Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে দিল

শিরিন আসলাম (কঙ্কণা) ওই বাড়ির আর এক বাসিন্দা। তিন সন্তানের মা। সৌদি আরব থেকে ফেরা স্বামীর চোখে সে শুধু সম্ভোগের বস্তু। অন্তঃসত্ত্বা হওয়া আর গর্ভপাত করানোর রুটিন চক্করের মধ্যেই সে কাজ করে সেল্‌স গার্ল হিসেবে। অবশ্যই স্বামীকে তা না জানিয়ে।

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৭ ১২:৩০
Share: Save:

লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা

পরিচালনা: অলঙ্কৃতা শ্রীবাস্তব

অভিনয়: রত্না, কঙ্কণা, আহানা, প্লাবিতা

৬.৫/১০

মেয়েদের যৌন আকাঙ্ক্ষা পুরুষের সমকক্ষ, কখনও বা তার চেয়ে বেশি। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তা মানতে চায় না। অগত্যা মেয়েরা ইচ্ছেগুলোকে অবদমন করে। কিন্তু ইচ্ছে তো অত সহজে মরে না! মনের গহন কাননে সে নিজের মতো ডাল-পালা ছড়ায়। সেই ডালেই কখনও ফলে ফ্যান্টাসির মরীচিকা, কখনও যৌনমিলনের অদম্য তৃষ্ণা, কখনও বা বিরুদ্ধাচরণের স্পর্ধা। ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ ছবির উষা, শিরিন, লীলা আর রেহানার ইচ্ছেগুলো ঠিক এমনি ধারার। তাদের স্বপ্ন দেখার সাহস জোগায় রোজি। যার শরীরের বাগানে যৌবনের অনন্ত উদ্দাম। সঙ্গে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কাঁটার সম্ভারও।

ভোপালের ‘হাওয়াই মানজিল’ নামে এক অতি পুরনো বাড়িতে বাস উষার (রত্না)। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে সে বুয়াজি। পঞ্চান্ন বছর বয়সি প্রৌঢ়ার জীবনে লিপস্টিক মাখা স্বপ্নের হাতছানি দেয় রোজি, সস্তা ইরোটিক নভেলার নায়িকা। ধর্মীয় বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে উষা সেই বই পড়ে। স্বপ্ন দেখে, অল্প বয়সি সুইমিং প্রশিক্ষকের সঙ্গে ফোন-সেক্স করে। বন্ধ দরজার আড়ালে তার ফ্যান্টাসির সাক্ষী শুধু স্নানঘর।

ওই বাড়িরই আর এক ভাড়াটে লীলা (আহানা)। বিউটি পার্লার চালায়, প্রেম করে পাড়ারই মুসলিম ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে। তার হাত ধরেই ভোপালের ঘিঞ্জি গলি ছেড়ে দিল্লি যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। তবে বিয়ে ঠিক হয় অন্য কারও সঙ্গে। প্রেমিক না মায়ের পছন্দ, কার হাত ধরবে সে? এই দোলাচলের মধ্যেই সে মুক্তি খোঁজে শারীরিক মিলনে (প্রেমিক আর হবু বরের সঙ্গে)।

শিরিন আসলাম (কঙ্কণা) ওই বাড়ির আর এক বাসিন্দা। তিন সন্তানের মা। সৌদি আরব থেকে ফেরা স্বামীর চোখে সে শুধু সম্ভোগের বস্তু। অন্তঃসত্ত্বা হওয়া আর গর্ভপাত করানোর রুটিন চক্করের মধ্যেই সে কাজ করে সেল্‌স গার্ল হিসেবে। অবশ্যই স্বামীকে তা না জানিয়ে।

বুরখায় আপাদমস্তক ঢেকে বাড়ি থেকে কলেজের পথে বেরোয় রেহানা (প্লাবিতা)। রাস্তায় সুলভ শৌচালয়ে বুরখা ছেড়ে কলেজে ঢোকে জিন্‌স-টপ পরে। মাইলি সাইরাসের অন্ধ ভক্ত রেহানা কলেজ ব্যান্ডে গান গাইতে চায়। কলেজে সে প্রেমে পড়ে, পার্টিতে ড্রিঙ্ক করে। এমনকী বন্ধুদের দলে জায়গা পাওয়ার জন্য শপিং মল থেকে জামা-জুতো-লিপস্টিক চুরি করে। সবটাই বাবা-মায়ের অগোচরে।

নৈতিকতা, লোকলজ্জা, সমাজের চোখরাঙানিকে চরিত্রায়নের গণ্ডির বাইরে রেখে এই চার কন্যার দমিয়ে রাখা সুপ্ত বাসনাগুলোকে অকপট ভাবে বড় পরদায় তুলে ধরেছেন অলঙ্কৃতা শ্রীবাস্তব। চরিত্রায়নের দিক থেকে কঙ্কণার শিরিনকে এগিয়ে রাখব। কারণ, সত্যির সামনে সে নিজে দাঁড়ায়। বাকিদের সত্যিটা ঘটনাচক্রে সামনে আসে। রেহানার জেহাদের মাটিটা আরও শক্ত হওয়ার দরকার ছিল। অভিনয়ের বিচারে কঙ্কণা, রত্না, প্লাবিতা আর আহানা চার জনেই প্রথম সারিতে। কঙ্কণা আর রত্নাকে প্রশংসার জন্য নতুন বিশেষণের খোঁজ করতে হয়। আহানা আর প্লাবিতা সমুজ্জ্বল। পার্শ্ব চরিত্রে সুশান্ত সিংহ, বিক্রান্ত মেসি বিশ্বাসযোগ্য।

ছবির শেষটা একটু আকস্মিক বলে মনে হয়। মেয়েগুলো এর পর কোন পথে যাবে, তার কোনও আভাস নেই। মনে পড়ে, গত বছর মুক্তি পাওয়া লীনা যাদবের ‘পার্চড’ ছবিটি। ওই ছবির শেষে নায়িকারা যে ভাবে গাড়ি চেপে ওড়না উড়িয়ে নতুন পথের অভিসারী হয়, এখানে তা নয়। লীলা, উষা, রেহানা আর শিরিনের স্বপ্নের উড়ান মাটিতে আছড়ে পড়ে। দর্শক জানলেন শুধু এটুকুই!

পুরো ছবিটা জুড়ে রয়েছে ব্ল্যাক হিউমর। চরিত্রগুলোকে দেখে যত না বেশি সহমর্মিতা জাগে, তার চেয়েও বেশি করে তারা ভাবায়। অলঙ্কৃতাও হয়তো সেটাই চেয়েছেন। মেয়েগুলোর কার্যকলাপ নিয়ে কথা বলার আবহ তৈরি হোক।

আরও দুটো কথা বলার। চারটি চরিত্রের মধ্যে দু’জন মুসলিম। তারা বুরখা পরে। বুরখা এক অর্থে নিষেধ। কিন্তু আর এক অর্থে মেয়েদের ঢালও বটে।

বুরখার আড়ালেই শিরিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেল্‌স গার্লের কাজ করতে পারে। বুরখার আড়ালেই সে স্বামীর প্রেমিকার পিছু ধাওয়া করতে পারে। বুরখার আড়ালেই রেহানা জিন্‌স পরার ইচ্ছেপূরণ করতে পারে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নিষেধকেই তারা নিষেধ ভাঙতে ব্যবহার করে।

অন্য দিকে, বাগ্‌দানের রাতে প্রেমিকের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত অবস্থায় লীলাকে তার মা দেখে ফেললেও, মেয়ের ফ্যাকাসে ঠোঁটে সেই ফের লিপস্টিক পরিয়ে দেয়। লিপস্টিক ইচ্ছার, লিপস্টিক অনিচ্ছারও!

অলঙ্কৃতাকে ধন্যবাদ একটা সৎ ছবি বানানোর জন্য। ছবিতে শিরিনের সঙ্গে কথোপকথনে লীলা এক সময় বলে, ‘‘আমাদের এই পরিণতি, কারণ আমরা বড্ড বেশি স্বপ্ন দেখি।’’ অলঙ্কৃতার কাছে নতুন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকল। লীলার কথায় বললে, আমরা মেয়েরা প্রত্যাশাও একটু বেশি করি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE