Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

আমার নিষ্ঠুর বস

তিনি কর্ত্রী। নিউজরুম কাঁপত দাপটে। নাম তাঁর ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়! নিউজএক্স-এ তাঁর অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা লিখছেন সাংবাদিক দ্বৈপায়ন হালদার।তিনি কর্ত্রী। নিউজরুম কাঁপত দাপটে। নাম তাঁর ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়! নিউজএক্স-এ তাঁর অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা লিখছেন সাংবাদিক দ্বৈপায়ন হালদার।

সুখের দিনে: বিদেশে ছুটি কাটানোর ফাঁকে পিটার-ইন্দ্রাণী।

সুখের দিনে: বিদেশে ছুটি কাটানোর ফাঁকে পিটার-ইন্দ্রাণী।

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, এক মহিলা অ্যাঙ্করকে ডান হাত নেড়ে দাঁড় করালেন তিনি।

এমনিতে নিউজরুমে কাউকে দাঁড় করিয়ে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের কথা বলা মানে দু’টো জিনিস ঘটতে চলেছে।

হয় আপনি অসম্ভব অপমানিত হবেন। না হলে আপনার চাকরি যাবে।

আমার কিউবিকলের পিছনেই ঘটছিল ঘটনাটা। হঠাৎ করে দেখলাম ইন্দ্রাণী সেই অ্যাঙ্করকে বললেন, ‘‘বাহ, তোমার জুতোটা তো দারুণ। কিন্তু খুব সস্তা, তাই না?’’

সে দিন থেকে আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় কী অসম্ভব ‘ওয়ানাবি’, নিম্নমানের একজন মহিলা। যাঁর জীবনের ফিলোজফিটাই হল, আমি কতটা বড় আর তুমি কত ছোট সেটা বলে মানুষকে অপমান করা।

ঢোকার প্রথম দিনই আমার এক সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, ‘‘কেন পুরনো চাকরিটা ছেড়ে এলে? এখানে তো কেউ চ্যানেল নিয়ে ইন্টারেস্টেড নয়। পিটার আর ইন্দ্রাণী শুধু কোটি কোটি টাকা নিজেদের ব্যাঙ্কে ঢোকাচ্ছে।’’

এ রকম একটা পরিবেশে পড়েই ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে আমার কৌতূহল ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ভাবতাম, একজন মহিলা এত পাওয়ারফুল, এতটাই তাঁর ক্ষমতা। কী আছে তাঁর ব্যক্তিত্বে যে বড় বড় এডিটরকে তিনি বলে বলে শাসাতে পারেন?

সবাই বলত, পিটার মুখোপাধ্যায় অনেক অমায়িক, অনেক অ্যাপ্রোচেবল। কিন্তু ইন্দ্রাণী মানেই ‘টেরর’। কখনও সাঙ্ঘাতিক রুড, কখনও ভীষণ দাম্ভিক এবং রেগে গেলে যিনি চার অক্ষরের গালাগালিতে ধুইয়ে দিতে পারেন।

আজকে ভাবতে অবাক লাগে, যে-ভদ্রমহিলা এক সময় আমার বস ছিলেন তিনি আজকে দেশের অন্যতম সেনসেশনাল খুনের সঙ্গে জড়িত। তিনি যে এই খুনের মাস্টারমাইন্ড সেটা প্রায় প্রমাণিত। কিন্তু এক সময় তিনি ছিলেন আমার বস। আমার নিষ্ঠুর বস।

প্রাথমিক কথাবার্তার পর নিউজএক্স-এ ফাইনাল ইন্টারভিউয়ের জন্য আমি দিল্লিতে আসি দেখা করতে। সেটাই ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। সালটা ২০০৮।

‘‘আশা করি আপনি যেমন দর কষাকষি করতে পারেন কাজের ক্ষেত্রেও তেমনি ভাল হবেন। আমরা আপনাকে কিন্তু অনেক টাকা দিয়ে আনছি,’’ মজার ছলে বলছিলেন ইন্দ্রাণী।

আমি হেসেছিলাম। বুঝতে পারিনি ওঁর কথাগুলোকে অপমান হিসেবে নেব, না কি কাজে ঢোকার আগেই বিগ বসের সঙ্গে দেখা হওয়ায় খুশি হব!

এমনিতে খুবই আকর্ষণীয় সুন্দরী মহিলা। সেই সঙ্গে ছিল আধিপত্যের দাপট। সঙ্গে বিদেশি পারফিউমের গন্ধ। পরনে অধিকাংশ সময়ই বিজনেস স্যুট। অথবা স্কার্ট আর ট্রাউজার্স। বেশির ভাগ সময়ই শার্টের উপরের দু’টো বোতাম খোলা।

চাকরি পাকা হওয়ার পর, ইন্দ্রাণীর কথাতেই দিল্লিতে অরুণ জেটলির বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, দক্ষিণ দিল্লির কৈলাস কলোনির এক সুন্দর গেস্ট হাউসে আমাকে রাখা হয়েছিল।

পরে শুনেছিলাম চ্যানেলের কিছু উঁচু পোস্টের ইন্টারভিউও নাকি হয়েছিল জেটলির বাড়িতে। সেটা গুজব ছিল কি না জানি না। যেমন জানি না আরও অনেক গুজবের সত্যতা।

চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছু দিন আগেই নিউজএক্স থেকে হঠাৎ করে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছিল চ্যানেলের দুই শীর্ষস্থানীয় এডিটরকে। নিউজরুমে গুজব ছিল, ওদের এক জনের সঙ্গে ইন্দ্রাণীর একটা হাল্কা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। পরে সেই সম্পর্ক খানিকটা তিক্ততার দিকে চলে যায়। সেই

সম্পর্কের কথা পিটারের কানে গেলে তিনিও নাকি প্রচণ্ড রেগে যান। এটাই নাকি ছিল তাঁদের একজনের ছাঁটাইয়ের কারণ।

ইন্দ্রাণীর রাগ এমনই ছিল যে নিউজরুমের হেড, অভিরুক সেনকে গার্ডদের দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন কেবিন থেকে। ইন্দ্রাণীর বক্তব্য ছিল অফিসে বসে ল্যাপটপে পর্ন দেখছিল অভিরুক।

যাঁরা অভিরুকের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা জানতেন এটা ডাহা মিথ্যে। কিন্তু মিথ্যে যে ইন্দ্রাণী অনায়াসে বলতে পারেন সেটা আজকে আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

আসলে ইন্দ্রাণীর এই কথার কোনও ভিত্তিই ছিল না। আজ ফিরে দেখলে মনে হয় ইন্দ্রাণীর যদি কারওকে বের করে দেওয়ার ইচ্ছে হয় তা হলে তিনি সেটা করবেনই। যেনতেনপ্রকারে!

আজ যখন টিভিতে দেখছি নিজের মেয়েকে খুন করায় অভিযুক্ত ইন্দ্রাণী, আমার সেই সহকর্মীর কথাই মনে পড়ছে যে বলেছিল,‘‘ইন্দ্রাণীর যদি কারওকে বের করে দেওয়ার ইচ্ছে হয় ও সেটা করবেই। যে ভাবেই হোক !’’

সেই সময় একদিন এক কফি ব্রেকে ইন্দ্রাণী এক বার এসেছিলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। ‘‘নিউজরুমের কী খবর?’’ জিজ্ঞেস করছিলেন গম্ভীর ভাবে।

আমি জানিয়েছিলাম লোক কম, অফিসে সবাই খুব চাপে আছে। কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন ইন্দ্রাণী। ইস্পাত-কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘‘টিমকে বলে দিও গরম যদি সহ্য করতে না পারে রান্নাঘর থেকে যেন বেরিয়ে যায়।’’

এটা পিটারেরও পছন্দের কথা ছিল। অফিসে অনেক বার তা বলতেনও পিটার, ‘‘ইফ ইউ ক্যান নট স্ট্যান্ড দ্য হিট, স্টেপ আউট অব দ্য কিচেন।’’ কিন্তু ইন্দ্রাণীর মুখে কথাটা শুনে আমার একটু ভয়ই লেগেছিল। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।

ইন্দ্রাণীর কথা বলার ভঙ্গিটাই নিউজরুমে আমার সিনিয়রদেরও ভয় পাইয়ে দিত। বুলেটিনে কিছু ভুল হলে ইন্দ্রাণীর ফোনে থরহরিকম্প হয়ে যেতেন তাঁরা। হয়তো তাঁদের মনে পড়ে যেত অভিরুক সেনকে কী ভাবে তাড়িয়ে দিয়েছেন ইন্দ্রাণী।

এটা কি সেই নির্মমতা যা দিয়ে একজন মা তার মেয়ের পরিচিতি লুকিয়ে রাখে? এটাই কি সেই নিষ্ঠুরতা যা দিয়ে একজন মা তার মেয়েকে গলা টিপে খুন করে আর পুড়িয়ে দেয়? হয়তো তাই। আমি যখন এই লেখাটা লিখছি একের পর এক গুজব ভেসে আসছে। একের পর এক ষড়যন্ত্রের থিয়োরি

সামনে আনছে মিডিয়া।

অনেকের অনুমান পিটার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিনার সম্পর্কে রেগে গিয়েই নাকি ইন্দ্রাণী খুন করেছিলেন নিজের মেয়েকে।

আজ সারা বিশ্ব তাকে বলছে সোশ্যাল ক্লাইম্বার, যিনি নামী লোকজনকে ধরে এগিয়ে যেতে চান সমাজে শীর্ষের দিকে। কখনও অ্যালেক পদমসি, কখনও পিটার মুখোপাধ্যায়। নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য যিনি যা খুশি করতে পারেন। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে কাজ-করা এক হাই প্রোফাইল এডিটর সেদিন

টিভিতে বলছিলেন, ইন্দ্রাণী নাকি মানসিক ভাবেও স্থিতিশীল নন।

এই ঘটনার পর শুক্রবার রাতে আমি পিটারকে একটা ছোট ইন্টারভিউয়ের জন্য ফোন করেছিলাম। ‘‘মিস্টার মুখোপাধ্যায়, আপনি জানতেন শিনা ওর মেয়ে, বোন নয়? আপনার কখনও কিছু সন্দেহ হয়নি?’’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘‘বিশ্বাস করো আমার কখনও সন্দেহ হয়নি ইন্দ্রাণীর ওপর। কী বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গে তো কখনও ইন্দ্রাণীর বাবার দেখাও হয়নি। আমি ইন্দ্রাণীকে ভালবাসতাম আর এখনও বাসি,’’ বলেই ফোনটা কেটে দিলেন পিটার।

পিটার একা নন। ইন্দ্রাণীকে অনেকেই ভালবাসতেন। অনুরাগীর সংখ্যাও কম ছিল না। অল্প বয়েস, স্টাইলিশ, আর আত্মবিশ্বাসী এক ছোট শহরের মেয়ে পৃথিবী জয় করে ফেলেছেন। বিশেষ করে চ্যানেলের অল্পবয়েসি মহিলা সঞ্চালকেরা ইন্দ্রাণীকে খুব পছন্দই করত। ওঁকে অনুকরণ করত।

বেশির ভাগ মেয়েকে ইন্দ্রাণী নিজেই বেছে নিতেন।

কিন্তু তার পরেই ঘটল সেই বিশ্রী ঘটনাটা। চেন্নাই থেকে আসা একজন উজ্জ্বল, উচ্চাকাঙ্খী মেয়ে অনেক পরীক্ষা পেরিয়ে ‘অন এয়ার’য়ে গেল। কোনও কারণে ইন্দ্রাণী সেটা জানতেন না। একদিন টিভিতে সেই মেয়েকে দেখে ইন্দ্রাণী চিৎকার করেছিলেন, ‘‘কে এই বিশ্রী দেখতে মেয়েটাকে অন এয়ার

পাঠিয়েছে?’’

মেয়েটাকে বলা হয়েছিল টিভিতে উপস্থাপনা করার মতো সুশ্রী সে নয়। টিভি একটা ভিশ্যুয়াল মিডিয়াম। উপস্থাপককে কেমন দেখতে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চ্যানেল হেড হয়ে ইন্দ্রাণী যে ভাবে মেয়েটাকে অপমান ও অপদস্থ করেছিলেন সেটা আমার মনে সাঙ্ঘাতিক তিক্ততা জাগিয়ে তোলে।

মনে আছে সে দিন আমার টিমকে রাগের মাথায় বলেছিলাম, ‘‘পছন্দ না হলে এ মহিলা কাউকে খুনও করতে পারে।’’

আজ ফিরে দেখলে মনে হয় খুব ভুল বোধহয় সে দিন বলিনি!

(লেখক মেল টুডে-র ডেপুটি এক্সিকিউটিভ এডিটর)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE