Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাইলেন মান্না দে

লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীদক্ষিণ কলকাতার ‘হ্যাংলাথেরিয়াম’-এ একটা বাংলা ছবির সিডি রিলিজের অনুষ্ঠান। ওখানে আলাপ হল অন্বেষার বাবার সঙ্গে। বললাম, ‘‘আপনার মেয়ে আমাদের গর্ব। খুব ভাল গাইছে।

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

দক্ষিণ কলকাতার ‘হ্যাংলাথেরিয়াম’-এ একটা বাংলা ছবির সিডি রিলিজের অনুষ্ঠান। ওখানে আলাপ হল অন্বেষার বাবার সঙ্গে। বললাম, ‘‘আপনার মেয়ে আমাদের গর্ব। খুব ভাল গাইছে।’’ ভদ্রলোক সবিনয় বললেন, ‘‘ভাল আর কী দাদা! একটা সুন্দর কাজ করার চেষ্টা করছে। আরও ভাল তৈরি হতে হবে।’’ অন্বেষাও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। কতই বা বয়স! বলতে গেলে চূড়ান্ত সফলতা প্রায় পেয়েই গেছে। তবু কতটা প্রফেশনাল সংযম! স্বয়ং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বাড়িতে ডেকে তার গান শুনেছেন, আশীর্বাদ করেছেন।

এক অল্পবয়সি শিল্পীর কথায় যেমন এক প্রফেশনালিজম দেখলাম, ঠিক একই রকম মানসিকতা আজও কিংবদন্তি গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। বিজয়ার প্রণাম জানাতে ফোন করেছিলাম কয়েক দিন আগে। বহু দিন ধরে কৌতূহল ছিল। মান্নাদার সঙ্গে সায়েন্স সিটিতে শেষ অনুষ্ঠান। মান্নাদা নিজে এসেছিলেন লেক গার্ডেন্সে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। দু’জনে কয়েকটি দ্বৈত সঙ্গীত গাইবেন—‘চম্পা-চামেলি গোলাপের বাগে’, ‘আমায় চিরদিনের সেই গান বলে দাও’। একটু রিহার্সাল তো করতেই হয়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘প্রায় নব্বই বছর বয়সে মান্নাবাবু এসেছেন শুধুমাত্র দু’তিনটি গানের রিহার্সাল করতে। দিদি! এই অভিজ্ঞতাটা কেমন? সন্ধ্যাদি অবাক হয়ে বললেন, ‘‘এটা কোনও নতুন ব্যাপারই নয়। একসঙ্গে দু’জনে গাইব একটা অনুষ্ঠানে। রিহার্সাল তো করতেই হবে। ওটা একটা রুটিন কাজ। সব শিল্পীকেই এটা করতে হয়।’’ আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম, নিজেদেরও এরা ‘সব শিল্পীদের’ মতোই ভাবেন। সঙ্গীত একটা বিশেষ কাজ। কাজটাকে সব থেকে ভাল করার জন্য যা যা করার করতে হবে। এমনটা ভাবতেন মান্নাদা, এখনও ভাবেন সন্ধ্যাদি। আরও একটা ব্যাপার খুব অবাক করে। কী ভাবে সবাই তাঁদের পরিবার ও প্রফেশনকে ব্যালান্স করে চলতেন। মান্নাদা বহু বার এসেছেন ডোভার রোড বা যতীন দাস রোডে সুধীন দাশগুপ্তের বাড়ি। এসেছেন, গান শিখেছেন, নিজেদের মধ্যে কাজের কথা, তৎসহ আড্ডা চলেছে। সেখানে কিন্তু না মান্নাদা, না সুধীনবাবু পরিবারকে টেনে আনতেন। সুধান-পত্নী এখনও স্মরণ করেন সেই সব দিন—‘‘আমার কাজ ছিল ওনাদের সময় মতো চা এবং খাবার সাপ্লাই দেওয়া। সত্যি কথা বলতে কী, মিউজিক রুম থেকে ফিরে গান নিয়ে আর কোনও কথা নয়। তখন ডুবে যেতেন সংসারে। মান্নাদার কথা উঠলে উনি সব সময় বলতেন, খুব জেন্টলম্যান।’’ মঞ্জুশ্রীদেবী এখনও মান্নাদাকে এক স্নেহপ্রবণ দাদা হিসেবে মনে করেন। মান্নাদা যে তাকে ‘বোন’ বলে ডাকতেন। যতটুকু সময় দেখা হয়েছে, মনে হত উনি একটু অন্য রকম, আদ্যোপান্ত এক ভদ্রলোক।

সত্যি কিছু কিছু ঘটনা বারবার মনে করিয়ে দেয় শুধুমাত্র উদার মানসিকতা, চূড়ান্ত প্রফেশনালিজম এবং সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা, অন্যদের থেকে মান্নাদাকে পৃথক করে রেখেছিল। ‘পাহাড়ি ফুল’ ছবির গান লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুরকার নীতা সেন। সবাই চাইছেন মান্নাদার গান। সত্তরের দশক। তখন মান্নাদাকে ধরাই মুশকিল। আর একটা কঠিন সমস্যা ছিল। গান শুনে মান্নাদা তো গাইতে রাজি হয়ে গেলেন। রেকর্ডিং হবে বাগবাজারের একটা স্টুডিওতে। সমস্যা সেখানেই। তিনতলায় স্টু়ডিও। লিফট নেই। এসি-ও নেই। মোটামুটি ভাবে মিউজিশিয়ানদের একটা তালিকা তৈরি করেছেন মিউজিক অ্যারেঞ্জার চন্দন রায়চৌধুরী। তাঁর কেরিয়ারের একদম প্রথম দিক। তার ওপর মান্নাদা গাইবেন। প্রবল চাপের ব্যাপার। বাদ্যযন্ত্রীদের নাম মান্নাদা অ্যাপ্রুভ করে দিয়েছেন। প্রত্যেকেই খুব নামী-দামি। রবি রায়চৌধুরী (চন্দন রায়চৌধুরীর বাবা), নির্মল বিশ্বাস, সমীর শীল, রাধাকান্ত নন্দী, ওয়াই এস মুলকি, চন্দ্রকান্ত নন্দী। যোগাযোগ করতে গিয়ে চন্দনের মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা। মান্নাদা যে-ডেট দিয়েছেন সেদিন অলোকনাথ দে-র অন্য একটা রেকর্ডিঙে এই মিউজিশিয়ানরা আগে থেকেই বুকড। কী হবে? ডেট পরিবর্তন করলে মান্নাদাকে পেতে আবার অনেক দিন। শ্যুটিঙের শিডিউলে গোলমাল হয়ে যাবে। অতএব ব্যাপক ভাবে মিউজিশিয়ান অ্যাডজাস্ট করতে হল। তখন তো লাইভ রেকর্ডিং। মিউজিশিয়ানরা গানের সঙ্গে সঙ্গে বাজাবেন। সবাই ভয়ে তটস্থ। মান্নাদা এলেন। লিফট নেই শুনে সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে উঠে গেলেন। রেকর্ডিস্ট হিমাদ্রি ভট্টাচার্য। গৌরীনাথ শাস্ত্রীর ভাইপো।

আলাপ হল মান্নাদার সঙ্গে। প্রায় সারাদিনের কাজ। মান্নাদা একটু উসখুস করছেন। চন্দন ভয়ে ভয়ে বলল—‘‘আসলে এখানে এসি নেই। আপনার একটু কষ্ট হবে’’। মান্নাদা একবার শুধু ‘ও মাই গড’ বলে বললেন— ‘‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। চলুন কাজ শুরু করা যাক’’। এ বারেই তো আসল সমস্যা। সবাই ভাবছে, মান্নাদা যখন দেখবেন মিউজিশিয়ানরা প্রায় সবাই পাল্টে গেছে, হয়তো রেগেমেগে চলেই যাবেন। কিন্তু বলতে তো হবে। তখন সে দিনকার যন্ত্রীরা একে একে আসতে শুরু করেছেন। ‘যা হয় হবে। আর তো কিছু করার নেই’ ভেবে চন্দন মান্নাদাকে ঘটনাটা বলল। মান্নাদা সব শুনলেন। ফ্লোরে গৌরীপ্রসন্ন, নীতা সেনও আছেন। মান্নাদা কোনও রি-অ্যাক্ট করলেন না। বললেন—‘‘চলুন, আমরা কাজটা শুরু করি’’। প্রবল গরম। কুড়ি বারের বেশি টেক করলেন। তার পরেও বলছেন— ‘‘দেখুন, ঠিক আছে তো?’’ এত দিন সিনিয়রদের কাছে শুনেছেন। সে দিন সামনে থেকে কাজের ভিতর দিয়ে চন্দন দেখলেন সংগীতের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে। প্রথম দিনের সেই মুগ্ধতা আজও তাঁকে জড়িয়ে রয়েছে সমান ভাবে।

মান্নাদার বহু দিনের রিদিমিস্ট কুন্দন সাহা। দীর্ঘ দিন মান্নাদার সঙ্গে বাজিয়েছে রেকর্ডিংয়ে, অনুষ্ঠানে। মান্নাদার অনেক গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টও করেছে। একই অভিজ্ঞতা। এমন প্রফেশনাল শিল্পী। প্রতি মুহূর্তে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মান্নাদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেবারে স্বচ্ছ। ‘মানুষ আমার গান শুনতে এসেছে। আমার দায়িত্ব তাদের খুশি করা। কোনও ফাঁকির জায়গা নেই’। ওড়িশার বারবিন নামে এক জায়গায় মান্নাদার অনুষ্ঠান। ঘণ্টাখানেক গাওয়ার পরে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। খোলা স্টেজ। অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হল। মান্নাদার প্রচণ্ড মুড অফ। বারবার বলছেন—‘‘ওরা এত টাকা খরচ করে আমাদের এনেছে। কত মানুষ বসে আছে গান শুনবে বলে। আমি তো আর এর মধ্যে আসতেও পারব না’’। অনেকক্ষণ পরে বৃষ্টি অনেকটা ধরে এল। অল্প ঝিরঝির করে পড়ছে। মান্নাদা হঠাৎ বললেন, ‘‘অনুষ্ঠানটা এ বার শুরু করা যায়। কিন্তু তবলা ছাড়া গাইব কী করে? তবলায় বৃষ্টি পড়লে তো সর্বনাশ। আচ্ছা কুন্দন, তোমার কঙ্গো তো সিন্থেটিক ছাউনি। এই বৃষ্টিতে আর কী করা যাবে। চলো চলো’’। সেই দৃশ্যের কথা ভাবুন। ওড়িশার এক অখ্যাত জায়গা। শুধুমাত্র আয়োজক এবং শ্রোতাদের কথা ভেবে ঝিরঝির বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাইছেন সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীতসাধক মান্না দে।

মান্নাদার একেবারে প্রায় শেষ দিককার একটা কাজের গল্প বলছি। অবাক হয়ে যেতে হয় যে শেষ বয়স পর্যন্তও গান-বাজনার ব্যাপারে মান্নাদা কতটা প্রফেশনাল ছিলেন। নচিকেতা ঘোষের কন্যা, সুপর্ণকান্তির ছোট বোন শ্রাবণীর জন্য ২০১০ সালে মান্নাদা দুটো গানের সুর তৈরি করে দিয়েছিলেন। ২০১২ নাগাদ গানগুলোর রেকর্ডিং হয়। মান্নাদা এবং সুপর্ণদার ইচ্ছেতে মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট করে কুন্দন। সময়ের ধারা মেনে অ্যাকুয়িস্টিক বেসড প্রোগ্রামিং করল কুন্দন। একটা ভয় যে ছিল না তা নয়। তবু আশা একটু ছিলই, মানুষটা যে মান্না দে। হলও তাই। বয়স তখন হোক না তিরানব্বই। কিন্তু তিনি তো সর্বদা সমসাময়িক। অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের। বললেন— ‘নাইস’।

২৪ অক্টোবর মান্নাদার তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে হল অনেক স্মরণ-অনুষ্ঠান। নতুন ভাবে অনুভব করলাম, কতটা সমসাময়িক এবং এখনও প্রাসঙ্গিক মান্নাদার গান এবং মান্নাদা নিজে। গাইছিলেন নচিকেতা। বাংলা গানের লিরিকের বিষয় এবং বিন্যাসে একটা ভাঙচুর এনেছিলেন তিনি। বলতে গেলে বাংলা গান এখন সেই পথেই হাঁটছে। নচিকেতা জানালেন, ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি তিনি মান্নাদার কথা ভেবেই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মান্না দের সঙ্গে সে ভাবে যোগাযোগ করা যায়নি। এখনও তার গলায় আফসোস। একবার মান্না দের সঙ্গে দেখা হল না। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, বর্তমান সময়ের একজন অন্যতম আধুনিক কম্পোজার গান বাঁধছেন মান্না দে গাইবেন ভেবে। নচিকেতার গাওয়া ‘বৃদ্ধাশ্রম’ মান্না দে শুনেছিলেন এবং সব সময় গানটির ভূয়সী প্রশংসা করতেন। গান। নচিকেতা শেষ গানটি করলেন যেটি মান্না দে গেয়েছিলেন আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগে। গাইছেন বর্তমান সময়ের এক কবিয়াল। গানটি শুরু করার আগে সবিনয় বললেন, ‘‘গানটি পুরো কোনও দিন গাইতে পারিনি। জানি আজও পারব না। খুব কষ্ট হয়’’। তাই হল। প্রথম অন্তরা পর্যন্ত গাইলেন। সার্থক গানের অসহ্য বেদনায় শুনলাম সেই অসম্পূর্ণ গান—‘মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE