Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আঁতলামি নেই বিনোদন আছে

নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের যুগ্ম পরিচালনার ছবি বলতে এই ক’বছরেই একটা ব্র্যান্ড দাঁড়িয়ে গিয়েছে। খুবই সমসাময়িক বিষয়, গোছানো গল্প, মাপাজোকা চিত্রনাট্য, বিনোদন ও চিন্তার ভারসাম্য, অযথা আঁতলেমি নয়, নির্মাণের পারিপাট্য এবং বাঙালির মন বোঝা। এর সবই ওঁদের সদ্যমুক্ত ‘বেলাশেষে’ ছবিতে আছে। মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন সৌমিত্র-স্বাতীলেখা। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের যুগ্ম পরিচালনার ছবি বলতে এই ক’বছরেই একটা ব্র্যান্ড দাঁড়িয়ে গিয়েছে। খুবই সমসাময়িক বিষয়, গোছানো গল্প, মাপাজোকা চিত্রনাট্য, বিনোদন ও চিন্তার ভারসাম্য, অযথা আঁতলেমি নয়, নির্মাণের পারিপাট্য এবং বাঙালির মন বোঝা। এর সবই ওঁদের সদ্যমুক্ত ‘বেলাশেষে’ ছবিতে আছে। প্রথমেই বলি এ ছবি অসম্ভব রকম মন-জয়-করা ছবি হবে দর্শকের কাছে। জোরালো হাততালি পাওয়ার ছবি, তবে অন্তঃশীলে খুবই প্রাপ্তবয়স্ক একটা সমস্যাচিন্তা বা প্রবলেমে দাঁড়ানো। সমস্যাটা বিবাহবিচ্ছেদের। তবে ততটা বিচ্ছেদের নয় যতটা বিবাহকে বেঁধে রাখার। বিষয়টাকে বেশ একটা ডিসকোর্স বা ব্যাখ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়ার উপক্রমও করছিল ‘বেলাশেষে’। সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের দোরগোড়ায় এসে সফল প্রকাশক বিশ্বনাথ মজুমদার তাঁর বিবাহিত পুত্রকন্যাদের জড়ো করে ঘটা করে ঘোষণা করলেন, তিনি তাঁদের মা-র থেকে বিবাহবিচ্ছেদ চাইছেন। সেই মতো কোর্ট পেপার্সও তৈরি করেছেন।

স্ত্রী আরতির কাছে তো বটেই, ছেলেমেয়েদের কাছেও এ এক নেপালি ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে কত কে জানে! ছেলেমেয়েরা তো এসেছিল সম্পত্তি ভাগাভাগির স্বপ্ন দেখে। এসে সংসার ভাগাভাগির নাটকে পড়ল। তাতে নিজেদের জীবনেরও কিছু পরিস্থিতি ও সমীকরণের ঘূর্ণিতে পড়ল। বৃদ্ধা স্ত্রী আরতি তো বিশ্বাসই করতে পারলেন না তাঁর কর্তা আদৌ এটা ঘটাচ্ছেন বলে। স্বামীর এটা আরেক ঠাট্টা ভেবে উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

নন্দিতা-শিবপ্রসাদ পুরো ছবিটাকে এক গাম্ভীর্য ও ঠাট্টার দোলাচলে ধরতে চেয়েছেন। বিশ্বনাথ থেকে শুরু করে পরিবারের বাকিরা ব্যাপারটাকে কে কী ভাবে নিচ্ছে, তা নিয়েই বাকি ছবিটা। খুবই মনোরঞ্জক নিঃসন্দেহে। তবে সেই যাত্রাপথে মূল সমস্যাটি কোথাও যেন কিছুটা দীর্ঘ হয়ে পড়েছে।

ছবিটা দেখতে দেখতে ক্ষণিকের জন্য দুটি অসাধারণ ছবির স্মৃতি উঁকি দিয়েছিল মনে। টেলিভিশনের জন্য তোলা ‘বাগবান’-এর ছ’এপিসোড ছবি ‘সিনজ ফ্রম আ ম্যারেজ’, যেখানে দাম্পত্যের অবসাদ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বামী ও স্ত্রী কিছুকাল অন্তর অন্তর মিলিত হয়ে ছেড়ে যাওয়ার কারণগুলো নিয়ে কথা বলে এবং জীবনস্মৃতিতে ফিরে যায়।

‘বেলাশেষে’তেও আদালতের আজ্ঞায় পনেরো দিনের জন্য বিশ্বনাথ ও আরতি শান্তিনিকেতনে গিয়ে নিজেদের অতীতের পুনরাবিষ্কারের সুযোগ নেয়। কিন্তু আরতি তার দস্তুরমতো ছেলে, ছেলের বৌ, কন্যা, জামাই, নাতি-নাতনি, গোটা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের টিম নিয়ে সেখানে হাজির হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বৃদ্ধ দম্পতির শোয়ার ঘরে লুকনো ক্যামেরা বসিয়ে পাশের বাড়িতে বসে গোটা পরিবার মিলে তা দেখা ও শোনার ব্যবস্থা করে ফেলে। এই আধুনিক যান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ও লঘুরঞ্জন ক্রমশ প্রতর্ক্যটিকে মন থেকে সরিয়ে দেয়।

অভাব, অশান্তি নেই। অথচ এক অবোধ অসুখ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বলে যে সম্পর্ক আদালত অবধি গড়াল (এবং যে কারণে আমার ক্ষণিকের জন্য মনে পড়েছিল ডাস্টিন হফম্যান, মেরিল স্ট্রিপ অভিনীত ‘ক্রেমার ভার্সাস ক্রেমার’ ছবিটা)। তার গড়ন ও আরও নির্জনতা ও আত্মসমীক্ষা দাবি করছিল। খুচরো, আটপৌরে মান-অভিমান আরতিকে মানায়, ততটা বিশ্বনাথকেও কি? তবে খুব মন স্পর্শ করে বিশ্বনাথের যুক্তি যে তিনি আরতিকে ছাড়তে চান তাঁকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর করার জন্য।

‘বেলাশেষে’ এক অসাধারণ সু-অভিনীত ছবি। কাকে ছেড়ে কাকে দেখবেন? আর কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের কোনও তুলনাই হয় না। বাঙালি সমাজে আশি বা আশির কাছাকাছি বয়সে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে, এ তো প্রায় অলীক ঘটনা। বিলেত, আমেরিকায় হয়। সে তো অন্য ব্যাপার। বাঙালির মধ্যে তেমন কোনও বৃদ্ধ চরিত্রটি ঠিক কেমন হবে? ভাবা খুব মুশকিল ছিল। আসান করলেন সৌমিত্র। আহা, কী অপূর্ব ভাবে চিত্রনাট্যের কল্পিত সংলাপকে জীবনের সংলাপ করে দিলেন!

‘ঘরে-বাইরে’র বিমলা হিসেবে সেদিনের স্বাতীলেখা আমার হৃদয় স্পর্শ করেননি। এবার ‘বেলাশেষে’র আরতি হয়ে মনটা ভাসিয়েই দিলেন। এত বিশ্বাসযোগ্য চাহনি, ভাবভঙ্গি, নড়াচড়া, হাসি— চশমা পরে বাইরের কোনও কাজ সেরে ফেলা আরতিতে কী রূপান্তর!

খরাজ মুখোপাধ্যায়ের জ্যোতির্ময় নিয়ে ওরই স্টাইলে একটাই কথা বলার— ফাটাফাটি। শুধু কমিক রিলিফ নয়, শেক্সপিয়রের নাটকে ‘ফুল’ বা বিদূষকের মতো মর্মবিদারী মন্তব্য করারও যেন দায়িত্ব ওর। বাবার সঙ্গে মেয়ে মিলির তর্ক সুন্দর ফুটেছে ঋতুপর্ণার ইংরেজি মেশানো বাংলা সংলাপে। ওর বর হিসেবে বেশ লাগল সুজয়প্রসাদকে, চাপা মানুষ, কথা কয় এস্রাজে, ‘তুমি রবে নীরবে’ বাজিয়ে। যা বিশ্বনাথের মতো আমাদেরও চোখে জল এনে দেয়। কন্যা বুড়ির চরিত্রে এক মস্ত আবিষ্কার অপরাজিতা আঢ্য। এই বুড়ি চরিত্র এতই দেখি আমরা চারপাশে আজকাল যে ধারণা হল তাদের কেউ যেন উঠে এল পর্দায়। এই বিশ্বাসযোগ্যতা ও অনুভূতির অনুরণন বিশ্বনাথের বড়ছেলের রোলে শঙ্কর চক্রবর্তীর মধ্যেও। প্রশংসা করার মতো হয়েছে মনামী ঘোষ-ইন্দ্রাণী দত্তর মতো চরিত্রগুলো। এবং বিশেষ করে দিদা আরতির আঁচল ধরা বাচ্চাটি।

গোপী ভগতের ক্যামেরার কাজে একটা সরল সৌন্দর্য ভর করে। এ ছবিতেও করেছে। সুর সম্পাদিত ছবিটির ভরবৃদ্ধি করেছে বিনীতরঞ্জন মিত্রের আবহসঙ্গীত। অনিন্দ্য-অনুপমের ‘বেলাশেষে’ গানটা ভাল, কিন্তু সত্যিকারের থিম সঙ বলতে গেলে এস্রাজে ধরা রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো। নন্দিতা-শিবপ্রসাদের ‘মুক্তধারা’র পর বাংলা ছবিতে এত সুপ্রয়োগ দেখলাম রবীন্দ্রসঙ্গীতের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE