Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

চাকরি ছাড়ার ভাবনা ছাড়ুন

বাড়িতে থাকলেও কারণে অকারণে অশান্তিতে বাচ্চা খিটখিটে হতে পারে। লিখছেন রেশমি বাগচীইদানীং শহরে মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যায় জেরবার সকলেই। ফোনের কানেকশন কেটে যাওয়ায় সব চেয়ে বেশি নাজেহাল শহরের অভিভাবকরা। কারণ কর্মরত বাবা মায়েদের কাছে, সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই তো মোবাইল। মেয়ে নতুন ক্লাসে কোন টেবিলে বসল, কে ক্লাস টিচার, বা ছেলের ক্রিকেট কোচিং-এ যাওয়ার আগে খাবারের কথা মনে করিয়ে দেওয়া, এই সব ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা কি মোবাইল ছাড়া হয়, বলুন তো। হ্যাঁ, কারণ কর্মরত বাবা মায়েদের কাছে সময় বলতে ওই টিফিন ব্রেক কিংবা ক্লায়েন্ট মিটের মাঝের সময়টুকু।

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

ইদানীং শহরে মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যায় জেরবার সকলেই। ফোনের কানেকশন কেটে যাওয়ায় সব চেয়ে বেশি নাজেহাল শহরের অভিভাবকরা। কারণ কর্মরত বাবা মায়েদের কাছে, সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই তো মোবাইল। মেয়ে নতুন ক্লাসে কোন টেবিলে বসল, কে ক্লাস টিচার, বা ছেলের ক্রিকেট কোচিং-এ যাওয়ার আগে খাবারের কথা মনে করিয়ে দেওয়া, এই সব ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা কি মোবাইল ছাড়া হয়, বলুন তো। হ্যাঁ, কারণ কর্মরত বাবা মায়েদের কাছে সময় বলতে ওই টিফিন ব্রেক কিংবা ক্লায়েন্ট মিটের মাঝের সময়টুকু। বাচ্চার সঙ্গে দেখা হতে হতে তো সেই রাতের খাবারের সময় ডাইনিং টেবিলে। সেই জন্যই তো ফোনে সারাক্ষণ সন্তানের সব খবরাখবর রাখা। আপনি বাচ্চার জন্য আরও সময় দিতে চেষ্টার কসুর করেন না, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু খেয়াল রাখবেন আপনার এই ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাঝে পড়ে সন্তানের সঙ্গে আপনার মানসিক দূরত্ব যেন বেড়ে না যায়।

ছোট্ট শৌভিক, তার বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতে খুব ভালবাসত। বাবার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যেত। ও ছোট থেকেই খেয়াল করেছিল, বাবার সঙ্গে কোথাও গেলেই দারুণ সমাদর করত সকলে। শৌভিক ভাবত, কী করে হয় এমনটা। (শৌভিকের বাবা অত্যন্ত স্বনামধন্য লেখক ছিলেন)। তার পর ধীরে ধীরে সে বুঝতে শিখল, তার বাবা-মা সাধারণ নন, বিশেষ মানুষ। তাই তো সারা দিনরাত বাড়িতে প্রচুর লোকের সমাগম। অনেক সেলিব্রিটি আসতেন। এই জমজমাট পরিবেশে আস্তে আস্তে শৌভিক কেমন আলাদা হয়ে পড়ল। বাবা-মায়েরও, শৌভিকের জন্য সময় কমে গেল। তার যখন ১০-১১ বছর বয়স, ধীরে ধীরে তার নিজের জগতে ঢুকে গেল শৌভিক। আজ শৌভিক বস্টন নিবাসী বহু বছর। খড়গপুর থেকে আইআইটির পর পড়াশোনাও বিদেশে। তার পর চাকরি। নিজের ছেলে অয়নকে খেয়াল করেছেন, একটু নজর কম হলে, কেমন অভিমান করে। শৌভিক মেলাতে পারেন নিজের ছোটবেলার সঙ্গে। তাঁরও অভিমান হত। কিন্তু সে কথা বোঝার মতো সময় কি ছিল তার বাবা মা-র? ছোটবেলার ওই ‘আর একটু সময়’ না পাওয়াই থেকে গেল তার। এই ছোট ছেলেটি আর কেউ নন, স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্তান শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়। শৌভিকের আক্ষেপ, বাবা-মায়ের কাছ থেকে, আর একটু সময় পেলে তাঁর বাংলা সাহিত্যে আর বাংলা গানের প্রতি অনুরাগ জন্মাত। তা হলে কি নীললোহিতের ভুবনডাঙা অধরাই থেকে গেল তাঁর কাছে?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথায় কথায় জানা গেল তাঁর মনের কথা। ‘‘ছটফট করতাম। আমাদের কাজ তো আর ১০টা-৫টার নয়। পরিকল্পনা করে রেখেও অনেক সময় পারিনি সন্তানদের পাশে থাকতে। হয়তো যখন সময় বের হল, তখন ওরাও ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে।’’ ঠিক এই পরিস্থিতিতে, আজকের ব্যস্ত অভিভাবকরা কী করে থাকেন? খুব সহজ উপায়। সন্তানকে সময় দেওয়ার বিনিময়ে কোনও জিনিস কিনে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সময়ের বিনিময়ে, সফট টয়, কম্পিউটার গেম, এমনকী ট্যাবও। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এত পেতে পেতে, চাহিদা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা যেমন আছে, তেমনই আছে প্রত্যাখ্যান সহ্য না করার মানসিকতা।’’

নৃত্যশিল্পী তনুশ্রীশঙ্কর, মেয়ে শ্রীনন্দাকে কাছে রেখে বড় করার চেষ্টা করেছেন। বিদেশে পরের পর শো, শ্রীনন্দাও যেতেন আনন্দ ও তনুশ্রীর সঙ্গে। ‘‘বাবা বলতেন, চলো আমাদের সঙ্গে, তোমার জিওগ্রাফি ভাল হয়ে যাবে,’’ মুম্বই থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে, শ্রীনন্দার গলায় ধরা পড়ে ছোট্ট মেয়ের সারল্য। যদিও শ্রীনন্দা বড় হওয়ার পর সে সুযোগ কমে এলো। স্কুলের পরীক্ষা থাকত। ‘‘আমাকে দূরে দূরে থাকতে হয়েছে একটা সময়,’’ রিহার্সালের মাঝে স্মৃতি ছুঁয়ে বলে ওঠেন তনুশ্রী। মনোবিদদের কথায়, এই দূরত্ব অনেক সময় অভিভাবকদের মনে অপরাধবোধের জন্ম দেয়। বিশেষ করে মায়ের মনে। উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা, রত্নাগিরি দেব, যেমন এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন, চাকরি ছাড়বেন। ছোট ছেলে বাড়িতে। কিছুতেই কাজে মন বসত না। খুব কষ্ট হত তাঁর। কিন্তু চাকরি ছাড়লেই কি সব সমস্যার সমাধান সম্ভব? মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম সে কথা মানছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘সন্তানকে বড় করতে যে তাদের সারাক্ষণ ঘিরে থাকতে হবে এমন নয়। কর্মরত মা-বাবারা বেশি সময় দিতে না পারলেও, যদি হাসিখুশি পরিবেশ দেয় বাচ্চাকে, তা হলে সন্তানের বড় হওয়া অনেক মসৃণ হবে। তা না করে, আপনি চাকরি ছেড়ে বাচ্চাকে অনেক সময় দিচ্ছেন ভাবছেন। আর বাড়িতে নানা কারণে অশান্তি চলছে। তাতে খিটখিটে স্বভাবের হয়ে পড়ে সন্তান।’’

মনোবিদের পরামর্শ

১। সন্তানকে সময় দেওয়া, বাবা এবং মা উভয়ের দায়িত্ব

২। কতক্ষণ সময় দিলেন না ভেবে, কোয়ালিটি টাইম দিন।

৩। অপরাধবোধে ভুগবেন না, হাসিখুশি থাকুন।

৪। বাচ্চার মধ্যে আকস্মিক স্বভাবগত পরিবর্তন হলে, বিশেষ নজর দিন।

৫। বাচ্চাকে ঘুষ (অকারণ জিনিস কেনা) দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

আরও একটা বিষয় সম্পর্ককে সহজ করে সন্তানের সঙ্গে। তা হল, নিজেদের ইচ্ছা, সন্তানের ওপর চাপিয়ে না দেওয়া, বলছেন তনুশ্রীশঙ্কর।। শ্রীনন্দা ছোট থেকেই সাজতে এবং সাজাতে ভালবাসতেন। সেখান থেকেই লন্ডনে মেক আপ নিয়ে পড়াশোনা। মুম্বই এবং কলকাতা মিলিয়ে বিস্তৃত তাঁর কাজের পরিধি। তিনি মেক-ওভার আর্টিস্ট। আর এখন তো মেক-ওভারের পাশাপাশি পুরোদমে চলছে অভিনয়ের কাজও। শঙ্কর পরিবারের সদস্য বলে, তাকে বাদ্যশিল্পী বা নৃত্যশিল্পী হতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। সৌমিত্র-কন্যা পৌলমী বসুও নিজের স্বতন্ত্র পথ বেছে নিয়েছেন। চাননি পর্দায় অভিনয় করতে। ছোট থেকেই নাচ তাঁর সঙ্গী। তার পাশাপাশি চলেছে মঞ্চে অভিনয়। প্রথম নাটক, উৎপল দত্তের সঙ্গে, ‘আজকের শাহজাহান’। কিন্তু এত বড় কিংবদন্তির কন্যা, কেন পর্দায় অভিনয়ের কথা ভাবলেন না? পৌলমি জানান, তিনি পর্দা থেকে সচেতন ভাবেই দূরে থাকতে চেয়েছেন। কারণ তুলনা করাটা মানুষের চরম কৌতূহল। যখন নাটক করেছেন, সেখানেও তাড়া করেছে বিখ্যাত অভিনেতার সন্তান হওয়ার বিড়ম্বনা। তাই আঁকড়ে ধরেছেন নাচ। ‘‘আমি মঞ্চে নাচলে, আর যাই হোক, কেউ বলতে পারবে না, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসে পারফর্ম করে দিয়ে গিয়েছেন,’’ অভিমান ঝরে পড়ে পৌলমীর গলায়।

সুনীল-পুত্র শৌভিকও লেখালেখি করতে চাননি। ছোট থেকেই অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন। ভাল যেমন ছিল, খারাপও ছিল। ছোট থেকেই এই নানা অভিজ্ঞতা তাঁকে লেখার জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ওই গোলকধাঁধায় নিজেকে জড়াতে চাননি তিনি। শুধু সেলিব্রিটি সন্তান বলে নয়, অনেক সময়, বাবা-মায়ের দেখানো পথ নিতে অস্বীকার করে সন্তান। কারণ তারা নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চায়। চায় না অভিভাবকের সঙ্গে কোনও তুলনা হোক তার। কিন্তু সেই দূরত্ব কী ভাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ঘুচিয়েছেন, তা বলতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা বললেন পৌলমী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। প্রচণ্ড ব্যস্ততা। এদিকে কোনও কারণে মেয়ের মন খারাপ। মেয়ের মানভঞ্জন করতে সোজা বাড়ি এসে মেয়েকে নিয়ে গঙ্গার পাড়ে বেড়াতে চললেন। ভুট্টা খেতে খেতে বাবা-মেয়ের পায়চারি, আর তাঁদের দেখতে হাজার খানেক মানুষের ভিড়।আজও কোনও বই পড়ে ভালো লাগলে, ফোন তুলে মেয়েকে বলে দেন পড়তে। ফোনেই চলে বাবা-মেয়ের সাহিত্য চর্চা।

অতএব, কতক্ষণ সময় দিলেন, তার চেয়েও জরুরি, কী ভাবে সেই সময় কাটালেন সন্তানের সঙ্গে। কার্টুন কেন, আপনিই হয়ে উঠুন না ওর আনন্দের একমাত্র নেটওয়ার্ক। আপনি পারেন না এমন কোনও কাজ নেই। তাই অযথা চাকরি ছাড়ার ভাবনা ছাড়ুন। আনন্দে বাঁচুন। আপনি হাসিখুশি থাকলে, সন্তানও রামগরুড়ের ছানা হবে না। নিন, আর দেরি করবেন না। গরমের ছুটিতে তাড়াতাড়ি টিকিট কাটুন। কোথাও ঘুরে আসুন। আর হ্যাঁ, ভাল করে ছবি তুলবেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দেখে নেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE