা না থাকলে মা-ও কখনও বাবার কাছে যেতেন না,’’ বললেন সন্দীপ। বেডরুম আর স্টাডিরুমের সংযোগ ছিল চিত্রনাট্য। সতাজিৎ রায় ছবির চিত্রনাট্যের ফাইনাল ড্রাফ্ট প্রথম বিজয়া রায়কেই পাঠাতেন। সঙ্গে থাকত পেন্সিল। যথা সময়ে বিজয়া রায় মন্তব্য সহ স্টাডিরুমে পৌঁছে দিতেন তাঁর মন্তব্য-সহ ছবির সেই চিত্রনাট্য।

লুচি-ছোলার ডালের গন্ধ

বেডরুম পার করে খাবার ঘরের সেই গোল টেবিল আজও বয়ে নিয়ে আসছে লুচি আর ছোলার ডালের গন্ধ। নিরামিষ বাঙালি রান্না আর মাংসই ছিল মানিকের সবচেয়ে প্রিয়। এই খাবার ঘর পেরিয়ে সন্দীপ আর ললিতার ঘর। তার পাশেই থাকেন সত্যজিৎ-পৌত্র সৌরদীপ।

তাঁর সৃষ্টির মধ্যে নয়, তাঁর মৃত্যুর ২৩ বছর পরেও বিশপ লেফ্রয় রোডের এই বাড়িতেই যেন সবচেয়ে বেশি করে আছেন সত্যজিৎ রায়। বাড়ির লম্বা দালানে আজও যেন পায়চারি করেন সেই দীর্ঘ মানুষটি। কান পাতলেই শোনা যায় তাঁর শিস দেওয়া গান। সেই গানে কখনও বাখ, বিঠোভেন আর গ্রেগরিয়ান চান্ট, কখনও ‘চারুলতা’র সুর। আজও তাঁর জন্মদিনে বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, খাওয়াদাওয়া হুল্লোড়। জন্মদিন ছাড়া অন্য কোনও উৎসব পছন্দ ছিল না তাঁর।

আগের মতোই আজও থেকে থেকে বেজে উঠল টেলিফোন...। এই টেলিফোনই আজ থেকে ষাট বছর আগে জানিয়েছিল আমেরিকায় মোমা (মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট)-তে প্রথম ‘পথের পাঁচালী’ দেখানো হবে। আজ সেই ফোনেই খবর এল ‘পথের পাঁচালী’র ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে সেই মোমাতেই ‘পথের পাঁচালী’-র আবার স্ক্রিনিং।

সময় কি থমকে থাকে? না কি ফিরে ফিরে আসে...

ছবি: সৌরদীপ রায়।

সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষের সূচনায় লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE