Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বসন্ত এসে গেছে

ফোটে পলাশ। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দেয় তার রঙের জেল্লা। ফুলের যে কতখানি আগুন থাকতে পারে, পলাশ না থাকলে আমরা কি তা বুঝতাম? বসন্তের হিসেবনিকেশে বসলেন শ্রীজাত।ফোটে পলাশ। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দেয় তার রঙের জেল্লা। ফুলের যে কতখানি আগুন থাকতে পারে, পলাশ না থাকলে আমরা কি তা বুঝতাম? বসন্তের হিসেবনিকেশে বসলেন শ্রীজাত।

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৬ ০০:৩৫
Share: Save:

একটা হাওয়া ছিল, যার নাম আমি রাখতে পারিনি কোনও দিন। নাম রাখতে গেলে তো বুঝতে হয় তাকে, সেই বোঝাটা হয়ে ওঠার আগেই সে দিব্যি পালিয়ে যেত। কেননা সে ছিল বসন্তের হাওয়া। খুব বেশি দিন এক জায়গায় তার থাকবার কথা নয়। কেবল এইটুকু বুঝতাম, সে এলে সব কিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে এক লহমায়। পাহাড়ি ঝর্না যেমন ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মুহূর্তটুকুও টের পেতে দেয় না, ঠিক তেমনই সে পলক ফেলবার আগেই আমাকে নিয়ে চলে যেতে পারে বুকের চিনচিন ব্যথা আর টিমটিম আলোর পাশে, যেসব রাস্তা আমি এড়িয়ে চলেছি সারাটা বছর।

ভেসে যাবার মুহূর্তটায় আর কিছু করবার থাকে না ঠিকই, কিন্তু এও ঠিক, শীত কমতে থাকাকালীনই আশ্চর্য সেই হাওয়ার অপেক্ষা শুরু হয়ে যেত ভেতর ভেতর। আমাদের কম বয়সে কলকাতায় ভালই ঠান্ডা পড়ত, তার ওপর আমার জ্বরজারির ধাত। অতএব আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে রাস্তায় বেরনোটাই ভবিতব্য ছিল।

সে একরকমের বন্দিদশাই। তাই শীত পেরিয়ে বসন্ত এলে আমি স্বাধীনতার স্বাদ আর গন্ধ পেতাম। সমস্ত ধড়াচুড়ো ছেড়ে ফিনফিনে একখানা ফতুয়া পরে পাড়া চষে বেড়ানোর স্বাধীনতা। বাড়িতে ফিরে রেগুলেটর ২-এ দিয়ে ফ্যান চালানোর স্বাধীনতা। এবিটিএ-র টেস্ট পেপারকে নেহাত বসন্তের তাচ্ছিল্যে সল্ভ করার স্বাধীনতা। আর হ্যাঁ, তার বাড়ির গলির আশেপাশে বুক চিতিয়ে হেঁটে বেড়ানোর স্বাধীনতাও বইকি।

ওই মাথাখারাপ-হাওয়াই আমার কানে কানে দুঃসাহসের মন্তর দিত। ঝিরঝিরে বসন্তের ওই পাগল হাওয়াই আমাকে ছুটিয়ে মারত। আমি রোজ সন্ধেবেলা অটো ধরতাম, সাড়ে তিন টাকা ভাড়া দিয়ে নামতাম স্বপ্নের পরের স্টপেজে। তখন অবশ্য জানি না, পুরো রাস্তাটাই ঘুমিয়ে পড়বে একদিন, যে-শীতঘুম আর কখনও ভাঙবে না। জয় গোস্বামী তাঁর কবিতায় একবার লিখেছিলেন, ‘ছোট ছোট বাড়ি, একতলা পাড়া / ভোরবেলা বাবা ডিউটিতে গেলে / বাড়িতে মায়ের কোমল পাহারা’। পাহারা’র আগে কোমল বসানোর জাদু জয়ই জানেন কেবল। সেই জাদু আমি তখন চোখে দেখতে পেতাম। তখনও এত আলো ঝলমলে হয়ে ওঠেনি মধ্যবিত্ত কলকাতা। তখনও লোডশেডিং ছিল ছোট ছোট পাড়াদের অলংকার। তার পাড়াটাও ছিল ঠিক তেমনই। ছোট ছোট একতলা বাড়ি দিয়ে সাজানো মধ্যবিত্ত ঝুলন, যার সন্ধেবেলার নাম বিনুনি। আর তার বাড়িতেও মায়ের কোমল পাহারাই থাকত সারাক্ষণ। আমরা তার মাকে একটু সমঝেই চলতাম। সেইসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং-পড়া তার গম্ভীর দাদাটিকেও। কিন্তু পরিখা বা পরীক্ষা, প্রেম কোনও কিছু দিয়েই আটকানো যায় না। তাই আমার অন্তত কয়েকখানা বসন্ত ছদ্মবেশী রাখাল সেজে সেই পাড়ার মাঠেঘাটেই কেটে গেছিল।

সেই ছোট বয়েসে, প্রেমে পড়া আর প্রেমে পড়ে থাকাকেই এত অনিবার্য সুন্দর আর রহস্যময় মনে হত আমার যে, প্রেমিকা পাত্তা দিচ্ছে কি দিচ্ছে না, সে নিয়ে কমই ভাবতাম। অবশ্য আমাকে যে কোনও মেয়েই বিশেষ পাত্তা দেবে না, এ আত্মবিশ্বাস আমার বরাবরই ছিল। কিন্তু আমি তো পাত্তা দিচ্ছি তার আধখোলা জানলাকে, বসন্তের হাওয়ায় উড়তে থাকা গোলাপি সুতির পর্দাকে, জানলার ওপাশে চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে তার অঙ্ক কষাকে। আর হঠাৎ ক্যালকুলাসে ভুল হলে চুল সরিয়ে জানলার বাইরে তাকানোকেও। এই সবই তো ধরা থাকছে আমার বসন্তের কবিতার পাতায় পাতায়। এই সবই তো আমার চেনা বানানগুলো ভেঙে দিচ্ছে বারবার। এই সবই তো সেই স্বপ্নের অন্তর্গত, যার ডাকনাম বাসন্তী।

এই যে আমি আমার কথাই বলে চলেছি এতক্ষণ, এ আসলে আমাদের সক্কলের কথা। আমরা বন্ধুবান্ধবীরা ওই ক্যালকুলাসের রাফ খাতায় কত যে গোপন চিঠি লিখেছি, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। প্রেয়ারের জাফরি কাটা বারান্দায় কত খোলা পিঠের রোদ্দুর যে আমাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছে, তার হিসেব কে রাখবে? গার্জেন কল-এর পরের পিরিয়ডে কত ঠান্ডা হাত আমাদের জলপট্টি পরিয়েছে, তা কি আর মনে আছে? এসবের মধ্যেও কিছু পিঠে আমরা নাম লিখেছি, কিছু হাতে গুঁজে দিয়েছি ভুল বানানের চিঠি, কিছু ইউনিফর্মের আঁচলে নির্দ্বিধায় মুছেছি ঘেমো কপাল। যে-কপাল আদতে পোড়াই ছিল গোড়া থেকে।

তখন কিন্তু পলাশ ফুটত খুব। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে ছোটাত তার রঙের জেল্লা। ফুলের যে কতখানি আগুন থাকতে পারে, পলাশ না থাকলে আমরা কি তা বুঝতাম? প্রতি বসন্তে পলাশের রুটম্যাপ আমাদের ঠোঁটস্থ ছিল। ঠোঁটে আগুন না নিতে পারলে প্রেমিকজন্ম বৃথা যে! তাই আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার শখ আমরা মিটিয়ে নিতাম পলাশের দৌলতে। একেকটা রাস্তায় পলাশ পড়ে থাকত অগুনতি। দূর থেকে দেখে মনে হত রাস্তায় কেউ আগুন ঢেলে দিয়েছে। কাছে গেলে বুঝতাম আগুনের রাস্তাটা আসলে বুকের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করেছে। আগে বুঝতে পারিনি।

কত কত স্কুলফেরত বসন্তের হু হু বিকেলবেলা পলাশের বিলাসিতা কুড়িয়ে নিতে নিতেই বাড়ি ফিরেছি। একটু নাহয় ঘুরপথই হবে, কিন্তু সেই অছিলায় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকা তো হবে আরেকটুক্ষণ। কোনও কোনও দিন তার মর্জি হলে, মেজাজ ভাল থাকলে, দু’একটা পলাশফুলের সুযোগ জুটে গেছে তার ছোট্ট খোঁপায় হাজিরা দেবার। আর সেইসব অভিজাত গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আমরা একটা করে লাল চা খেয়েছি, সঙ্গে মিঠে আঠার প্রজাপতি বিস্কুট।

তখন সবে সন্ধে নামছে। হাওয়াটা আমাকে ঠেলে তার এত কাছে নিয়ে যাচ্ছে যে একটু পরে জড়িয়ে ধরা ছাড়া উপায় থাকবে না আর। কিন্তু ওই ঝড়ের মুখে ঠোঁটকে কেবল চায়ের চুমুকে আটকে রাখাটাই তো প্রেমিকের শিল্প, শিল্পীর সংযম। তখন, ঠিক তখন যে-হাওয়াটা দিত, পরে বুঝেছি, রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেই হাওয়াটার কথাই লিখে গিয়েছেন তাঁর গানে। ওই যে, যেখানে লিখছেন, ‘ফাগুন করিছে হা হা ফুলের বনে’... আমি তো দেখেছি সেই ফুলের বন! সেসব অস্থির হয়ে ওঠা অপারগ ফাগুনকেও আমি দেখেছি তো। তখন গানটা শুনে ভাবতাম, এমন চমৎকার একখানা প্রেমের গানে দুম করে ‘হা হা’ কথাটা লিখে বসলেন কেন রবীন্দ্রনাথ? এখন, এই চল্লিশে এসে বুঝি, হাওয়ার ওই অস্থিরতার পাগলামোকে ‘হা হা’ ছাড়া আর কোনও ভাবেই বোঝানো যেত না। হাওয়া দিত ফুলের বনে, আর সত্যি সত্যিই বুকের ভেতরটা হা হা করে উঠত। ঠিক যেমন এর আগের লাইনেই উনি লিখছেন, ‘বিধুর বিকল হয়ে খ্যাপা পবনে’। বিধুর আর বিকল-কে পাশাপাশি বসাতে গেলে একজন মানুষকে রবীন্দ্রনাথ হতে হয়। আর ফাল্গুনের পবন? তাকে খ্যাপা ছাড়া আর কীই বা আখ্যা দেওয়া যায়? আমাদের সক্কলের বসন্তের বিকেলবেলার চিনচিন বুকের বাঁদিক ওই দুটো লাইনেই বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন চিরপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ।

বিশু পাগলের কবিতা

বিপদ আবার ডাক দিয়েছে, দমকা বাতাস...আলগা বোতাম...বসন্তকে সাক্ষী রেখে আজ যদি ফের সঙ্গী হতাম?

একখানা দিন ওলট পালট, একখানা বেশ ঝাপটা বিকেলপাগল হওয়া বিশুই কেবল সামলে রাখে নন্দিনীকে।

যা ইচ্ছে তাই বলুক লোকে, নিন্দুকে আর কী না রটায়অনামী সেই বাস স্টপেজে দেখা হবেই পৌনে ছ’টায়।

একটু হাঁটা, একটু চলা, একটু বসা পাড়ার রোয়াক...মিথ্যে একটা আঙুল তোমার কপালে আজ সত্যি ছোঁয়াক।

এই দেখা তো মুহূর্ত নয়, অন্যরকম অনন্তকালমাথার মধ্যে গুমরে মরে পাগলা হাওয়ার একলা পোকা।

ফিরবে তুমি ভিড় বাসে আর আমার ফেরা চুপবালিশেচোখের পাতা কমল কি না, কে আর অত রাখছে হিসেব...

কেবল তোমার ফুলের মালা, রাজার দিকে সপাট জেহাদ –যুগ পেরিয়ে আরেকটিবার আমার হাতে দিও সে হাত...

হাতের রেখায় থাকবে জানি মাইলফলক, সরাইখানা...কৃষ্ণচূড়ার ছোট্ট চিঠি, রাধাচূড়ার বলতে মানা

বিপদ আসুক, লাগুক বাতাস, ছুটুক সময় তোমার দিকেপাগল হওয়া বিশুই জেনো আগলে রাখে নন্দিনীকে!

আমি অবশ্য আবিরে একটু ভয়ই পেতাম, কিন্তু ওই একটি দিন সুযোগ নিতাম অজুহাতের। জানি না, বাড়ি ফিরে আর পাঁচজন বন্ধুর থেকে আমার ছোঁয়াকে আলাদা করে মনে করতে পারত কিনা সে। পারার কোনও কারণ ছিল না যদিও। আমি গোড়া থেকেই জানতাম, বসন্তের সেই ছদ্মবেশী পাড়া আসলে মিথ্যে ছিল। মিথ্যে ছিল আমার সেই জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা। মিথ্যে ছিল আমার একফোঁটা আশা যে সে একদিন হলেও চিঠির উত্তর নিয়ে এসে দাঁড়াবে সামনে, নিজেই আমার সমস্ত চিঠির উত্তর হয়ে। সত্যি ছিল কেবল খ্যাপা পবনের সেই বসন্ত, যে পরিযায়ী পাখির মতো প্রতি বছর ঠিক ওই সময় আমাদের পাড়ার রাস্তা চিনে এসে পড়ত, আর আমাকে টানতে টানতে বার করত ঘর থেকে। সত্যি ছিল সেই পলাশে ছেয়ে থাকা রাজপথ, যা কোনও দুঃখের তোয়াক্কা করত না কোনও দিন। আর সত্যি ছিল ক্যালকুলাসের সেই মিলতে-না-চাওয়া অঙ্কটা, যে সাক্ষী ছিল এই সমস্ত কিছুর।আমাদের সেইসব ফুল কুড়নোর রাস্তার শেষ মোড় ছিল দোল। ঠিক দোল নয়, দোলের আগের দিন। তখনও বাতাসে একটা শিরশিরে রোমাঞ্চ ডাক দিচ্ছে, তখনও রুমালগুলো ভেজা ভেজা। দোলে তো ছুটি থাকবে স্কুল, তাই আগের দিন স্কুল ছুটির পর প্রাণের শখ মিটিয়ে স্কুলের মাঠে দোল খেলে নেওয়া। এখনও নিশ্চয়ই সব স্কুলেই হয় এমনটা। আর ওই একটা দিনই আনমনা অধিকার এনে দেয়, নির্দ্বিধায় তার দূরতম গাল আর কপালে হাত ছোঁয়ানোর। এই রাজকীয় অথচ রাখালিয়া সুযোগ কেবল বসন্তই দিতে পারে প্রেমিককে, আর কেউ না।

তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। এখন বুঝতে পারি, বিস্কুট বিস্কুটই। তার প্রজাপতি সাজা মানায় না। সুমন গেয়েছিলেন, ‘চল্লিশ পেরোলেই চালশে’। আমার ৩৭ থেকেই সব ঝাপসা। কাছেরও, দূরেরও। আর সে জন্যে যে-চশমা পরতে হয়, তার লেন্সের নাম ‘প্রগ্রেসিভ’। দৃষ্টির প্রগতিশীলতার এর চাইতে ভাল উদাহরণ আর কীই বা হতে পারে।

এখন আমাদের সেলিমপুরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালে দূরে টিমটিম করে হাইরাইজের উষ্ণ আলো। এবার ফেব্রুয়ারি’র শেষে বসন্তের তাপমাত্রাও ছিল সেই ৩৭। বসন্তেরও কি তাহলে চালশে পড়ল চোখে? কে জানে। কেবল এটুকু বুঝতে পারি, এই চল্লিশের ঝাপসা বসন্তে পলাশের চেয়ে লাশ চোখে পড়ে বেশি। দূরের রাস্তায় বিছিয়ে থাকা সেই আগুনকে কাছে গেলে চিনতে পারি, টাটকা রক্তের ছোপ হিসেবে। কিন্তু তা বলে কি নতুন করে পাগল হচ্ছে না কেউ? উচ্চ মাধ্যমিক বাজি রাখছে না সন্ধেবেলার একটা গলির কাছে? টুকরো চিঠির জুয়ায় হাত পাকাচ্ছে না আস্তে আস্তে? ডুবন্ত জাহাজের রেলিং ধরে হাওয়ার সামনে বুক চিতিয়ে চিৎকার করে বলছে না, ‘আমি ভালবাসি তোমাকে’? বলছে। আর বলছে বলেই আজও কিছু জানলা খোলা, যাদের ডাকনাম বসন্ত।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল; মডেল: দেবলীনা কুমার ও অরিজিৎ বসু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

spring srijato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE