চেতন আর অচেতনের সীমান্তে প্রতীক্ষায় বসে থাকে এক অবুঝ, অনির্বাণ ভালবাসা!
যে ভালবাসার কোথাও পৌঁছনোর নেই। কোনও লক্ষ্য নেই। হিসেব কষে ঠিক করা দূরদর্শী কোনও পরিকল্পনাও নেই। যে ভালবাসা লুটেরার মতো দরজা ভেঙে ঢুকে পড়তে চায় না। বরং দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে নতজানু হয়ে। অপেক্ষা করে।
করেই চলে।
বক্স অফিস আর বাণিজ্যিক হিসেব-নিকেশকে আপাতত একটু বিশ্রাম দেওয়া যাক। একশো-দুশো কোটির নিক্তিতে মাপার জন্য বাজারে অনেক ছবি আসে। ‘অক্টোবর’, মাফ করবেন, সেই গোত্রে পড়ে না। ঘটনার ঘনঘটা নেই। আবেগের আলোড়ন নেই। আরোপিত কোনও পরিণতি ঘটানোরও চেষ্টা নেই। গল্প যেন চলেছে নিজের ছন্দে। পরিচালক শুধু তাকে অনুসরণ করে গিয়েছেন। ভালবাসার গল্পও যে এতটা নির্মোহ ভাবে বলা যায়, এ ছবি না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
গল্পের আধার রাজধানী দিল্লি। পাঁচতারা হোটেলে ইন্টার্নশিপ করতে ঢুকেছে সদ্য হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ে বেরোনো একঝাঁক তরুণ-তরুণী। তাদেরই এক জন দানিশ ওয়ালিয়া বা ড্যান (বরুণ ধওয়ন)। তার স্বপ্ন শেফ হওয়ার। কিন্তু হোটেলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— সবই করতে হয় তাকে। তাই বিরক্ত ড্যানের কাজে মন বসে না। বকুনিও খায় উপরওয়ালার। ড্যানের সঙ্গেই ওই হোটেলে ইন্টার্নশিপ করতে ঢুকেছে শিউলি আইয়ার (বনিতা সান্ধু)। তারা বন্ধু। একসঙ্গে আড্ডা মারে, খাওয়াদাওয়া করে। তার বেশি কিছু নয়। এর মধ্যেই হঠাৎ দুর্ঘটনা। তার পর এক দিন ড্যান তার এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনে, শিউলি নাকি এক বার তার খোঁজ করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হোয়্যার ইজ ড্যান?’
অক্টোবর
পরিচালনা: সুজিত সরকার
অভিনয়: বরুণ ধওয়ন, বনিতা সান্ধু, গীতাঞ্জলি রাও
৭.৫/১০
শিউলির ওই একটি প্রশ্নই ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলে ড্যানকে। তার মনে হয়, শিউলি তাকে ভালবাসত। কিছু বলতেও হয়তো চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। শিউলি ও ড্যানের বন্ধুরা অবশ্য সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়। ড্যানকে তারা বলে, তার প্রতি শিউলির বিন্দুমাত্র আগ্রহও ছিল না। কিন্তু ড্যানের বিশ্বাস হয় না। ড্যানের হোটেলের কাজ শিকেয় ওঠে। সে পাশে দাঁড়ায় শিউলির মায়ের।
টানা কয়েক মাস হাসপাতালে থাকার পরে অবস্থার সামান্য উন্নতি হওয়ায় বাড়ি আনা হয় শিউলিকে। কিন্তু তখনও স্বাভাবিকতা থেকে সে বহু দূরে। এ দিকে, হোটেলের চাকরি নিয়ে পাহাড়ে চলে যায় ড্যান। কিন্তু তাকে ফিরে আসতেই হয়। শিউলির পিছুটানে। অবিরাম কথা বলে চলে তার সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করে, শিউলিও কি তাকে ভালবাসে? এ ভাবেই ধীরে ধীরে গল্পের চাকা গড়িয়ে চলে অপ্রত্যাশিত এক পরিণতির দিকে।
পরিচালক সুজিত সরকারের আরও একটি মাইলফলক এই ছবি। এবং অবশ্যই চিত্রনাট্যকার জুহি চতুর্বেদীর। ভালবাসার এমন একটি গল্প এত সংযত এবং সুন্দর ভাবে বলার জন্য। এই ছবিতে সংযম হারিয়ে ফেলার হাতছানি ছিল প্রচুর। সুজিত বা জুহি কিন্তু সে পথে পা বাড়াননি। গল্পের পরিণতিও তাঁদের সেই সংযমেরই সাক্ষ্য দেয়। সুজিতের ছবি মানেই এখন একটা বাড়তি প্রত্যাশা। বলতে বাধা নেই, সেই প্রত্যাশা তিনি ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন।
কিন্তু যাঁর কথা না বললে এই লেখা অসমাপ্ত থেকে যাবে, তিনি বরুণ ধওয়ন। তাঁর কমেডি বা অ্যাকশন আমরা দেখেছি। ‘বদলাপুর’ ছাড়া ভিন্ন ধারার ছবিতে তাঁকে বড় একটা দেখা যায়নি। কিন্তু ‘অক্টোবর’ তাঁর অন্যতম সেরা ছবি হয়ে থাকবে। নবাগতা বনিতাকেও ভাল লাগে। তাঁর ভাগে সংলাপ খুব কম। ছবির বড় একটা অংশ জুড়ে তাঁর অভিনয়টাই অভিব্যক্তির। এবং সেখানে তিনি চমৎকার। শিউলির মায়ের চরিত্রে গীতাঞ্জলি রাওয়ের অভিনয়ও অনবদ্য।
অধিকার বুঝে নেওয়া উচ্চকিত ভালবাসার গল্প নয়, ‘অক্টোবর’ আসলে শরতের সকালে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের মতো। নরম, নিষ্কলুষ আর নির্ভার। আঁজলা ভরে তুলে যার ঘ্রাণ নিতে হয়। এক বার নয়। বারবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy