Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বলিউডে জাপানি এফেক্ট

অজয় আর তব্বুর অভিনয়ের টক্কর। তবু কিছু প্রশ্ন থেকেই গেল। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী।বাংলা আজ যে ভাবে গল্প ঝাড়ে, আগামী কাল তামাম ভারত সে ভাবে চুরি করে। সত্তর দশকেও শিশুপাঠ্য বাংলা পত্রিকায় বেশ কিছু গল্পের নীচে লেখা থাকত, ‘বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।’

‘দৃশ্যম্’

‘দৃশ্যম্’

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:১৮
Share: Save:

বাংলা আজ যে ভাবে গল্প ঝাড়ে, আগামী কাল তামাম ভারত সে ভাবে চুরি করে।

সত্তর দশকেও শিশুপাঠ্য বাংলা পত্রিকায় বেশ কিছু গল্পের নীচে লেখা থাকত, ‘বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।’ আসল গল্পটির নাম কী, কে লেখক, অনুবাদে কোনটা ছায়া কোনটা কায়া তা আজও দুর্বোধ্য মায়া। আর এই সিনেমার টাইট্ল-কার্ড: জিতু জোসেফের কাহিনি অবলম্বনে। জিতুর গল্প ও পরিচালনায় মালয়ালম ছবি ‘দৃশ্যম্’ বছর দুয়েক আগে ভারতীয় সিনেমায় সাড়া জাগিয়েছিল। আঞ্চলিক ভাষায় প্রথম ৬০ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য-করা সিনেমা। অতঃপর সেই ছবি কখনও কন্নড়, কখনও তেলুগুতে। কখনও বা তামিলে। এ বার হিন্দিতে অজয় দেবগন ও তব্বু।

বলিউডের ছবি ক্রেডিট লাইনে কেরলের পরিচালককে স্বীকৃতি দিচ্ছে, এটি জাতীয় সংহতির প্রচারে কাজে দিতে পারে। কিন্তু সত্যের চিঁড়ে তাতে ভিজবে না। জাপানি লেখক কেইগো হিগাশিনোর ‘ডিভোশন অব সাসপেক্ট এস’ ইতিমধ্যে বেশ বিখ্যাত থ্রিলার, বই ও সিনেমা দুই অবতারেই
সাড়া জাগিয়েছে। মুম্বইতে একতা কপূর একদা এই গল্পটিরই স্বত্ব কিনেছিলেন। আজ জিতু জোসেফকে সেই গল্পের লেখকের মর্যাদা! বাংলা গল্পগুলো অন্তত ছায়া, কায়া ইত্যাদি আড়াল বজায় রেখেছিল। এ বার সেটিও নেই।

জাপানি গল্পটি ছিল দুই প্রতিবেশীকে নিয়ে। ডিভোর্সি মহিলা ইয়াসুকো তাঁর কন্যাকে নিয়ে থাকেন, এক রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। টাকার জন্য তাঁর প্রাক্তন স্বামী একদিন বাড়িতে চড়াও হন, আত্মরক্ষার্থে মা ও মেয়ে দু’জনে তাঁকে খুন করে ফেলেন। ইয়াসুকোর প্রতিবেশী ইশিগামি অঙ্কের শিক্ষক। মা ও মেয়েকে বাঁচাতে তিনি বিভিন্ন মিথ্যা অ্যালিবাই তৈরি করেন, পুলিশ নাস্তানাবুদ হয়ে যায়। পুলিশ ইয়াকুওয়া নামে আর এক অঙ্কের অধ্যাপকের শরণাপন্ন হয়। অতঃপর দুই গণিতজ্ঞের বুদ্ধির লড়াই। ইশিগামি প্রতিবেশিনীকে ভালবাসেন বলেই তো সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো ধাপে ধাপে অ্যালিবাই তৈরি করেন।

জিতু জোসেফের নায়ক বিজয় সালগাওকর (অজয় দেবগন) অবশ্য এ রকম অধ্যাপক নন। ক্লাস ফোর পাশ, কেবল টিভির ব্যবসা করেন। তাঁর বড় মেয়ে স্কুল থেকে পিকনিকে যায়। সেখানে একটি ছেলে মোবাইলে তার স্নানের ছবি তুলে তাকে ব্ল্যাকমেল করে। দুর্ঘটনাবশত মা ও মেয়ের হাতে ব্ল্যাকমেলার ছেলেটির মৃত্যু হয়। নায়ক এ বার বউ ও মেয়েকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা অজুহাত তৈরি করেন, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বুদ্ধির দাবাখেলায় নামেন। জাপানি পুরুষ প্রেমের জন্য মিথ্যে অজুহাত তৈরি করে, ভারতীয় পুরুষ সংসারকে বাঁচানোর জন্য!

সংসার বাঁচল কি না, পরের কথা। কিন্তু প্রথমার্ধে ছবি বাঁচেনি। শ্লথ গতি। মালয়ালম ছবিটিরও একই দশা হয়েছিল। দুটো ছবির তফাত এক জায়গায়। মালয়ালম ছবিতে মোহনলাল বোকা বোকা রসিকতা করেন, মাঝে মাঝে ভাঁড় মনে হয়, কিন্তু সেই লোক যখন বুদ্ধির খেলায় নামেন, চমকে যেতে হয়। এখানে অজয় দেবগন সেই মাপে পৌঁছাতে পারেননি। নিশিকান্ত কামাথের পরিচালনায় তিনি দোকানে চা খেতে খেতে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন। শুধু বুদ্ধির খেলায় হয় না। হিন্দি ছবির নায়ককে মাঝে মাঝে ‘পাওয়ার অব কমন ম্যান’ও বুঝিয়ে দিতে হয় যে!

আইজি মীরা দেশমুখ (তব্বু) আসার পর অবশ্য ছবির গতি হয়ে ওঠে টানটান। খুন-হওয়া ব্ল্যাকমেলার আর কেউ নয়, মীরার বিপথগামী সন্তান। তব্বু বুঝতে পারছেন, অজয় মিথ্যা কথা বলছেন, প্রমাণ সাজাচ্ছেন। কিন্তু হাতেনাতে ধরার উপায় তাঁর নেই। গল্পের মজা এখানেই। কে খুন করেছে, কী ভাবে করেছে তা নিয়ে রহস্য নেই। কী ভাবে একের পর এক প্রমাণ সাজানো হচ্ছে, সেটি সত্য না মিথ্যা এ নিয়েই ধন্ধ।

এক দিকে ছেলেকে অন্যায় আসকারা দেওয়া মা, অন্য দিকে দুঁদে পুলিশ অফিসার...সব মিলিয়ে তব্বু অনবদ্য। ছাপিয়ে গিয়েছেন অজয় দেবগনকেও! শেষ দৃশ্যে অজয় আর তব্বুর অভিনয়ের টক্করও ভোলার নয়। অজয় দুর্ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তব্বু ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্বামী রজত কপূরের বুকে। অজয় ও তব্বু দু’জনের চার্জড অভিনয়ের মাঝে দাড়িপাল্লাটা ধরে রেখেছে রজত কপূরের মিনিমাল, নিরুচ্চার অভিনয়। ঘুষখোর পুলিশ গাইতোন্ডের চরিত্রে কমলেশ সাওয়ন্ত অনবদ্য! শুধু সঙ্গীত বিভাগেই নম্বর নেই। ছবির অন্যতম দুর্বলতা সেটিই।

দুর্বলতা আছে আরও। বাড়ির লিভিং রুমে আইজি ব্যবসায়ী স্বামীর সামনেই সন্দেহভাজনদের থার্ড ডিগ্রি দেন, স্বামী ‘না না, এত অত্যাচার ঠিক হচ্ছে না’ গোছের অনুযোগ করেন। গাইতোন্ডে বিজয়ের মেয়ে, বউ সবাইকে মারতে থাকে। আইজি মীরা দেশমুখ অত্যাচারী হতে পারেন, কিন্তু মহিলা অফিসারও জোটে না? শেষে অবশ্য জনতার প্রতিবাদ আছে। প্রতিবাদী জনতা নিজের হাতে আইন তুলে গাইতোন্ডেকে পেটাতে থাকে। দর্শকের ইচ্ছাপূরণ ঘটে! এত দুর্বলতা, তবু দশে সাত! কারণ, দর্শককে সারাক্ষণ রুদ্ধশ্বাস বসে থাকতে হয়। প্রথম আধঘণ্টা বাদ দিলে বাকিটা একেবারে টানটান জাপানি এফেক্ট! ধামাকার বাজারে এটাই বা কম কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE