Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বড়লোকের জাহাজে মধ্যবিত্তের লাইফবোট

এ ছবি কর্ণ জোহর থেকে শাহরুখ খানের মতে মডার্ন ডে মাস্টারপিস! অন্য ছবির বক্স অফিস কালেকশন একশো কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রথম ছবির নাম ‘দিল ধড়কনে দো’। দ্বিতীয়- ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’। অথচ সবার যে দারুণ লেগেছে তা নয়। কেন দুটো ছবি নিয়ে এমন মেরুকরণ? উত্তর খুঁজছে আনন্দplus। অনবদ্য অনিল কপূর আর রণবীর সিংহ। লিখছেন চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়।এ ছবি কর্ণ জোহর থেকে শাহরুখ খানের মতে মডার্ন ডে মাস্টারপিস! অন্য ছবির বক্স অফিস কালেকশন একশো কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রথম ছবির নাম ‘দিল ধড়কনে দো’। দ্বিতীয়- ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’। অথচ সবার যে দারুণ লেগেছে তা নয়। কেন দুটো ছবি নিয়ে এমন মেরুকরণ? উত্তর খুঁজছে আনন্দplus। অনবদ্য অনিল কপূর আর রণবীর সিংহ। লিখছেন চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়।

দিল ধড়কনে দো

দিল ধড়কনে দো

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৫ ০০:০৯
Share: Save:

‘Your children are not your children...

You may give them your love
but not your thoughts,

For they have their own thoughts.

You may house their bodies
but not their souls,

For their souls dwell in the
house of tomorrow, which you cannot visit,

not even in your dreams.’

— Kahlil Gibran, ‘The Prophet’

সন্তানের কোন বয়সে কতটা স্বাধীনতা প্রাপ্য, সেটা বোঝা দায়। কতখানি দায়িত্ব, কতটা হস্তক্ষেপ, কতটুকু দেখতে থাকা দূর থেকে, ঠিক কোথায় মা-বাবার গণ্ডি শেষ হয়, ঠিক কখন ডানা মেলে আগামীর মুক্ত আকাশে উড়তে দিতে হয় তাকে, এর কোনওটারই কোনও সঠিক বেঠিক হিসেব নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে সকলেই সুন্দর। তাই সুন্দর ভাবেই বাঁচুক আমাদের সন্তান। নিজের মতো করে। লেট লিভ। তাই, ‘দিল ধড়কনে দো।’

জোয়া আখতার পরিচালিত ‘দিল ধড়কনে দো’ আমি দু’বার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখলাম। দু’বার কেন দেখলাম এত উৎসাহ নিয়ে, সে কথায় পরে আসছি। মেহরা পরিবারের গল্প এটি। সুনীল ভূমধ্যসাগরে তাদের বন্ধু- পরিবারদের নিয়ে, এই ব্যবসায়ী পরিবারের জাহাজ ভ্রমণ, মানে যাকে আমরা বলি, ক্রুজ। মেহরা পরিবার ও পারিবারিক ব্যবসার কর্তা অনিল কপূর। তাঁর স্ত্রী শেফালি শাহ, তাঁদের সন্তান প্রিয়ঙ্কা চোপড়া ও রণবীর সিংহ। বিবাহিত প্রিয়ঙ্কা নিজগুণে অতি সফল ব্যবসায়ী। আর মা-বাবার আদরের উত্তরসূরি রণবীর। ব্যবসায় তাঁর এতটুকু মন নেই। আর এই বাড়ির অন্যতম সন্তান সারমেয় প্লুটো মেহরা। যে মনে করে সে নিজেই এই পরিবারের একমাত্র নর্মাল সদস্য।

জাহাজে মাঝসমুদ্রে নতুন প্রেম, ডিভোর্স, ঝগড়া, আদর, সবই হয়। পুরনো প্রেমের হঠাৎ আবির্ভাব হয়। হয় নতুন বিজনেস ডিল, কৃত্রিম পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করে। অগাধ পয়সার মোড়কে ফাঁপা মূল্যবোধে গড়ে ওঠা জীবন ছারখার হয়ে গিয়েও আমাদের হাসিয়ে দিয়ে যায়। আর আশা জোগায় যে, দৃষ্টি অন্তর্মুখী থাকলে, শুধরে নেওয়ার সময় এবং সদিচ্ছা, দুটোই থেকে যায়।

প্রসঙ্গ: ‘দিল ধড়কনে দো’ দু’বার কেন দেখতে গেলাম

এক: পরিচালক জোয়া আখতার। ওঁর শিক্ষা, মনন, বিবেচনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং আস্থা। জোয়া পরিচালিত ‘লাক বাই চান্স’ আপনারা দেখেছেন। ওঁর পরিচালিত ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ আমার অত্যন্ত প্রিয় ছবি। ‘দিল ধড়কনে দো’তে তিনি একটি সাধারণ গল্পের মধ্যে দিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট নৈপু্ণ্যের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। রিমা কাগতির সঙ্গে জোয়া-র লেখা এই চিত্রনাট্যে তিনি গল্পে নানা অপ্রত্যাশিত, মাঝে মাঝে উদ্ভট মোচড় এনেছেন। হাস্যরস দিয়ে সেগুলোর সমাধান করেছেন। নরম হাতে মূল্যবোধকে আঘাত করে, আবার তা নতুন চেহারায় স্থাপন করেছেন ভবিষ্যতের পথ দেখাতে।

দুই: জাভেদ আখতার-ফারহান আখতার-জোয়া আখতার টিম। এক দুর্লভ মিশ্রণ। জোয়ার সুচিন্তিত প্লটে ফারহানের লেখা স্মার্ট সংলাপ। কথার খেলা, হাস্যরস, নীরবতার অসম্ভব কিছু প্রয়োগ। তার সঙ্গে আমির খানের গলায় জাভেদ আখতারের লেখা, সারমেয়, ম্যাস্টিফ প্লুটো মেহরার ‘ভয়েস ওভার’। প্লুটো তার চারপাশের মানুষদের নিয়ে কী ভাবছে। প্লুটোর গভীর জীবনদর্শন, যা আমাদের মনোরঞ্জন করার সঙ্গে সঙ্গে ভাবায়ও অনেকটা। মানুষের মতো অদ্ভুত জন্তু নাকি পৃথিবীতে নেই। তারা ভাবে এক। করে আরেক। চিন্তা করে এক। বলে আর এক। অন্যের ক্ষেত্রে যেটা ‘হিপোক্রেসি’, নিজের ক্ষেত্রে সেটা ‘দুনিয়াদারি’। ‘ইয়ে ইনসান বহুত হি আজীব হ্যায়’, কারণ দার্শনিক প্লুটো অনেক কিছুর নীরব সাক্ষী।

তিন: কাস্ট। অসম্ভব ভাল বাছাই। দারুণ অভিনয় প্রত্যেকের। অনিল কপূরের ক্ষমতা হারানোর, ব্যবসা বাঁচাবার বহুমূল্য পরিকল্পনাগুলো ভেস্তে যাওয়ার যন্ত্রণায় আমরা হেসে কূল পাই না। অসাধারণ ভারসাম্য তাঁর অভিনয়ে, তাই এটা সম্ভব হয়েছে। শেফালি শাহ, তাঁর চরিত্রে একাকিত্ব, ক্ষমতার লড়াই, সন্তানস্নেহ, শাসন, যৌবন হারানো শরীরকে ধরে রাখার চেষ্টা কী সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন!

প্রিয়ঙ্কা চোপড়া সুন্দরী, অসম্ভব আত্মবিশ্বাস তাঁর হাঁটা-চলা, দৃষ্টি, বাচনভঙ্গিতে। রণবীর সিংহ অসাধারণ। তাঁর কমিক টাইমিংয়ের কথা আলাদা করে বলতে হয়। মা-বাবার কাছে বায়না, দিদির সঙ্গে খুনসুটি, বন্ধুদের মাতিয়ে রাখা আড্ডা— সব কিছুতেই অত্যন্ত সাবলীল।

রাহুল বসু দারুণ বাছাই প্রিয়ঙ্কার পিতৃতান্ত্রিক স্বামীর ভূমিকায়। সকলের মাঝেও কেমন যেন বেমানান। সব কিছুর মাঝে থেকেও ও যেন নেই। ওর উপস্থিতি হাসায় বারবার। অনুষ্কা শর্মার আন্ডারটোন অভিনয় প্রশংসনীয়। দুটি নাচের দৃশ্য অসামান্য। সাঁতারের দৃশ্যে মোহময়ী। অভিনয়ে বাকি সকলেই খুব ভাল।

বাকি রইল ফারহান আখতার। ইন্টারমিশনের আগে তাঁর নাটকীয় প্রবেশ। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, ঈজিপ্টে সাংবাদিকতা করেন। এসে সব তালগোল পাকিয়ে দেন। ফারহান যেন তাঁর ‘মর্দ’ ক্যাম্পেনেরই মুখপাত্র হয়ে এই চরিত্রে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এক অন্যতম উচ্চারণ তিনি। নারী- পুরুষের সমান অধিকার তাঁর স্বপ্ন, তাঁর লড়াই, তাঁর দাবি।

চার: হাস্যরস। সংলাপ এই ছবিতে রাজা। আর তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিনয় অবং আনন্দ সুবায়া ও মনন মেহতার সম্পাদনা। কোথাও হাসানোর চেষ্টা নেই, অথচ হাস্যরসে ভরপুর। প্রকৃত কমেডি। কোনও বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু দর্শক লুটিয়ে পড়ছে। এখানে সম্পাদনার কথা আলাদা করে বলছি কারণ কমিক টাইমিং তৈরির ক্ষেত্রে, উপযুক্ত রিঅ্যাকশন শটস রাখার ক্ষেত্রে, সম্পাদনার দান অনস্বীকার্য। খুব সঙ্কটজনক মুহূর্তেও এমন কিছু প্রায় অবাস্তব সংলাপ, এবং বিভিন্ন চরিত্রের ওপর এই সংলাপের প্রতিক্রিয়া, খুব উঁচুদরের কমেডি তৈরি করেছে। হ্যাটস অফ।

পাঁচ: শঙ্কর এহেসান লয়-এর গান এবং বস্কো সিজারের কোরিওগ্রাফি, কী আধুনিক, কী অসামান্য! ডান্স ট্রুপের সুইং, অনুষ্কা-রণবীরের ‘পহেলি বার’, সর্বোপরি ‘গালান গুড়িয়ান’য়ের ওয়ান শট কোরিওগ্রাফি। পুরো গানটা একটা শটে রেকর্ড করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কাস্টের প্রত্যেক সদস্যকে নিয়ে। দম বন্ধ হয়ে আসে দেখতে দেখতে। নিশ্চয়ই কয়েক দিনের মহড়া এবং বেশ কিছু দিনের শ্যুটিংয়ের সৃষ্টি। প্রসঙ্গত, ফারহান ও প্রিয়ঙ্কা দু’জনেই নিজের গলায় গান গেয়েছেন।

ছয়: কিছু মুহূর্ত। আসলে বেশ কিছু মুহূর্ত। অনিল কপূরের ছেলের বিয়ে ও পার্টনারশিপের প্রস্তাবে, সব জেনেও না জানার ভান, অকপট চুম্বনের সাক্ষী হয়ে হুট করে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়া। শেফালি শাহের চকোলেট, পেস্ট্রি খাওয়ার, গেলার অসামান্য
মুহূর্ত, অনুকূল পরিস্থিতিতে মেয়ের হাত ধরা, রণবীর–প্রিয়ঙ্কার ভাইবোনের রসায়ন, বোঝাপড়া, রণবীরের ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে করতে নিজেই হাসিতে লুটিয়ে পড়া। রণবীর অনুষ্কার সাইকেল চালানোর দৃশ্যে এক অপরকে কিছুটা জানতে পারা। রাহুলের চাপা কান্না, ফারহানকে প্রথম দেখা, প্লুটো মেহরার মনুষ্য সম্পর্ক বিশ্লেষণ। আরও অনেক অনেক মুহূ্র্ত। যা হাসায়, ভাবায়।

প্রসঙ্গ: কিছু কথা, দু’বার দেখার পর

এক: আমার ধৃষ্টতা, তবে প্লুটো মেহরার ভয়েস ওভার শুনতে শুনতে আশা করছিলাম যে আরেকটু ম্যাস্টিফ-সুলভ ভাবনা থাকবে। তার চোখে মনুষ্য প্রজাতির আরও কিছু উদ্ভট কীর্তিকলাপ যদি ধরা পড়ত! আর তার যদি আরও সারমেয়-সুলভ বিশ্লেষণ করা যেত! বা তার শব্দচয়ন, ভাষা যদি প্লুটো দ্য ম্যাস্টিফ-এর মতো হত!

দুই: জাহাজ স্পেন, ইতালি, টার্কি, গ্রিস, তিউনিশিয়া ঘুরল... যদি সেই জায়গাগুলোর স্বাদ আরেকটু পেতাম! নইলে এ গল্প ভূমধ্যসাগরে না হয়ে বম্বে টু গোয়ার জাহাজভ্রমণে আরব সাগরেও হতে পারত।

তিন: একজন সফল ব্যবসায়ীর তুলনায় প্রিয়ঙ্কা যেন শিশুর মতো সরল। আরেকটু পরিণত হলে বেশি উপভোগ্য হত।

চার: পরিচালক অনুষ্কার উচ্চারণের দিকে আরেকটু নজর দিতে পারতেন। যে বার্মিংহামে বড় হয়েছে, লন্ডনে কাজ করেছে বহু দিন, তার ইংরেজিতে বিকট দেশি টান কেন?

এই গল্প মধ্যবিত্তের গল্প নয়। সমস্যাও মধ্যবিত্তের নয়। তবে সন্তানকে দিয়ে স্বপ্নপূরণের ইচ্ছে অবশ্যই সকলের ঘরে বিরাজমান। আমাদের সন্তান নিজমাফিক বড় হোক। উড়ুক। বাঁচুক। ভালবাসা দিয়ে যেন সন্তানের পাশে থাকি আমরা। সব অঙ্ক ভুলে গিয়ে যেন প্রয়োজনে তাদের হাত ধরতে পারি। যেন আগামীর লাইফ-বোট হতে পারি আমরা। দিল ধড়কনে দো। ব্যস্।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE