Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কিরীটী Vs কালো ভ্রমর

সেয়ানে সেয়ানে মহাটক্কর। এ বার ইলামবাজারের জঙ্গলে। সাক্ষী শুধু আনন্দplus। লিখছেন ঋজু বসু।দু’ধারে ঘন শাল বন। বোলপুর থেকে ইলামবাজারের পথে পিচরাস্তা ছেড়ে জঙ্গল ভেদ করে এগোচ্ছে স্করপিও। লাল ধুলো উড়িয়ে এগোতে এগোতেই গুলিগোলার শব্দ। গাছের গায়ে ধোঁয়া। রাইফেল উঁচিয়ে মুখে গামছা-বাঁধা কয়েকটি অবয়ব। শুকনো পাতা মাড়িয়ে ধাবমান কম্যান্ডো-বাহিনী।

বোলপুরে মুখোমুখি: কৌশিক সেন ও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

বোলপুরে মুখোমুখি: কৌশিক সেন ও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৬ ০০:৪৬
Share: Save:

দু’ধারে ঘন শাল বন। বোলপুর থেকে ইলামবাজারের পথে পিচরাস্তা ছেড়ে জঙ্গল ভেদ করে এগোচ্ছে স্করপিও। লাল ধুলো উড়িয়ে এগোতে এগোতেই গুলিগোলার শব্দ। গাছের গায়ে ধোঁয়া। রাইফেল উঁচিয়ে মুখে গামছা-বাঁধা কয়েকটি অবয়ব। শুকনো পাতা মাড়িয়ে ধাবমান কম্যান্ডো-বাহিনী। সম্প্রতি এই যুদ্ধক্ষেত্রেই মোলাকাত তাঁদের সঙ্গে।

নাইন এম এম রিভলভার পকেটে রেখে তখন ফলাহারে ব্যস্ত কিরীটী রায়। আর দুধচায়ের গেলাসে বড় চুমুক দিচ্ছেন ‘কালো ভ্রমর’। রেঙ্গুনের পাহাড়ি গুহা বা কলকাতার চিনেপট্টির এঁদো গলিতে এমন ফুরসত পাননি দুই জাঁদরেল প্রতিপক্ষ। এ বার মুখোমুখি ‘কিরীটী ও কালো ভ্রমর’-ছবির আউটডোরে। অর্ধশতক পার করা সংঘাতটুকু ফের ঝালিয়ে নেওয়ার ফাঁকে ইলামবাজারের শালবনের লোকেশনে সামান্য জিরিয়ে নিচ্ছেন।

ফাস্ট ফরোয়ার্ড

জঙ্গলের মধ্যে একটি পোড়ো বাড়ির ছাদে মুখোমুখি দু’জন। গির্জার ফাদারের পোশাকে কালো ভ্রমরকে পিছন থেকে দেখেও চিনতে ভুল হয়নি কিরীটীর। নাইন এম এম উঁচিয়ে গুড়ি মেরে এগিয়ে ভিলেনের ঘাড়ের কাছে আগুয়ান হিরো। কালো ভ্রমরের সিগনেচার স্টাইলে পর পর খুনের খবর পেয়ে গন্ধে গন্ধে হাজির কিরীটী।

চিরশত্রুর উপস্থিতি টের পেয়ে মুহূর্তের জন্য থমকালেন কালো ভ্রমর। তারপরে ঘুরলেন চকিতে। তাঁর মুখে তখন ঈষৎ ধূর্ত কিন্তু তারিফ-করা হাসি। ‘এই জন্য তোমায় এত ভাল লাগে কিরীটী! ঠিক বুঝতে পেরে চলে এসেছ!’ একটু বাদেই কম্যান্ডো, অরণ্যচারী মুখ-ঢাকা জঙ্গিরাও সিনে ঢুকবে। ফের চেজিং, গুলির লড়াইয়ের আগে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ধারালো সংলাপই ধরতাইটা বেঁধে দিল।

বুনো ওল ও বাঘা তেঁতুল

‘‘এ গল্পটা কিন্তু ‘হুডানিট’ নয়। কে কিরীটী, কে কালো ভ্রমর— দর্শক শুরু থেকে জানে। আর দু’জনের এই লাগাতার টেক্কা দেওয়ার চেষ্টাই মাতিয়ে রাখে।’’--- হাসতে হাসতে বললেন পর্দার কিরীটি মানে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। কিরীটী হবেন বলে খোদ উত্তমকুমারই নাকি মুখিয়ে ছিলেন। তখন পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরিতে হটকেক ‘কিরীটী-সিরিজ’। মাথায় সাড়ে ছ’ফুট, ‘ক্লিনশেভ্ন’, পরিপাটি, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বাঙালি গোয়েন্দা-নায়ক। কিন্তু মহানায়কের মধ্যে ছিটেফোঁটা কিরীটীত্ব খুঁজে পাননি লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত। তাই এক কথায় উত্তমকুমারকে না করে দিয়েছিলেন।

শটের ফাঁকে আজকের ‘কিরীটী’ ইন্দ্রনীল হাসছেন, “ওরে বাবা, শুধু কিরীটী কেন, নীহাররঞ্জন কিরীটীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সুব্রতকে অবধি সাড়ে ছ’ফুট করেছেন।” (এ ছবির ‘সুব্রত’ সমদর্শী দত্ত।) ইন্দ্রনীল বললেন, “আমিও ততটা ভীমাকার নই। তবে আমার অ্যাথলেটিক ফিটনেসটা মনে হয় স্ক্রিপ্টের কাজে আসছে।” কিরীটী-সিরিজের প্রায় পুরোটার স্বত্ব কেনার সময় থেকেই এ ছবির প্রযোজকদের মাথায় ঘুরছিল ইন্দ্রনীলের কথা!

তবে কালো ভ্রমর দিয়ে কিরীটী-সিরিজ সূচনারও অন্য মহিমা। কালো ভ্রমরের দ্বিতীয় খণ্ডে দুর্ধর্ষ দুশমনের মোকাবিলাতেই কিরীটীর জন্ম দেন লেখক। ইন্দ্রনীল তা বিলক্ষণ জানেন। নিজে ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। শ্যুটিংয়ের আগে গোগ্রাসে গোটা কালো ভ্রমর-কাহিনি গিলে শেষ করেছেন। সোজাসুজি বলছেন, “আমি হিরো হতে পারি! কিন্তু কালো ভ্রমর ছাড়া কিরীটী জিরো। কখনও ও জিতছে, কখনও আমি। এমন জোরদার ভিলেন, কৌশিক সেনের মতো অ্যাক্টর হিরোর ওপর একটা পজিটিভ চাপ তৈরি করে!”

‘কালো ভ্রমর’ কৌশিকের মধ্যে কাজ করছে অন্য আবেগ। অনেক বছর আগে রেডিওয় শ্রাবন্তী মজুমদারের পিথ্রি রহস্য-সিরিজে তাঁর বাবা (শ্যামল সেন) করতেন কালো ভ্রমর। “এক দিকে নির্মম গ্যাংস্টার বা রক্তলোলুপ খুনি, অন্য দিকে পরিশীলিত ভদ্র, সংবেদনশীল একটা মানুষ— কালো ভ্রমরের দুটো সত্তা বাবা দুটো আলাদা গলায় ধরতেন। হিংস্র কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভাঙাচোরা, এমন ইন্টারেস্টিং চরিত্র করার আলাদা চ্যালেঞ্জ।”— বলছেন আজকের কালো ভ্রমর।

বলতে বলতেই শট রেডি ...

শট বহুত বড়িয়া থা

ডিওপি হরিন্দ্র সিংহ প্রথমে ক্যামেরা ঘাড়ে শালগাছেই চড়তে যাচ্ছিলেন। নাহ্, জুত হল না ঠিক। কিন্তু ক্রেন তবু ছোঁবেন না চিত্রগ্রাহক। অগত্যা, ১৫ ইঞ্চির একখানা মই জোটাতে জঙ্গল থেকে সভ্যতার দ্বারস্থ ইউনিট।

চিত্রগ্রাহক হরির মতে, ক্রেন, ড্রোন বা জিমিজিবে উঠে শট নিলে সিনের মেজাজটা আসবে না। তাঁর কথায়, “অত মাখনের মতো স্মুদ মুভমেন্ট এখানে চলবে না। দৃশ্যের টেনশন বা মায়াটুকু ধরতে আমি তাই হ্যান্ডহেল্ড শট নিয়েছি। একটু অন্যরকম লেন্সও লেগেছে।” এই জাঙ্গল সিকোয়েন্সটাই ফিল্মের ক্লাইম্যাক্স।

“স্রেফ হিরোর জিত, ভিলেনের হার বলে ধরে নিলে এই ফিল্মের শেষটা বোঝা যাবে না। চাইছিলাম, কিরীটী ও কালো ভ্রমরের ভেতরের সত্তাটাকে ছুঁতে!”—বললেন ছবির পরিচালক অনিন্দ্যবিকাশ দত্ত।

এই সিনটার জন্য বার বার মিটিং হয়েছে। বলিউডি থ্রিলার বদলাপুর-এর লেখক অরিজিৎ বিশ্বাস চিত্রনাট্য রেডি করতেই ১৫ দিনের জন্য মুম্বই পাড়ি দিয়েছিল গোটা টিম। এ ছবির ক্রিয়েটিভ হেড তথা ‘এক হাসিনা থি’, ‘জনি গদ্দার’, ‘বদলাপুর’-এর পরিচালক শ্রীরাম রাঘবনের ইনপুট নেন সক্কলে।

তাতে কী? গোটা ইউনিটই এত দিনে জেনে গিয়েছে, খুঁতখুঁতে হরি খুব সহজে খুশি হওয়ার বান্দা নন। কৌশিক তথা কালো ভ্রমরের পায়ে গুলি খাওয়ার শটটাতেই যেমন। জঙ্গলের কাঁটাঝোপ, কাদায় একে-৪৭ হাতে মরিয়া লড়ছেন কালো ভ্রমর। পায়ে গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ছেন তিনি। সবার ধন্য-ধন্য! হরি বললেন, ‘শট বহুত বড়িয়া থা’!

এত দিনে এটা বলার মানে কী, গোটা ইউনিটের কাছে জলের মতো পরিষ্কার! কৌশিক সেন উঠে দাঁড়িয়ে হাসলেন! “হরি এটা বলার মানে কিন্তু ও স্যাটিসফায়েড নয়। আর একবার শটটা নিতে চায়!”

কন্ডোম ও পটকা

কন্ডোম ছাড়া ফাইট সিন হয় না কি? কিরীটী-কালো ভ্রমরকে রেডি করতে করতে বললেন, পোড়খাওয়া ফাইট মাস্টার শান্তনু পাল। কন্ডোমে লাল রং ভরা হয়েছিল আগেই। তার পরে পিচবোর্ডে মুড়ে পুঁচকে পটকা বিঁধিয়ে জামায় ফিট করা হল। কন্ডোমের আর এক দিকে বাঁধা ইলেকট্রিক তার। গুলি লাগার সময়ে ইলেকট্রিক কানেকশন ঘটিয়ে পটকা ফাটবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সাদা জামা রক্তে লাল। “ছোট পটকা...তবে একটু চিড়চিড় করে কিন্তু”, হাসলেন কালো ভ্রমর।

উলটপুরাণ

রক্তারক্তির পরে লাঞ্চের টেবিলে অন্তরঙ্গ দুই শত্রু। কিরীটী: সেই ‘শজারুর কাঁটা’তেও তো সিরিয়াল কিলার করলে। লোকে শুরুতে খামোখা আমায় সন্দেহ করল। তারপর বুঝল তুমিই ভিলেন। কালো ভ্রমর: সত্যি, সেই ‘ইতি মৃণালিনী’-র চিন্তন নায়ারের পর থেকেই যা চলছে! ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’, ব্যোমকেশ থেকে কালো ভ্রমর অবধি কোনও চরিত্রই সুবিধের লোক নয়। কিরীটী: যা দেখছি, সাইকোপ্যাথ কিলার হয়ে যাচ্ছ কৌশিকদা! কালো ভ্রমর (হাসি): তোমার মিশর রহস্য-র ‘হানি আলকাদি’, কহানি-র ‘মিলান দামজি’ আমার বেশ লেগেছিল। সেখান থেকে কিরীটী আবার অন্য ট্রানজিশন।

কিরীটীর ম্যারাথন

দেড় দিন ধরে জঙ্গলে হাড়ভাঙা খাটুনির পরে সন্ধেয় কোথায় গেলেন ‘কিরীটি’? বোলপুরে ক্যামেলিয়া হেরিটেজ হোটেলে খুঁজে হয়রান ডান হাত সুব্রত ওরফে সমদর্শী দত্ত। রাত সাড়ে আটটায় ছবির প্রযোজক রূপা দত্তের পার্টির নেমন্তন্ন। দেখা গেল ঠিক সময়ে পার্টিতে অ-কিরীটী সুলভ ক্যাজুয়াল ওয়্যারে হাজির ইন্দ্রনীল।

সব শুনে গোটা ইউনিট, হতবাক! ‘‘তার মানে কালকের লোকেশন দেখে গাড়িতে ফেরার সময়ে বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস দিয়ে যে লোকটাকে ছুটতে দেখলাম, ওটা তুমি ছিলে!’’— বললেন অনিন্দ্য। হোটেলে ফিরে প্রান্তিক স্টেশন থেকে বোলপুর ছুঁয়ে বিশ্বভারতী পাক খেয়ে জগিং করে ফিরে এসেছেন ইন্দ্রনীল। বেশি না, ১০ কিলোমিটার কভার। ঘণ্টাখানেকের মামলা। পার্টিতে স্কচের গেলাসে ঠোঁট ছুঁইয়ে কিরীটী রায়ের হাসি, “আমি কিন্তু লাইফটা এনজয় করি। রাতে পেটপুরে খাব! আবার কাল ভোর তিনটেয় উঠব। পাঁচটায় মেকআপের কলটাইমের আগে ঘণ্টা দুই ফ্রি হ্যান্ড করে নিতে হবে। এটাই আমার নেশা।”

মিসেস কে

নীহাররঞ্জন ‘কৃষ্ণা’ নাম রেখেছিলেন। ইউনিটে তিনি ‘মিসেস কে’। এ চিত্রনাট্যে কৃষ্ণার সঙ্গে প্রেম-বিয়েটিয়েও হচ্ছে কিরীটীর। সেই ‘মিসেস কে’ ওরফে অরুণিমা ঘোষ ও কালো ভ্রমর মুখোমুখি সান্ধ্য পার্টির আসরে।

‘‘উফ্, বাবানদা (কৌশিক) যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমায় কিডন্যাপিং সিনটায়।’’ তাতে কালো ভ্রমর কৃষ্ণাকে অপহরণ করার পরে তাঁর বন্দুকটা তুলে গুলি করতে যাবেন অরুণিমা। কৌশিক বললেন, ‘‘শ্যুটিং ফেক বুলেটেই হয়। কিন্তু বেচারিকে মজা করে বলেছিলাম, সাবধান থাকিস, পিছন দিকে পিস্তলটা ব্যাকফায়ার করে।’’ শুনে রাগী-রাগী ভঙ্গি অরুণিমার।

লিগামেন্ট ক্যাপ

ইলামবাজারের জঙ্গলে দৌড়ঝাঁপে ক’মাস আগে ‘জুলফিকার’-এর শ্যুটিংয়ের পুরনো ব্যথাও কাবু রেখেছে কালো ভ্রমরকে।
কৌশিক বলছিলেন, শালিমারের শিপ ইয়ার্ডে অ্যাকশন করতে গিয়ে লোহালক্কড়ের ওপরে পড়ে কেলেঙ্কারি। কেটেকুটে টিটেনাস-যন্ত্রণা! তার উপরে মাথা বাঁচাতে হাতে ভর দিয়ে পড়ে আর এক গেরো। পার্টিতে ইন্দ্রনীলকে দেখিয়ে হাসলেন, “কিরীটীর সঙ্গে টক্করে ব্যথাটা ফের ভোগাচ্ছে। যত দূর সম্ভব হাতে লিগামেন্ট ক্যাপ পরে থাকছি। যাই, ডিনারটা বরং ঘরেই সারব!” হোটেলের জ্যোৎস্না-ভেজা লনে কিরীটীকে ‘গুড নাইট’ বলে ঘরে চললেন হিংস্র ‘মুনলাইট কিলার’ কালো ভ্রমর।

পরের দিন সাতসকালে বোলপুর থেকে ম্যাসাঞ্জোর-যাত্রা। সেখানে ফের কালো ভ্রমরকে জম্পেশ চেজিং সিন কিরীটীর। হোটেলের লনে দিনশেষে খুশিয়াল ফিল্ম ইউনিটের কাছে যদিও তখনও ‘নাইট ইজ কোয়াইট ইয়ং’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE