প্রেম গুপ্তার মনে হল এ এক অন্য মান্না দে। ‘সিমফনি-র নিউ মার্কেট আউটলেটে মান্নাদা কয়েক বার এসেছেন পছন্দের সিডি কেনার জন্য। গম্ভীর ভাবে শো-কেস দেখছেন। সিডি বেছে নিচ্ছেন। এত ব্যক্তিত্ব, কথা বলতেই ভয় লাগে। ইচ্ছা থাকলেও প্রেম গুপ্তা কথা বলতে ইতস্তত বোধ করলেন। যদি কিছু বলেন। কেমন যেন রাগী রাগী মুখ। মনের ইচ্ছা মনেই রয়ে গেল। অথচ প্রতিদিন যে অজস্র সিডি, ক্যাসেট সিমফনির পাঁচটা আউটলেট থেকে বিক্রি হয়, তার একটা বিরাট অংশই মান্নাদার গাওয়া। মালিক হিসেবে একটু কৃতজ্ঞতা জানানোর ব্যাপার তো ছিলই আর ব্যক্তিগত ভাবে মান্না দে তার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী। এত কাছে পেয়েও আলাপ করা হল না। সুযোগটা মিলল কয়েক বছর পরে। ২০০৮। মান্নাদাকে দেখে, কথা বলে প্রেম গুপ্তা অবাক। দোকানে দেখা সেই ভয়ঙ্কর গম্ভীর মানুষটা, আর পাশে বসা এই মান্নাদা একই জন? একটা নতুন ধরনের সিডি প্রকাশের অনুষ্ঠান। বেসিক এবং সিনেমায় সব ধরনের গান গেয়েছেন মান্নাদা। কিন্তু ‘মহানাম মন্ত্র’ নিয়ে আস্ত একটা সিডি? একটু নতুনত্ব তো বটেই। জীবনের প্রান্ত ভাগে এসে মান্নাদা অনেক নতুন ধরনের গান করেছেন। এটিও তার মধ্যে একটা। ভাইপো সুদেবের সঙ্গে প্রথম গানের অ্যালবাম। কৃষ্ণচন্দ্র দে থেকে মান্না দে। মান্না দে থেকে সুদেব দে। সঙ্গীতের ঐতিহ্যময় পরম্পরা। অ্যালবামেরও নাম ‘পরম্পরা, হরেকৃষ্ণ মহানাম মন্ত্র’। প্রচলিত সুরে এই মহানাম মন্ত্র পাঁচ রকম ভাবে গেয়েছেন মান্না দে এবং সুদেব। মন্ত্র এবং সুরের হ্যামরিং একটা ঘোরে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অসাধারণ গায়কি। প্রেসক্লাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ‘রাজা মিউজিক’-এর কর্ণধার প্রেম গুপ্তা আছেন। আছেন মান্নাদার প্রিয় ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য, তৎকালীন সঙ্গীতপ্রেমী মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী, মায়াপুরের একজন সন্ন্যাসী, সস্ত্রীক সুদেব দে। মান্না দে তো ছিলেনই। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান যার উপস্থিতিতে আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তিনি সুলোচনা দে, মান্না দে-র সহধর্মিণী। ম্যাডাম পাশে থাকলে মান্নাদার মুড ভাল থাকবেই—এ কথা একদম গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। সে দিনও মান্নাদা দারুণ মেজাজে। মজা করে বললেন, ‘আমার যে বয়স হয়েছে তা সুদেবই খেয়াল রেখেছে। এই তো সবে সাতাশি হল। ওর পাল্লায় পড়ে একটু ঠাকুরের নাম করলাম’। তার পর বললেন, ‘মি গুপ্তা (প্রেম গুপ্তা), আপনিও নাম-গান করুন। সবাইকে না দেখে ঠাকুরের আর উপায় থাকবে না।’ সাংবাদিক বৈঠকের আনুষ্ঠানিকতা একটা খোলামেলা আড্ডায় পরিণত হল। মান্নাদা মুডে থাকলে যেমন হয়। অসাধারণ রসবোধ। এই মান্নাদাকে দেখছেন আর প্রেম গুপ্তা ভাবছেন কাউকে সঠিক চিনতে গেলে খানিকটা কাছাকাছি তো আসতে হয়।
একটা কথা মনে হয় সবারই দুঃখের নানা রকম ফের আছে। শিল্পীদেরও। সবাই চান যত দিন সম্ভব অনুষ্ঠানে গান শোনাতে। শ্রোতাদের সঙ্গে একটা সরাসরি যোগাযোগ হয়। তাদের প্রতিক্রিয়া শিল্পী দেখতে পান। সে এক পরম তৃপ্তির ব্যাপার। যে সব অভিনেতা চলচ্চিত্র এবং নাটক দুটি মাধ্যমেই অভিনয় করেন, দেখবেন নাটকে অভিনয় করেই তাঁরা বেশি তৃপ্তি পান। কারণ সেই একটাই। সরাসরি দর্শকদের ধরা। মান্নাদা বলতেন, ‘এমন দিন যেন না আসে, আমি বেঁচে আছি, অথচ গান গাইতে পারছি না।’ অথচ মাঝে মাঝে এমনও হয় গান শুনে শ্রোতারা তৃপ্ত হলেন, কিন্তু শিল্পী অতৃপ্ত রয়ে গেলেন। আগরপাড়ায় অনুষ্ঠান। প্রধান শিল্পী মান্না দে। আসর জমে উঠেছে। মাঠ ঘিরে অনুষ্ঠান। মান্নাদা তাঁর খুব প্রিয় এক সিরিয়াস গান ধরলেন—‘তুমি নিজের মুখে বললে যে দিন সবি তোমার অভিনয়’। মান্নাদা লক্ষ করলেন কয়েক জন শ্রোতা বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। মান্নাদা গানটা থামিয়ে দিয়ে গাইতে শুরু করলেন—‘কিচিমিচি কিচিমিচি’। ‘স্বয়ংসিদ্ধা’-র ফানি সং। এ সব তো মান্নাদার গান নয়। সিনেমার সিচুয়েশনের জন্য গাইতে হয়েছে এমন অনেক গান। মান্নাদা গানটা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সত্যি আপনাদের রুচি। অত ভাল একটা গান আপনাদের পোষালো না, আর, ‘কিচিমিচি’ শুনে বসে পড়লেন।’ এ-ও এক দুঃখ, মান্নাদাকে তাড়া করে বেড়াত। একবার কলামন্দিরে মান্নাদা গাইছেন। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। মান্নাদার অজস্র কালজয়ী ছবির গান লিখেছেন। তুলনায় বেসিক গানের সংখ্যা কম হলেও যে কটি লিখেছেন অনবদ্য। এমন একটি রচনা ‘এই সেই ঘর, সেই দরজা’। অসাধারণ রচনা। মনে হয় এ তো কবিতা। এই পয়লা মে, মান্নাদার জন্মদিনে একটি অনুষ্ঠানে সুরকার সূপর্ণকান্তি ঘোষ গানটি আবৃত্তি করলেন। শ্রোতারা মুগ্ধ, নিশ্চুপ। কিন্তু একই রকম শ্রোতা তো সব জায়গায় থাকে না। মান্নাদা গানটা গাইলেন। আসলে কিছু শ্রোতা আছেন যারা হাতেগোনা কয়েকটা গান শোনার জন্য আসেন। অন্য গানের খবরই রাখেন না। এমন একজন গানটার শেষে কিছু একটা বলল। মান্নাদা খুব আহত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গ উঠলেই অনেকেই বলত, ‘মান্নাদা, এমন ধরনের শ্রোতা হাজারে একটা।’ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মান্নাদা বলতেন, ‘না, গানের পরিবেশটাই আস্তে আস্তে কেমন বদলে যাচ্ছে।’
সমস্ত রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মান্নাদা বেশি গান গাইবার সুযোগ পাননি রফি-কিশোর-মুকেশের তুলনায়। শ্রোতাদের এ নিয়ে প্রচুর আক্ষেপ আছে। অনেকে আবার বিশেষ করে মুকেশের গাওয়া বেশ কিছু গান নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেন মান্নাদা গাইলে সে গান আরও কত ইমপ্রোভাইজড হত। এমনও অনেকে ভাবেন রাজ কপূরের ছবির শ্রেষ্ঠ সুরটি এবং চিত্রায়ন মুকেশই পেতেন। রফিরও বেশ কিছু গান এ রকম ভাবনা ভাবায়। মান্নাদা নিজে এ সম্পর্কে কী ভাবতেন বা কী বলতেন? একটা চাপা দুঃখ বা অভিমান যে ছিল না তা নয়। কিন্তু মান্নাদা বাস্তবটা বুঝতেন। ‘কি পাইনি’ থেকে ‘কি পেয়েছি’-র গুরুত্ব ছিল মান্নাদার কাছে অনেক বেশি। ১৯৯৭ সালে কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয় মান্না দে-র আত্মজীবনী ‘আমি নিরালায় বসে’। সম্পাদনা আন্দামান প্রবাসী মান্না দে-গবেষক দেবপ্রসাদ দাস। একটা অসাধারণ ভূমিকা লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আত্মজীবনীতে মান্নাদা বলছেন, ‘শ্রোতারা আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন বলেই তাদের এমন মনে হয়, আমি বেশি গান গাইবার সুযোগ পাইনি। আমার নিজের তো ধারণা আমি আমার যোগ্যাতার অনেক বেশি পেয়েছি— মানুষের এত স্বীকৃতি, এত ভালবাসা। যদি কোনও শিল্পীকে মনে করেন যোগ্যতা অনুয়ায়ী প্রাপ্তি সম্মান পাননি, তিনি জি এম দুরানি। কি মিষ্টি কণ্ঠ, গাইতেনও কি অসাধারণ।’ মান্নাদা বহু বার দুরানির কথা বলেছেন। দুঃখ করে বলতেন, ‘অনেক গান-শোনা শ্রোতারাও দুরানির গান শোনা তো দূরের কথা, নামই শোনেনি। সে তুলনায় আমি তো অনেক ভাগ্যবান।’ মান্নাদা বলতেন রাজকুমারীর গানের কথা। তাঁদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধা থাকলে মান্নাদা বলতে পারেন—‘এঁদের সকলের সামনে গাইতে আমারই লজ্জা হত।’ এ কথার পাশাপাশি মান্নাদা আরও কিছু কথা বলেছিলেন—ভীষণ মূল্যবান কথা—‘প্রতিভা থাকাটাই বোধহয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শেষ কথা নয়। যোগাযোগ এবং সেই সঙ্গে কমার্শিয়াল অ্যাটিচুড থাকাটাও বোধহয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য অবশ্যই একটা মেজর ফ্যাক্টর।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy