Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কোনও লেখক নয়, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হোয়াটসঅ্যাপ

বক্তা - চেতন ভগত। সাক্ষাৎকার - অরিজিৎ চক্রবর্তীরাজনীতিবিদদের মতো ছবি টুইটারে। বই লিখছেন ভারতের সমস্যা সমাধানের পথ নিয়ে... না, না, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। যে কাজটা করছি সেটা নিয়েই বেশ খুশি আছি।

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:১৯
Share: Save:

রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন নাকি?

কেন বলুন তো?

রাজনীতিবিদদের মতো ছবি টুইটারে। বই লিখছেন ভারতের সমস্যা সমাধানের পথ নিয়ে...

না, না, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। যে কাজটা করছি সেটা নিয়েই বেশ খুশি আছি। রাজনীতিতে যোগ দেওয়া মানে তো কোনও না কোনও দলের অনুগত হতে হবে। তাদের মতে চলতে হবে। তাদের হ্যাঁ-এ হ্যাঁ মেলাতে হবে। সেটা আমি পারব না। নিজের স্বাধীন ‘ভয়েস’ প্রকাশ করতে পারি। এই বেশ আছি।

কিন্তু সেই ‘ভয়েস’কে তো সমালোচনাও শুনতে হয়। অনেকে বলেন আপনার মতামত তেমন পোক্ত নয়। বিশেষ করে সমাধানের পথগুলো...

যেমন?

আপনার নতুন বই ‘মেকিং ইন্ডিয়া অসাম’‌য়ে রোমানে হিন্দি লেখার জয়গান করেছেন। আপনার কি মনে হয় হিন্দি বা বাংলা স্ক্রিপ্টের আর কোনও প্রয়োজন নেই?

আমরা তো এখন সেটাই করি। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে...

সে তো অনলাইনে ফন্টের অসুবিধার জন্য...

না, বিজ্ঞাপনেও তো ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখুন, আমার মতে রোমানে ভারতীয় স্ক্রিপ্ট লেখার সময় এসে গেছে। এত লোকে যখন প্রতিদিন ব্যবহার করছে, তা হলে অফিশিয়ালি ব্যবহার করতে বাধা কোথায়? আমি কিন্তু ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের কথা বলছি না। ভাষা আর স্ক্রিপ্ট তো দু’টো আলাদা জিনিস। এমন অনেকে আছেন যাঁরা হিন্দি বলতে বা শুনে বুঝতে পারেন, কিন্তু স্ক্রিপ্ট পড়তে পারেন না। তাই আমার মতে রোমানে হিন্দি লিখলে সেটা অনেক লোকের কাছে পৌঁছতে পারবে।

যেমন আপনার বই। বেরোতে না বেরোতেই বেস্ট সেলার। কিন্তু আপনার মনে হয় না, বইগুলো বড্ড গতে বাঁধা ফর্মুলাতে চলে?

হতে পারে। এগারো বছর লেখার পর হয়তো ফিকশনগুলোতে লোকে একটা বাঁধা গত খুঁজে পাচ্ছেন। সেটা আমি অস্বীকারও করছি না। তবে আমি সব সময় নিজেকে ভাঙতে চাই। নতুন করে আবিষ্কার করতে চাই। চেষ্টা করব যাতে পরের ফিকশনটা আর একই ফর্মুলায় না পড়ে।

সমালোচকদের আর একটা অভিযোগ, আপনার বইতে ‘হ্যাপি এন্ডিং’ থাকবেই। সেটা কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে অনেক সময় মেলে না। অনেকে তাই ‘টু স্টেটস’ বা ‘ওয়ান নাইট অ্যাট কল সেন্টার’ থেকে এগিয়ে রাখে ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান’কে ...

আমার তো মনে হয় বাস্তবেও ‘হ্যাপি এন্ডিং’ হয়।

সেটা তো ফিল্মি ফর্মুলা। অনেকে বলেন, আপনার লেখা থেকে এত সিনেমা হয় যে, গল্পগুলোতেও একটা ‘ফিল্মি’ভাব এসে পড়ে।

‘ফিল্মি’ভাব কথাটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। আরে, সিনেমা হোক কী বই, দু’টোই তো একটা গল্প বলে। আর ‘ফিল্মি’ বলতে আপনি যদি ড্রামাটিক ক্লাইম্যাক্সের কথা বলেন, তা হলে বলব আমার মতে ওটা ভাল গল্প বলার জন্য জরুরি। আমি সেটাই করি।

এখন তো আবার খুব ব্যস্ত। ‘কিক’‌য়ের স্ক্রিপ্ট লিখলেন। শোনা যাচ্ছে একতা কপূরের জন্য একটা টিভি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্টও লিখছেন।

না, না, আমি কোনও টিভি সিরিয়ালের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখছি না। ‘কিক’য়ের মতো বড় বাজেটের ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আলাদা হবে জানতাম। সেটার জন্যই রাজি হয়েছিলাম। আর কোনও চিত্রনাট্য তো এখন লিখছি না। বইটাই আমার প্রথম প্রায়োরিটি।

‘নাচ বলিয়ে’তে জাজ হওয়াটা সেই প্রায়োরিটি লিস্টের কোথায় পড়ে? অনেকে বলেছিলেন চেতন ভগত ডান্স রিয়েলিটি শো জাজ করার কে?

লোকজনের কথা শুনলে তো এখনও ব্যাঙ্কের চাকরি করতাম। ‘নাচ বলিয়ে’র জাজ হওয়ার অফারটা নিয়েছিলাম, কারণ আমার মনে হয়েছিল এ ভাবে দেশের অনেক জায়গা দেখা হয়ে যাবে। সেটা আমার মতো একজন লেখকের জন্য ভাল। আর তা ছাড়া ডান্স রিয়েলিটি শো জাজ করাটা মজারও হবে। আমিও তো মানুষ, নাকি! আমারও তো মাঝে মাঝে মজা করতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু একজন উঠতি লেখকের কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ— রাতারাতি খ্যাতি, সারা বিশ্বে নামডাক, পুরস্কার নাকি শিল্পের প্রতি ভালবাসা?

লেখক হিসেবে রাতারাতি খ্যাতির কোনও জায়গা নেই ভাই। তোমাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর স্ট্রাগল করতে হবে শুধু বই ছাপানোর জন্য। আর সেটা কিন্তু শিল্পের প্রতি ভালবাসা না থাকলে হবে না।

প্রথম বই ছাপাতে জুতোর সুখতলা খোয়াতে হবে বুঝলাম। কিন্তু এই সময়ের পাবলিশিং ইন্ডাস্ট্রিতে কি লেখকরা ক্রিয়েটিভ স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারেন?

আমার তো মনে হয়, ভারতে এটা বেশ সুবিধার। ওয়েবসাইট, ফোন, টিভি, সিনেমা যতই বইয়ের জন্য থ্রেট হোক না কেন, লেখকরা এখানে লেখার স্বাধীনতাটা ভালই পান।

কিন্তু জনসাধারণের সাহিত্য হতে গিয়ে কি লেখার মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে না? অনাবাসী বাদ দিলে বিশ্বদরবারে ভারতীয় লেখকরা কোথায়?

আমাদের না সব কিছুতে একটা জাতপাত ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে। সাহিত্যের জগতেও। আর লড়িয়ে দেওয়ারও একটা চেষ্টা। যেমন, ভাল ভাষা ব্যবহার করা ‘ব্রাক্ষ্মণ’ লেখক ভার্সেস সহজ ভাষার লেখক। এটা আমার একেবারে পছন্দের নয়। আর প্রাইজের কথা যদি বলেন, তা হলে বলব শুধু পুরস্কার তো ভাল বইয়ের মাপকাঠি হতে পারে না। এই যেমন, বুকার তো একটা কর্পোরেট স্পনসর্ড পুরস্কার। ব্রিটেনে পাবলিশড হওয়া বই বিচার করে ব্রিটিশ জুরি। বুকার নিঃসন্দেহে বড় পুরস্কার। কিন্তু সব লেখক ওই পুরস্কারের কথা মাথায় রেখে লেখে না।

আচ্ছা, তা হলে বলুন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কে? অমিশ ত্রিপাঠি, টুইঙ্কল খন্না?

কোনও লেখককে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় না। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যান্ডি ক্র্যাশ আর হোয়াটসঅ্যাপ। বই থেকে লোকজনকে দূরে সরিয়ে রাখে যে সব জিনিস সেগুলোই আমার কম্পিটিটর। আমি তো ইয়ং ছেলেমেয়েদের বলি, বইয়ের দোকানে যাও। ঘণ্টাখানেক তাকগুলো খুঁজে দেখো। আর যেটা তোমার পছন্দ হয় কিনে ফেলো।

আপনার পছন্দের লেখক কে?

জর্জ অরওয়েল। সামাজিক সমস্যাগুলো ওঁর মতো সহজ সরল করে লেখার চেষ্টা করি সবসময়।

আপনি একবার বলেছিলেন, ভাল লেখার পাশাপাশি লেখকদের মার্কেটিংয়েও নজর দেওয়া উচিত। কিন্তু ভাল লেখা কি নিজের গুণে এমনি বিক্রি হয় না?

অবশ্যই হয়। কিন্তু মার্কেটিংটা করতেই হবে। বিশেষ করে সে যদি নতুন লেখক হয়। এখন আমার হয়তো মার্কেটিংয়ে অতটা গুরুত্ব না দিলেও চলে। দু’-একটা ভাল টুইট করে দিলেই হয়। কিন্তু নতুন লেখকদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিতেই হবে। বইয়ের বাজারে অনেক ভাল ভাল লেখা আছে। সে সবের মধ্যে নিজেকে আলাদা ভাবে চেনাতে মার্কেটিংটা মাস্ট। ইটস পার্ট অব দ্য গেম।

আপনার বইগুলোর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ কিন্তু ধর্ম। প্রায় সব বইয়ের প্রধান চরিত্রের নাম কৃষ্ণের নামে...

আমি তো হিন্দু। আর তার জন্য গর্বিতও। আর ভগবান কৃষ্ণকে আমার খুব ভাল লাগে। আমাকে ভীষণ ভাবে ইন্সপায়ার করেন শ্রীকৃষ্ণ। আমার বইয়ের চরিত্রের নামও ইচ্ছে করেই ভগবান কৃষ্ণের নামে দিই, যাতে ওই নামটা সারা বিশ্বে অনেক বার করে উচ্চারিত হয়। ধর্মে তো খারাপ কিছু নেই। শুধু নেগেটিভিটিটা বাইরে রাখলেই হল।

শেষ প্রশ্ন, আপনার মতোই এখন জেন ওয়াইয়ের অনেকে আইআইটি-র পর গবেষণা বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকে না গিয়ে, যাচ্ছে এমবিএ করতে বা শুরু করছে স্টার্ট আপ। এটার কারণ কি মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠার সময় যে ক্রিয়েটিভ সত্তা চাপা পড়েছিল, সেটাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা?

হতে পারে। আমার মনে হয়, কেউ কী করতে চায় সেটা আগেভাগে ক’জন বুঝতে পারে! যখন আইআইটি পড়তে গেল তখন হয়তো জানেই না, সে আসলে কী করতে চায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো একটা পথ খুঁজে পায়। ভালই তো! আমি তো তাতে খারাপ কিছু দেখি না। আইআইটি পড়ে গবেষণাই করতে হবে বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই যেতে হবে, এমন তো কোনও কথা নেই। যে কোনও ক্ষেত্রে সেরা হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটাই তো বড় কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE