Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল

‘নতুন ফসল’ ছবির সেটে বেণুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। আমি তখন সবে পা রেখেছি ইন্ডাস্ট্রিতে। বেণুও প্রায় নতুন। ওখান থেকে আলাপ, বন্ধুত্ব।

‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে বিশ্বজিৎ ও সুপ্রিয়া

‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে বিশ্বজিৎ ও সুপ্রিয়া

বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সকালে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড দেখার জন্য টিভি খুলেছিলাম। তখনই খবরটা দেখলাম। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। বেণুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। তখন কলকাতায় এলে প্রায়ই ও আমাকে ডেকে ডেকে খাওয়াত। শুটিং করে ফেরার পথে ওদের বাড়ি হয়ে ফিরতে হতো। বলত, ‘আমাকে তো দাদার জন্য রান্না করতেই হয়। তুইও খাবি দাদার সঙ্গে।’ নিজে রান্না করত। বলত, ‘বম্বেতে তো ভাল মাছ পাওয়া যায় না, তুই এখানে ভাল করে খা।’ ওর বানানো ইলিশের পাতুরি আমার খুব প্রিয় ছিল। আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি তো আমার আর উত্তমদা’র দু’জনেরই পছন্দের। পূর্ব বাংলার মেয়ে তো! মাছ রান্নার হাতখানা চমৎকার ছিল... এগুলোই মনে পড়ে যাচ্ছে সকাল থেকে।

‘নতুন ফসল’ ছবির সেটে বেণুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। আমি তখন সবে পা রেখেছি ইন্ডাস্ট্রিতে। বেণুও প্রায় নতুন। ওখান থেকে আলাপ, বন্ধুত্ব। তার পর আমি বম্বে গেলাম। ওখানে কাজ করছি। বেণুও গিয়েছিল একটা হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের জন্য। তার পর ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে আর একটা ছবি করল। সে সময় জুহু হোটেলে আমি ছিলাম। বম্বেতে সেটাই তখন বড় হোটেল। বেণু আমাকে বলল, ‘বিশু, নতুন একটা হোটেল খুলেছে, সান অ্যান্ড সান। ফাইভ স্টার হোটেল। আমাকে প্রোডিউসার এখানে রেখেছে। তুইও চলে আয়।’ এতটাই আন্তরিক ছিল ও। তখন সোমাও আসত বেণুর সঙ্গে। সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা। সোমা আমাকেও খুব ভালবাসত। এর পর আমরা ‘চৌরঙ্গী’ করি। গ্র্যান্ড হোটেলেই বেশির ভাগ শুটিং হয়েছিল। কাজের পর খাওয়াদাওয়া, আড্ডা এই সব তো চলতই। বেণু খুব ভাল নাচতে পারত। সেই জন্য ‘আম্রপালী’ ছবিটায় ওকে নেওয়া হয়েছিল। চরিত্রটায় খুব মানিয়েও ছিল। কী সুন্দর চেহারা! লোকে তাকিয়ে থাকত ওর ছবির দিকে।

মানুষকে আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল বেণুর। তবে ওর সঙ্গে আমার ঝগড়াঝাঁটিও হতো অনেক। দু’-চার দিন কথা বলতাম না। আসলে খুব ইমোশনাল ছিল ও।

মনে পড়ে যাচ্ছে উত্তমদার জন্মদিনের পার্টির কথা। এলাহি ব্যাপার হতো। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে আমি, শ্যামল মিত্র, বুড়ো (তরুণকুমার), মানবেন্দ্র... সারা রাত পার্টি চলত। উত্তমদা রবীন্দ্রসংগীত গাইছে। বেণু কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই রান্নাঘর সামলাচ্ছে। মাঝেমাঝে এসে জয়েন করছে। আবার আমার জন্মদিনের পার্টিতেও ওরা আসত। নাচ, গান, খাওয়াদাওয়া, ড্রিঙ্ক... সে সব এক অদ্ভুত আনন্দের দিন ছিল।

আর একটা কথা আমি অবশ্যই বলব, ও উত্তমদার যে ভাবে সেবা করেছে, ভাবা যায় না। সময় ধরে ওষুধ খাওয়ানো, বিশ্রামের খেয়াল রাখা... ‘না, উত্তমদা এখন শট দেবে না। ডক্টর রেস্ট নিতে বলেছেন।’ উত্তমদার ডায়েট, কোন সুট পরে কোথায় যাবেন, কোন জুতো পরবেন, সমস্ত কিছু...

নকশাল পিরিয়ডে উত্তমদা এক কাপড়ে মুম্বইয়ে পালিয়ে এসে উঠেছিল আমার বাড়িতেই। সন্ধেবেলা আমি আর প্রদীপকুমার ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখি বেণু। বলল, ‘দ্যাখ, কে এসেছে।’ দেখি ওর পিছনে উত্তমদা। আমি চিনতে পারিনি দাদাকে। চুল দেখেই উত্তমকুমারকে চেনা যায়। কিন্তু দাদার সে চুল কদম ছাঁট! সে সময় মেকআপ রুমে ঢুকে দাদাকে থ্রেট করা হয়েছিল। স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে চুল কেটে ফেলে উত্তমদা, যাতে ট্রেনে কেউ চিনতে না পারে। সে দিন এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল! ‘জানিস বিশু, যা ঘটেছিল দাদা হার্ট ফেল করে যেতে পারত। হার্টের সমস্যার জন্য প্লেনে ওর চড়া বারণ। তাই আমি কোনও চান্স নিইনি।’ ট্রেন ধরে বম্বে চলে আসে ওরা। পরিস্থিতি ঠিকঠাক হলে ফিরে যায়।

তার পর ‘রক্ততিলক’ ছবিটা করার সময় আমি বেণুকে অভিনয়ের কথা বলি। ও রাজি হয়ে যায়। ভাই-বোনের গল্প ছিল। বেণু আমাকে বলে, ‘বিশু, তুই ছবিতে আমার হাজব্যান্ডের রোলে দাদাকে ভাবছিস না কেন? ওর স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়েছে।’ এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে! কাজের সময় ও খুব সিরিয়াস। যেটা বোঝানো হতো, সেটা হান্ড্রেড পারসেন্ট করত। আমাকে বারবার বলত, ‘বিশু, ঠিক আছে তো? না হলে বল, আবার শট দেব।’ তখন তো সুপ্রিয়া বিরাট বড় স্টার। এতটা না করলেও চলত। আমার সঙ্গে সুপ্রিয়ার শেষ ছবি ‘শেষ অধ্যায়’। বেশ কয়েক বছর আগে শুটিং করেছিলাম। আমার মায়ের চরিত্রে ছিল ও। তখন ‘জননী’ করে ও খুব জনপ্রিয়। আমার এক সময়ের হিরোইন কিনা আমার মায়ের ভূমিকায়! সে ছবি আর কোনও দিন শেষ হবে না।

অনুলিখন: পারমিতা সাহা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE