মান্নাদা একেবারে গলদঘর্ম। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। হাতে কুঁচকে যাওয়া ধুতি। খুব করুণ মুখে বললেন, ‘‘অনেক চেষ্টা করলাম শিবাজি, কিন্তু এই ধুতিটাকে কিছুতেই কায়দা করতে পারছি না। কী করি বলো তো?’’
সময়টা দু’হাজার সাত-টাত হবে। খুব ঘটা করে ‘উত্তর কলকাতা উৎসব’ হচ্ছে। আর এই উৎসবে মান্নাদা থাকবেন না, তা তো হয় না। তখনও তিনি ভারতবর্ষের ব্যস্ততম শিল্পী। সারা পৃথিবী জুড়ে অনুষ্ঠান করছেন। পাশাপাশি চলছে নতুন গানের রেকর্ডিং।
মান্নাদাকে রাজি করানোর দায়িত্ব পড়ল এই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা গায়ক শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ের উপর। সবাই শিবাজিকে বলল, ‘‘তুমি বললে মান্নাদা ‘না’ বলতে পারবেন না।’’ এটা কিন্তু সত্যি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত স্নেহ করতেন শিবাজিকে। অনেক ছবিতে নিজে না গেয়ে তাঁরই অসাধারণ সব সুর-করা গান গাইয়েছেন শিবাজিকে দিয়ে। বিশেষ করে তরুণ মজুমদারের অনেক ছবিতে। শুনলে হয়তো অনেকে অবাক হবেন, বিশেষত এই কারণেই শিবাজির প্রতি মান্নাদারও একটা আলাদা স্নেহ ছিল।
মান্নাদার কাছে অ্যাপ্রোচটা অবশ্য যথাযথ হওয়া চাই। যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে শিবাজি ফোন করল মান্নাদাকে। ‘‘মান্নাদা! এই উৎসবে আপনাকে আসতেই হবে। কত মনীষী জন্মেছেন উত্তর কলকাতায়—কবিগুরু, স্বামীজি, গিরিশ ঘোষ, রামমোহন, কৃষ্ণচন্দ্র দে, স্বয়ং আপনি...। প্রয়াতদের সবাইকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানাতে আপনি ছাড়া আর কে পারবে? সবাই আশা করে আছি।’’
সঠিক ভাবে প্রস্তাব পেশ হল। মান্নাদা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। সাহস পেয়ে শিবাজি বলল, ‘‘মান্নাদা, মাত্র দুটো অনুরোধ আছে। আপনাকে কিন্তু রাখতেই হবে।’’
মান্নাদা বললেন, ‘‘এই তো বললে অন্য ধরনের অনুষ্ঠান। আমাকে আবার গাইতেও হবে নাকি?’’
শিবাজি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘‘না, না, গাইবার কথা বলছি না। এক, বৌদিকে নিয়ে আসতে হবে। দুই, আপনাকে ধুতি-পাঞ্জাবি ড্রেসে চাই। আমি তো আপনাকে আনতে যাব। ধুতি-পাঞ্জাবি নিয়ে যাব।’’ মান্নাদা আর ‘না’ বলতে পারলেন না।
অনুষ্ঠানের দিন শিবাজি গিয়ে উপস্থিত মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে মান্নাদা একটু পরেই নামবেন। নামলেন বটে, কিন্তু অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত অবস্থায়। অতি কঠিন সুরের গান কণ্ঠস্থ করতেও এত ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাঁকে। মান্নাদা বললেন, ‘‘কী করি বলো তো? আমার কি আর ধুতি পরার অভ্যাস আছে?’’ শিবাজি বলল, ‘‘আমি পরিয়ে দিচ্ছি।’’ মান্নাদা সভয়ে বললেন, ‘‘তাহলে আমাদের অনুষ্ঠানটাই পণ্ড হবে। সব সময় মনে হবে এই বুঝি ধুতি খুলে গেল! তার থেকে তোমার কথাও থাক, আমার কথাও থাকুক। তোমার পাঞ্জাবি তো পরেছি। সঙ্গে এই পাজামাটাই থাক।’’
শিবাজি তো মনে মনে দারুণ খুশি। এমন ড্রেসেই বা ক’জন মান্নাদাকে দেখেছেন? শিবাজি ‘ঠিক আছে’ বলতে মান্নাদা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘বাঁচালে বাবা!’’ এদিকে ততক্ষণে বৌদি রেডি হয়ে এসে গেছেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘শিবাজি, ইউ গেভ হিম এ ডিফিকাল্ট টাস্ক। আই থিংক হি কুড নট পাস।’’
সেই অনুষ্ঠান যাঁরা দেখেছিলেন তাঁরা সত্যিই পরম ভাগ্যবান। দেখলেন এক অন্য মান্না দে-কে। দুটি প্রমাণ সাইজের মালা আগে থেকেই রেডি করা ছিল। সবার হয়ে শিবাজি অনুরোধ করল—‘‘মান্নাদা! আমরা সবাই চাই আপনি আর বৌদি দু’জন দু’জনকে মালাদুটো পরিয়ে দিন।’’ মান্নাদা সানন্দে রাজি।
ঈশ্বর মান্নাদাকে এক সমুদ্র, এক আকাশ ভালবাসা দিয়েছিলেন। এ সব কিছুই উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণাধিক স্ত্রীকে। এক অকৃত্রিম ভালবাসার সাক্ষী হয়ে রইল ভাগ্যবান কলকাতা। নতুন করে হল ভালবাসায় মাল্যদান। বাকি ছিল আরও কিছু পাওয়া। মান্নাদা ও বৌদি একসঙ্গে গাইলেন, ‘আবার হবে তো দেখা’। মান্নাদার মুড এসে গেল। কথা না থাকলেও আপন খুশিতে শুনিয়ে গেলেন একটার পর একটা গান। ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’...সেই পাওয়ার আনন্দ সত্যিই দারুণ।
মান্নাদা তখন ভীষণ ভাবে কলকাতায় একটা বাড়ি খুঁজছিলেন। সল্ট লেক মান্নাদার পছন্দের জায়গা। কলকাতার এক জায়গায় সরকারি উদ্যোগে তৈরি একটা ফ্ল্যাটের খবর দেওয়া হল মান্নাদাকে। ‘কতটা জায়গা?’ শিবাজিদা যোগাযোগ করছিলেন। বললেন, ‘‘বারোশো স্ক্যোয়ার ফুটের মতন হবে।’’ ‘‘না, অত ছোট জায়গায় হবে না।’’ মান্নাদা বললেন, ‘‘সল্ট লেকে বাড়ি দ্যাখো। পছন্দ হলে আমি কিনে নেব।’’
কয়েকটা বাড়ি দেখা হল। মান্নাদা কলকাতায় এসে একদিনেই সব ক’টা বাড়ি দেখলেন। একটি বাড়ি মান্নাদার বেশ পছন্দ হল। খোলামেলা। যেমনটি তিনি চান। ঘুরে ঘুরে দেখলেন মান্নাদা। বাড়ির লোকজন তো পুরো হতভম্ব! বাড়িতে স্বয়ং মান্না দে! তাদের কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। যাক! বাড়ি তো দেখা হল। মনে হল মান্নাদা বেশ খুশিই হয়েছেন। অতএব চা-সহযোগে শুরু হল আড্ডা। মধ্যমণি মান্না দে। সবাই হাতজোড় করে আছে। ভাল লেগে গেলে মান্নাদা মন থেকে মিশে যান। এক ঘণ্টারও বেশি সময় কেটে গেল। জানি না, সেই বাড়ির মানুষেরা হয়তো আজও সেই সুখস্মৃতি মনে করেন আর ভাবেন—কাউকে যদি বলি এ ঘটনা, কেউ কি বিশ্বাস করবে?
শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই বাড়িটা মান্নাদার আর কেনা হয়নি। খুব বড় দুর্ভাগ্য আমাদের এই কলকাতার!
পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করে খুবই আনন্দ পেতেন মান্নাদা। শিবাজি-অরুন্ধতী-সৈকত একটি অডিও কোম্পানি করলেন, নাম ‘গোল্ড ডিস্ক’। ওখানে বেশ ভাল ভাল কাজ হচ্ছে। সবার মনে হল, মান্নাদার সুরে একটা নতুন গানের অ্যালবাম হলে কেমন হয়? ওতে গাইবেন এ যুগের সব শিল্পী—হৈমন্তী, অরুন্ধতী, ইন্দ্রনীল, সৈকত, শ্রীকান্ত প্রমুখ। সাহস করে মান্নাদার কাছে প্রস্তাবটা পাড়া হল। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে মান্নাদা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘‘তোমরা গাইবে, এ তো আনন্দের কথা।’’ তবু তো এরা সবাই এ যুগের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। ঠিক পেশাদার শিল্পী হিসেবে নয়, শুধুমাত্র ভালবেসে স্নেহবশত মান্নাদা অমূল্য সুর দান করেছেন সরকারি ইঞ্জিনিয়ার অশোক ভট্টাচার্যকে—এক আধটা নয়, চার-চারটি গান।
মান্নাদা কী চাননি, আর কী চেয়েছিলেন? আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের সুরে সেই যে গেয়েছিলেন—‘অভিনন্দন নয়, প্রশংসা নয়/ নয় কোনও সংবর্ধনা/ মানুষের ভালবাসা চাই শুধু আমি/ এইটুকু শুভকামনা।’ সত্যি, মানুষের অন্তহীন ভালবাসায় তিনি আপ্লুত হয়েছেন। শুধুমাত্র গানের পত্রিকা ‘আশাবরী’র জন্য মান্নাদার ইন্টারভিউ নিতে বেঙ্গালুরু যাচ্ছে সুরকার ও পত্রিকার সম্পাদক অশোক ভদ্র। কলকাতার দই মান্নাদার খুব প্রিয়। অতএব সঙ্গে বড় এক হাঁড়ি দই মান্নাদার জন্য। হ্যান্ড-লাগেজেই নিতে হবে। কিন্তু আটকে দিল সিকিউরিটি। দইয়ের হাঁড়ি প্লেনের ভিতরে কোনও ভাবেই নিয়ে যাওয়া যাবে না। অশোকের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। সিকিউরিটির এক বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করল অশোক। তিনি খুব দুঃখপ্রকাশ করলেন, এবং শেষে বললেন, ‘‘আমাকে আর অনুরোধ করবেন না প্লিজ।’’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অশোক বলল, ‘‘দুঃখটা কী জানেন? মান্নাদা কলকাতার এই দই খেতে খুব ভালবাসেন। ওনার জন্যই নিয়ে যাচ্ছিলাম।’’
‘‘কার জন্য? মান্না দে?’’ লাফিয়ে উঠলেন সেই অফিসার। বললেন, ‘‘আমি তো ওনার অন্ধ ভক্ত। কিছু একটা করতে হয়।’’ এর পর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সিকিউরিটির লোকজনই দইয়ের হাঁড়ির বিশেষ প্যাক করল। অনুমতির ব্যবস্থা হল। অশোক ধন্যবাদ জানালে সেই অফিসার বললেন, ‘‘এ তো আমার ভাগ্য। দয়া করে আমার প্রণাম ওঁকে পৌঁছে দেবেন।’’
অশোকের কাছে এই ঘটনা শুনে মান্নাদা অশ্রুরুদ্ধ গলায় বললেন, ‘‘সবার এত ভালবাসা! এই ঋণ আমি কী করে মেটাব?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy