Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

সিগাল দ্রাবিড়

ঢাকার ফাইনাল হারেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা আক্রান্ত নয়। ক্রিকেট লিখিয়ে দিলীপ প্রেমচন্দ্রন-এর তাই মত ‘মরিয়া হয়ে একটা জিনিসের পিছনে ছোটো, সাফল্য আসবে।’ এ ছাড়াও কোচ দ্রাবিড় বাচ্চা ছেলেগুলোকে আরও দু’টো জিনিস দুর্দান্ত শেখাতে পারেন। এক, সাফল্য আর বিপর্যয় — দু’টোর কোনওটাকেই সিরিয়াসলি না নেওয়া। দুই, কোনও দিন নিজের শিকড় ভুলে না যাওয়া।

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:২০
Share: Save:

রাহুল দ্রাবিড় অস্ট্রেলিয়ায় সে দিন সোয়ান নদীর ওপর নৌকাবিহার করছিলেন যখন তাঁর কাছে ভয়ঙ্কর সেই ফোনটা আসে।

আট বছর আগের কথা। পার্থ টেস্টে সদ্য ৯৩ করেছেন। ভারত টেস্ট জিতেছে। মেজাজ ভাল। জানতেন না, সেই ফোনটা মোটেও ভাল খবর নিয়ে আসছে না। ফোনটা আসছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অফিস থেকে এটা জানাতে যে, তোমাকে ওয়ান ডে টিম থেকে বাদ দেওয়া হল।

বড় স্টিমারের ওপর উৎসবের ক্যাঁচোরম্যাচোর আওয়াজে দ্রাবিড় শুনতেই পাননি সেই ফোন কলটা। পরে টিম থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার ঘটনাটা তিনি শুনেছিলেন এক সাংবাদিকের কাছ থেকে। অধিনায়ক ধোনি গিয়ে বলেননি। ফোন করেননি নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান দিলীপ বেঙ্গসরকরও।

অন্য কেউ হলে এই অসম্মান আর সৌজন্যবোধের অভাব দেখে নিশ্চিতভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়তেন। যে মানুষটা ভারতীয ক্রিকেটকে এত বছর ধরে নিজের যৌবনের সেরা দিনগুলো দিয়েছেন, তাঁকে বাদ পড়ার খবর কি না শুনতে হচ্ছে মিডিয়ার কাছ থেকে!

পরের টেস্টের জন্য অ্যাডিলেডে যাওয়ার পথে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পার্থ এয়ারপোর্টে। প্রসঙ্গটা তুলে দেখলাম, তাঁর শরীরীভাষা বা গলায় কোনও রাগ নেই। শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘‘এ রকম হয়েই থাকে।’’

এই হলেন রাহুল দ্রাবিড়! এবং মানুষটাকে বোঝার জন্য ছোট এই ঘটনাটাই আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মশাল।

অনূর্ধ্ব-উনিশ ভারতীয় টিমের কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের দল ঢাকায় বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর দেখছি লেখালিখি শুরু হয়েছে, বিশ্বকাপ সেই অধরাই থেকে গেল দ্রাবিড়ের। প্লেয়ার হিসেবে পায়নি। কোচ হিসেবেও পেল না। যাঁরা রাহুলকে চেনেন, তাঁরা জানবেন রাহুল মোটেই এতে দমে যাওয়ার পাত্র নন। ওঁর পুরো ফোকাসটাই থাকবে এই বাচ্চা ছেলেগুলোকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রুক্ষ পৃথিবীর জন্য ঠিকঠাক তৈরি করা। রাহুল জানেন, ট্রফি আজ নেই, কাল আছে। কাল আছে, পরশু নেই। আসল কথা হল এক্সেলেন্স তৈরি করা।

মনে আছে একদিন ওঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল, ছিয়ানব্বইয়ের সেই লর্ডস টেস্ট ম্যাচের আগের সময়টা নিয়ে। যখন রাহুল শুধুই ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছিলেন। আর রান করে যাচ্ছিলেন। ওঁকে জিজ্ঞেস করছিলাম একজন প্লেয়ারের বিষয়ে— বিজয় অর্জুন রাজা। নব্বইয়ের দশকে কর্নাটক টিমের রাহুলের টিমমেট ছিলেন। এমনকী ১৯৯১-তে ইডেনে রঞ্জি ট্রফিতে রাহুলের প্রথম সেঞ্চুরির সময় উল্টো দিকে ক্রিজে রাজা। রাজাকে তখন খুব প্রতিশ্রুতিমান মনে হত। কিন্তু তার পর মাত্র এক মরসুম খেলে রাজা চলে যান পশ্চিম এশিয়ায়। জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ ক্রিকেট ছেড়ে রাজা আরব দেশে চলে গেলেন?

সেই কর্নাটক টিমে রাজা ছিলেন দ্রাবিড়ের সিনিয়র। দ্রাবিড় যে কোনও নেগেটিভ কথা বলবেন না, সেটা জানাই ছিল। আমার বিস্তর জোরাজুরির পর শুধু এটাই বলেছিলেন, ‘‘হয়তো রাজা অতটা মরিয়া ছিল না।’’

এটাই দ্রাবিড়ীয় মানসিকতা— ‘মরিয়া হয়ে একটা জিনিসের পিছনে ছোটো, সাফল্য আসবে।’ এ ছাড়াও কোচ দ্রাবিড় বাচ্চা ছেলেগুলোকে আরও দু’টো জিনিস দুর্দান্ত শেখাতে পারেন। এক, সাফল্য আর বিপর্যয় — দু’টোর কোনওটাকেই সিরিয়াসলি না নেওয়া। দুই, কোনও দিন নিজের শিকড় ভুলে না যাওয়া।

ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকারের দিনটা যেমন। বেঙ্গালুরুর রাস্তায় ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকানের উদ্বোধনে গিয়েছেন দ্রাবিড়। গাড়ি থেকে নামতেই হাজার হাজার মানুষ দেখলাম ওঁর দিকে ধেয়ে আসছে। কেউ ওঁর জামা ধরে টানছে, কেউ ওঁর গাড়ির ওপর হামলে পড়ছে, কেউ অটোগ্রাফের খাতা প্রায় গুঁজে দিচ্ছে ওঁর মুখে। এক মিনিটের জন্য দেখলাম না রাহুল বিচলিত। ঠান্ডা মাথায় সবাইকে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ এক ফ্যান টাকার নোটে অটোগ্রাফ দিতে বলে। আজও মনে আছে রাহুল শান্ত ভাবে বলেছিলেন, ‘‘আমি টাকার ওপর সই দিতে পারব না। আপনি প্লিজ একটা কাগজের ব্যবস্থা করুন।’’

এটাই রাহুল।

সেই ঘটনার পর আরও দেড় দশক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন দ্রাবিড়। সব সময় দেখেছি কী অসম্ভব নম্র মানুষ। কোনও কিছুতেই বাড়াবাড়ি নেই। ব্যবহারে নেই কোনও দম্ভ।

মনে আছে, আইপিএল-এর প্রথম মরসুমে রয়্যাল চ্যালেঞ্জারের মালিক বিজয় মাল্য ধুরছাই করছিলেন রাহুলের ক্যাপ্টেনসি। প্রকাশ্যে বলছিলেন, কোনও ক্যাপ্টেন নয়। সেই সময় আমি দ্রাবিড়কে ফোন করে রিঅ্যাকশন চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা শব্দ বার করতে পারিনি। পরে দেখেছিলাম, রাহুলের ওই কিছু না বলাটাই কত মর্যাদাব্যঞ্জক ছিল। ও দিকে মাল্য ক্রমশ নিজেকে হাস্যকর প্রমাণিত করছিলেন।

ভারত ২০০৬-এর শেষের দিকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে গেল ইংল্যান্ডে। প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর প্রেস কনফারেন্স চলছে। প্রথমে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ কথা বলবেন। তারপর দ্রাবিড়।

সেই ম্যাচটা হারা সত্ত্বেও ফ্লিনটফের সঙ্গে ব্রিটিশ প্রেসের হানিমুন চলছে। তার আগের বছর প্রায় একার চেষ্টায় ইংল্যান্ডকে অ্যাসেজ জিতিয়েছেন ফ্লিনটফ। তার রেশ দেখলাম এই কনফারেন্সেও পড়েছে। পুরো কথাবার্তায় ইংল্যান্ডের প্রেস কোনও অপ্রিয় প্রশ্ন করল না ফ্লিনটফকে।

কাট টু রাহুল দ্রাবিড়।

চেয়ারে বসতে না বসতেই ঘরের পিছন থেকে একটা প্রশ্ন উড়ে এল। ‘‘সহবাগ তো আজ পুরো ফ্লপ। আপনার কী বলার আছে এ বিষয়ে?’’

আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে দেখলাম প্রশ্ন শুনে রাহুল শুধু একবার মাথা ঝাঁকালেন। কোনও মতেই সেটা প্রশ্ন ছিল না। ছিল রাহুলের গালে চড়।

পুরো প্রেস কনফারেন্সে একবারের জন্যও আর হাসতে দেখলাম না রাহুল-কে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ভেতর ভেতর তখনও রাগে ফুঁসছেন তিনি।

‘‘লোকেরা এমন ব্যবহার করছে মনে হচ্ছে যেন ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছি,’’ বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

তার ঠিক পরের বছর থেকে অনেকটা বদলে যান রাহুল। আবার অধিনায়ক হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে। এ বারের সমস্যা সেই সিরিজে টিমের ম্যানেজার হিসেবে বোর্ড বেছেছে সত্তর বছরের চাঁদু বোড়ে-কে। তিনিই মোটামুটি কোচ।

এর পর যা দাঁড়াল, সেই টিমে কার্যত কোচ বলে কেউ নেই। দূর থেকে আমরা দেখতাম, প্র্যাকটিস বলের ব্যবস্থাও কি না ভারতীয় অধিনায়ককে করতে হচ্ছে।

এত সবের মধ্যেও ওভাল টেস্ট ড্র করার পর চারিদিক থেকে ‘ভিতু ক্যাপ্টেন’ বলে সম্বোধন শুরু হল। বলা হল ২-০র সুযোগ থেকেও, তিনি নিলেন না। যখন ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভন বললেন, ওই পরিস্থিতিতে তিনিও জয়ের পিছনে ছুটতেন না, তখন সমালোচনাটা খানিক কমল। কিন্তু তত দিনে আর যেন আগের সেই রেগে যাওয়া দ্রাবিড় নেই। এই দ্রাবিড় যেন অনেকটাই ভালবাসা হারিয়ে ফেলেছেন ক্রিকেট থেকে।

ব্যাটে রান যদিও পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। চেন্নাইতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনশো রানের ইনিংস খেলে পুরো লাইমলাইট যে নিয়ে গিয়েছেন সহবাগ। এর পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া রাহুলের ব্যাটে শুরু হল রানের খরা। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে গোটা সিরিজে মাত্র ১৪৮ রান করলেন। অজন্তা মেন্ডিসের ভেল্কির সামনে তখন তাঁর কোনও উত্তরই নেই। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাইতে ঐতিহাসিক রান তাড়া করে ভারত যখন ৩৮৭ বানালো, স্কোরবোর্ডে রাহুলের নামের পাশে তখন ৩ আর ৪।

ওই বিপর্যয়ের মধ্যে রিকি পন্টিং ও রাহুল একান্তে কথা বলেছিলেন। কী বলেছিলেন পন্টিং? বলেছিলেন, ‘‘আমি জানি না তুমি কী ভাবছ বা কেমন পরিস্থিতির মধ্যে আছ? কিন্তু আমি ক্রিজে যখনই তোমাকে দেখছি, আমার মনে হচ্ছে তুমি বড় স্কোরের জন্যই ব্যাট করতে নেমেছ।’’

রিকির কথাগুলো তাঁকে অনুপ্রাণিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাও কিছুতেই যেন দ্রাবিড়ের কনফিডেন্স ফিরছিল না।

২০০৮ ডিসেম্বরে মোহালি টেস্ট-এর আগে নির্বাচকেরা তাঁকে কিছু না বললেও এটা স্পষ্ট ছিল রাহুলের হাতে আর বেশি সময় নেই। আজও মনে আছে ম্যাচের আগে ওঁকে এসএমএস করে বেস্ট অব লাক পাঠিয়েছিলাম। পরের দিন প্রায় আট ঘণ্টা ব্যাট করে ১৩৬ রানের দুর্ধর্ষ ইনিংস খেলেছিলেন রাহুল। পরের দিন কনগ্র্যাটস জানিয়ে এসএমএস পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এসেছিল, ‘‘ধন্যবাদ। আপনি আমার ওপর যে বিশ্বাস রেখেছেন, সেই বিশ্বাসটা আমার নিজের ওপরই ছিল না।’’

পরে কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, ‘‘মোহালিতে সে দিন রান না পেলে আমি টিম থেকে বাদ যেতামই। কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ থাকত না। ওই অবস্থায় আমার খেলা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকত না। কারণ ওখান থেকে আর কামব্যাক করার কোনও রাস্তা খুঁজে পেতাম না।’’

এই চিন্তাধারাটাই দ্রাবিড়ীয়! যে মানুষটার ব্যাটিং কেরিয়ার এমন রাজসিক, সেই মানুযটাই পরমুহূর্তে কী অসম্ভব মানবিক! সত্যি, রাহুল যেন পাশের বাড়ির সেই সাধারণ ছেলেটা, যে অসাধারণ সব কীর্তি গড়ে বসে আছে।

রিটায়ারমেন্টের কথাটা ভাবুন? সেখানেও রাহুল অসম্ভব সাধারণ। কোনও ‘গার্ড অব অনার’ ছিল না। কোনও কেঁদে ফেলা ভাষণ না। ছিল শুধু কিছু বন্ধুকে ফোন করে আগাম জানানো। আর পরের দিন প্রেস কনফারেন্স ডেকে ক্রিকেট-বিশ্বকে ধীর কণ্ঠে জানিয়ে দেওয়া, চললাম।

অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে, সত্তর দশকের শুরুতে একটা বই প্রকাশ পেয়েছিল। রিচার্ড বাখের লেখা ‘জোনাথন লিভিংস্টোন সিগাল’। রাহুল বইটা পড়েন অনেক বছর বাদে যখন তাঁর টিনএজ জীবন শেষের দিকে। ‘‘আমার বই পড়তে ভীষণ ভাল লাগে। হনুমন্ত সিংহ আমাকে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন। ‘জোনাথন লিভিংস্টোন সিগাল’। কোথাও আমার মনে হয়েছিল বইটা আমাকে ওই বয়সে এক্সেলেন্সের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা অসম্ভব স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তারপর থেকে বহু বই আমি পড়েছি। কিন্তু আমার মনে আর কোনও বই ওই রকম ছাপ ফেলেনি,’’ বলছিলেন রাহুল।

আজ রাহুলকে নিয়ে এত কথা লিখতে বসে ঘটনাটা মনে পড়ে গেল।

এটুকু বলতে পারি অনূর্ধ্ব ১৯-এর ওই ছেলেগুলোর কাছে তাদের কোচ যেন সব অর্থেই সেই সিগালের মতো।

জোনাথন দ্রাবিড় সিগাল।

(লেখক উইজডেন ইন্ডিয়া-র এডিটর ইন চিফ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE