Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ছবি দেখুন ট্যাক্সি ভাড়া লাগবে না

দর্শককে হলমুখী করতে মুম্বইতে ছবির প্রোমোশনে নতুন চমক। রাজু হিরানি থেকে সুজিত সরকার সকলেই কমাতে চাইছেন ছবির প্রচারের বাজেট। লিখছেন নাসরিন খান ও স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।দর্শককে হলমুখী করতে মুম্বইতে ছবির প্রোমোশনে নতুন চমক। রাজু হিরানি থেকে সুজিত সরকার সকলেই কমাতে চাইছেন ছবির প্রচারের বাজেট। লিখছেন নাসরিন খান ও স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

প্রিয়ঙ্কা চোপড়া-রণবীর সিংহ অভিনীত ‘দিল ধড়কনে দো’-যদি দেখতে চান তা হলে ট্যাক্সি ভাড়া কিন্তু লাগবে না। নিখরচায় সিনেমা হল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে একটি বেসরকারি পরিবহণ সংস্থা। রণবীর কপূরের ‘বম্বে ভেলভেট’ ছবির এক্সক্লুসিভ প্রিভিউ হট স্টার মোবাইল অ্যাপে দর্শকেরা অনায়াসে দেখতে পেয়েছেন। দেড় কোটি দর্শকের কাছে সেটা পৌঁছেছিল এই ভাবে। তবে অত সংখ্যক দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে ‘বম্বে ভেলভেট’ দেখেছেন কিনা তার কোনও হিসেব পাওয়া যায়নি। গত বছর শাহরুখ খান ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ছবির ট্রেলর দর্শকদের মোবাইলে সরাসরি পৌঁছে দিয়েছিলেন হোয়াটসঅ্যাপ মারফত।

এখন শুধু টিভি সিরিয়াল, রিয়েলিটি শো, খবরের কাগজের ইন্টারভিউ বা স্টেজ শো করে সিনেমার বিজ্ঞাপনী প্রচার শেষ হয় না। স্টারেরা সিনেমার চরিত্রের মতো জামাকাপড় পরেও প্রচারে নেমে থাকেন। কিন্তু এগুলোই যথেষ্ট নয়। ছবির শ্যুটিং শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াতে সিনেমার একটা নিজস্ব প্রোফাইল তৈরি হয়। তার মাধ্যমে শ্যুটিংয়ে কখন কী হচ্ছে না হচ্ছে তার একটা নিয়মিত আপডেট দেওয়া শুরু হয়ে যায়। এখন সরাসরি সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগায়োগ করছেন তারকারা।

স্কুলে, কলেজে, সিনেমা হলে গিয়ে ফ্যানেদের সঙ্গে সেলফি তোলাটা একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ তো ছবি রিলিজের সময় একটা আস্ত ডান্স রিয়েলিটি শো করেছিল। শুধু তাই নয়, সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেরিয়ে ছবির প্রচার, করেছিল স্টেজ শো করে। ছবি রিলিজ করেছিল বিভিন্ন দেশের ভাষায়। সিনেমা তিনশো কোটির ক্লাবে পৌঁছেছিল এই বিরাট ক্যানভাস জোড়া মার্কেটিং স্ট্র্যটেজিতে।

যে কোনও ছবি রিলিজের আগে নানা ভাবে প্রচার শুরু হয়। পয়সা দিয়ে ভাল কাগজে লেখা থেকে সমালোচনা বের করা কি না থাকে এই প্রচারাভিযানের তালিকায়। শুধু তাই নয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি প্রশংসায় মাতে ওই ছবিতে কাজ করেনি এমন শিল্পী-কলাকুশলীরাও।

প্রশ্ন একটাই, এত রকম কর্মকাণ্ড না করলে কি লোকে ছবি দেখতে যাবে না? পরিচালক সুজিত সরকার বলছেন, ‘‘আগে দশ কোটি টাকার ছবি হলে ন’কোটি টাকা প্রমোশনের বাজেট হত। এটা করতে গিয়ে দেখা গেল ভাল ছবি করেও মুম্বই ইন্ডাস্ট্রি তার প্রফিটটা তুলতে পারছে না। প্রোমোশনের জন্য তারকাদের নিয়ে যে শহরে শহরে ঘোরার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল তাতেও দেখা গেল জনসাধারণ তারকাদের শপিং মলে নাচতে দেখে আবেগতাড়িত হয়ে তাঁদের সঙ্গে সেলফি তুলে বেড়াচ্ছে। কই ছবি তো দেখতে যাচ্ছে না। রাজু হিরানি, কর্ণ জোহরের মতো পরিচালকেরাও ছবির প্রোমোশনটাকে ডিজিটালি রাখতে চাইছে, তাও একেবারে নিখরচায়।’’

সুজিতের কথা হুবহু মিলে যাচ্ছে ‘পিকু’র বক্স অফিস সাফল্যতে। অমিতাভ বচ্চন-দীপিকা পাড়ুকোনের ‘পিকু’ ছবিতে এত বড়সড কোনও প্রচারের দরকার হয়নি বলে প্রচারের বাজেটটাও কম ছিল। তা সত্ত্বেও ছবি হিট হয়েছে। ‘দিল ধড়কনে দো’ ছবির ক্ষেত্রেও প্রমোশন নিয়ে জোয়া আখতার কোনও বাড়াবাড়ি করেনননি। ট্রেলর লঞ্চের পার্টি তো দূরে থাক, নিজের বাড়িতে ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ডেকে ট্রেলর দেখিয়ে দিয়েছেন। ভট্ট দুর্গের মহেশ ও মুকেশ, তাঁদের ছবি ‘খামোশিয়া’র জন্য আলাদা কোনও সিটি ট্যুর বা গালা প্রমোশনের পথে যাননি।

২০১১ সালে ‘রা.ওয়ান’ ছবির শুধু প্রোমোশনের বাজেট ছিল ৫২ কোটি টাকা। এখন সিন পাল্টেছে। এত টাকা এখন ছবির প্রচারের জন্য ব্যয় করা হয় না। পরিচালক রাজু হিরানি বলছেন ‘‘কোনও সিনেমা বানাতে যদি পাঁচ কি ছ কোটি টাকা লাগে। তা হলে প্রচারের জন্যও আরও পাঁচ-ছয় কোটি টাকা লাগবে। আর সেই জন্য আজকের সিনেমায় লাভ অনেক কম।’’

তাই বোধ হয় ‘পিকে’ ছবির জন্য খুব বেশি প্রচারে নামেননি রাজু হিরানি এবং তাঁর প্রযোজক সংস্থা। দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমিরের খালি গায়ে ট্রানজিস্টার হাতে বিজ্ঞাপনই তাঁদের প্রচারের মূলধন হয়ে ছিল। ‘ধূম থ্রি’তেও আমির খান খুব বেশি প্রচারে নামেননি। তার আগে ‘থ্রি ইডিয়টস’য়ের প্রচারে ছিল অন্যরকম স্ট্র্যাটেজি। আমির ছদ্মবেশে ভারতের নানা শহরে ঘুরেছিলেন আর সেটাই ছিল প্রচার।

ব্যয়বহুল প্রচার দিয়ে যে সিনেমার ভাগ্য নির্ধারণ করা যায় না এই কথা স্বযং অমিতাভ বচ্চনও বলেছিলেন ‘পিকু’ ছবির প্রচারেরের সময়। তিনি ‘পিকু’ রিলিজের আগে তাঁর ওই সিনেমার একটি বিশেষ লুক-য়ের ছবি ট্যুইট করেছিলেন। সেই ট্যুইটয়ের জন্য তোলপাড় শুরু হয়েছিল তাঁর অন্য প্রজেক্টের বিপণন টিমগুলোতে। তখন অমিতাভ তাঁর ব্লগে গিয়ে লেখেন যে, ‘‘আমি মনে করি যতই বিপণন নিয়ে নানা রকম পরিকল্পনা হোক না কেন, প্রচারের টিম যতই জিনিয়াস হোক, ছবিতে যদি দম না থাকে খারাপ ছবিকে শুধু প্রচার দিয়ে ভাল করা যায় না।’’

ঠিক ওই কথা বলেছিলেন আমির খানও কিছু দিন আগে এক ইন্টারভিউতে। তাঁর মতে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি আর তারকার আকর্ষণে প্রথম তিন দিন লোকে ছবি দেখতে আসতে পারে। ‘‘তিনদিনের পর কথা বলে ছবির বিষয় এবং গুণগত মান,’’ বলেছিলেন আমির।

এই প্রসঙ্গে ‘দাওয়াত এ ইশ্ক’ আর ‘দম লাগাকে হ্যাইসা’ খুব ভাল উদাহরণ হতে পারে। দুই ছবি একই ব্যানারে তৈরি। ‘দাওয়াত এ ইশ্ক’য়ের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করা হয়েছিল। খাবার দাবার নিয়ে ‘ফুড যাত্রা’ আর রোড শো করে ছবির প্রচার হয়েছিল ‘দাওয়াত এ ইশক’য়ের। তাতে কিন্তু ছবির প্রথম কয়েক দিনের কালেকশনে কোনও প্রভাব পড়েনি। উল্টো দিকে ‘দম লাগাকে হ্যাইসা’ ছবির জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। তা সত্ত্বেও ওই ছবি দর্শকদের টেনেছিল হলে। তার মানে এটাই দাঁড়ায় যে কাহিনি আর গুণগত মান ভাল হলে ছবি আপনা থেকেই ব্যবসা ভাল করবে।

‘কনটেন্ট’ ই আসলে ছবির আসল প্রচার। ট্রেলর, গান, পোস্টার এই সব যদি ভাল হয় দর্শক বাকিটা তখন দেখতে চায়। মুম্বই ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক থেকে প্রযোজক সকলেই এখন মনে করছেন ইউটিউবে ছবির ভাল ট্রেলরই দর্শকদের হলমুখী করবে। হলিউডেও ছবির ‘কনটেন্ট’ নিয়ে যতটা ভাবা হয় মার্কেটিংকেও তেমনই গুরুত্ব দেওয়া হয়।

প্রযোজকেরা প্রচারের ওপর এতই গুরুত্ব দেন যে কোনটা সিনেমা কোনটা বাস্তব তা গুলিয়ে যেতে পারে। এখানে যেমন ছবির প্রচারের সময় অভিনেতারা সিনেমায় তাঁদের যে নাম তাই দিয়েই ট্যুইটারে প্রচার করে থাকেন। হলিউড সে দিক থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে। ইরফান খান নতুন ‘জুরাসিক পার্ক’ সিরিজে ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ ছবিতে অভিনয় করছেন। তিনি পুরনো পার্ক মালিক জন হ্যামন্ডের জায়গায় নতুন মালিক সাইমন মাসরানির ভূমিকায় অভিনয় করছেন।

‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’য়ের প্রোডাকশন হাউজ প্রচারের জন্য একটা ওয়েবসাইট করেছে। ইরফানের চরিত্রটিকে নিয়ে পুরো গল্পটাই ওই ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। এমন ভাবে ওয়েবসাইটটি ডিজাইন করা যাতে ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’কে মনে হচ্ছে একটি সত্যিকারের পার্ক আর মাসরানি তাঁর সত্যিকারের মালিক। তার ফলে বাস্তব আর সিনেমা প্রায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

এখন শুধু ছবি নয়, ছবির প্রচারের জন্য তার চেয়েও বেশি ইনোভেটিভ হতে হবে। তাই ছবির বিষয়বস্তু, গুণগত মান ভুলে শুধুই প্রচারে মন দিলে চলবে না।

মোদ্দা কথা চবির পরিচালক, কনসেপ্ট আর চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা নির্বাচনে বক্স অফিসে সাফল্য এনে দেবে। বাকি সব তফাত যাক।

ছবি টুইটার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE