শত্রু ছাড়া কি মানুষ বাঁচে? খাদ্য, আচ্ছাদন, আশ্রয় বা যৌনতা যেমন তার প্রয়োজন, তেমনই শত্রুতা না-হলেও বুঝি আর চলে না। আর তাই দুনিয়ায় কোনও যুগে, কোনও দেশে, কখনওই মানুষে মানুষে শত্রুতার অভাব ঘটেনি। কখনও ধর্ম নিয়ে, গায়ের রং সাদা-কালো নিয়ে, ভাষা নিয়ে, মতবাদ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে, ধনী-দরিদ্র নিয়ে — এই শত্রুতার প্রধান ইন্ধন হল অস্মিতা বা ইগো।
বহু দিন আগে ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ দেখেছিলাম। আর ‘রোমিও জুলিয়েট’য়ের অন্তত তিনটি ফিল্ম, যার একটি ছিল ব্যালে। রোমিও আর জুলিয়েটের যদি বিয়ে হত, সুখে ঘর-সংসার করত, তা হলেও তারা একদিন মারা যেত ঠিকই। তবে তাদের নিয়ে নাটক লেখার তাগিদ শেক্সপিয়র বোধ করতেন না। আর যে নাটকটা লিখলেন, সেটা আবার অনেক যুগ পেরিয়ে এসে আজও এমন জলজ্যান্ত, প্রাসঙ্গিক, যে কিছুতেই আর্কাইভে পাঠিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। নানা পোশাকে, নানা দেশে, নানা ভাষায় এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে বারবার দু’জন ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু এ রকম ভুতুড়ে বই আছে, যা বারবার পড়লেও জীর্ণ হয় না। শেলফে তুলে রেখেও বারবার টেনে বার করে রুদ্ধশ্বাসে পুনর্পাঠ করতে হয়।
অপর্ণা সেন তাই করেছেন। এই ধীময়ী মহিলা ইতিপূর্বেও আমাদের একাধিকবার চমকে দিয়েছেন। কখনও অভিনয়ে এবং পরবর্তী কালে পরিচালনায়। আমরা ‘চৌরঙ্গী লেন’ বা আয়ার দম্পতির কথা ভুলিনি, কিন্তু তবু এবারের শেষটা বড্ডই জোরাল।
‘আরশিনগর’ নিয়ে কিছু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। ছন্দোময় সংলাপ, গীতিময় ছবি, রোমিও-জুলিয়েটের পুনর্নিমাণ ইত্যাদি। হলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এ সব গুঞ্জনকে তেমন গুরুত্ব দিইনি।। তবে অপর্ণা যে উপেক্ষা করার মতো পরিচালক নন সেটা আমরা ভালই জানি। কিন্তু রোমিও জুলিয়েটের আরও একটা বঙ্গ সংস্করণ দেখতে যাওয়ার তাগিদ বোধ করছিলাম না। আজকাল সিনেমা দেখা একরকম বন্ধই করে দিয়েছি। কিন্তু পাকেচক্রে যেতে হল।
প্রথমেই বলি, এ ছবির চিত্রনাট্য এবং সংলাপেই আমাকে মুগ্ধ করেছেন অপর্ণা। তিনি কবিতা বোঝেন, এটা আমার জানা ছিল। কিন্তু অন্ত্যমিলের মজাসহ যে দুর্দান্ত আধুনিক সংলাপ এই ছবিতে পেলাম তা অভিনব। ‘হীরকরাজার দেশে’ ছবিতে সত্যজিৎ রায় এ রকমই সংলাপ বসিয়েছিলেন হীরকরাজার জবানিতে। ‘আরশিনগর’য়ে তা নয়। এখানে সকলের কথাতেই অন্ত্যমিলের মজা। আগাগোড়া। কাজটা কঠিন ছিল। কিন্তু চমৎকার উতরে গিয়েছে।
‘আরশিনগর’ও আর কে নারায়ণের মালগুড়ির মতো কাল্পনিক একটা জায়গা, কাল্পনিকই বটে, তবে অচেনা নয়। আমাদেরই আনাচকানাচ নিয়ে এই শহর বা জনপদ। আরশিনগরের প্রধান বসবাসকারীরা বস্তি ও ঝুপড়িবাসী। চারদিকটা নোংরা, পুতিগন্ধময়, কিন্তু অবস্থানটি লোভনীয়, কারণ এই ভূমিখণ্ডটির উপর ডন তথা প্রোমোটারদের জুলজুলে নজর রয়েছে। তাদের ব্যক্তিগত গুন্ডাবাহিনীর বিচরণস্থল, তোলা আদায় এবং দাপাদাপিও এই আরশিনগরেই। যুযুধান দুই দলের একজন খান, অন্যজন মিত্র। মুসলমান ও হিন্দু। নায়িকা খান-কন্যা, নায়ক মিত্র-তনয়। এই দুই ভূমিকায় কিশোরী ঋতিকা আর দেব। এক বিপন্ন সময়ে তাদের চকিত সাক্ষাৎ। এবং তৎক্ষণাৎ প্রেম। এ গল্প সবাই জানেন। কারণ এ প্রায় সবার গল্প। আবার নায়িকার বাবা ডন-রূপী খান, অর্থাৎ কৌশিক সেন আর নায়ক জননী-রূপী জয়া শীল তাদের যৌবনকালে পরস্পরের প্রণয়াসক্ত ছিল। খান ছিল দক্ষ ঘুড়িবাজ। তার ঘুড়ি ওড়ানোর দক্ষতা পাশের ছাদ থেকে দেখে জয়া তার প্রেমে পড়ে যায়। সে ধর্মান্তরিত হতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু গোঁড়া বাবার প্রতিবন্ধকতায় বিয়েটা হয়ে ওঠেনি।
যুযুধান দুই ডনের মাঝখানে আরশিনগর, যার ওপর দু’জনেরই লুব্ধ চোখ। ফলে দু’জনেরই গুণ্ডাবাহিনী মাঝে মাঝেই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘাতের চিত্রায়নটি হয়েছে অনেকটা নৃত্যনাট্যে। প্রায় সমস্ত ছবিটাতেই ব্যালে, অপেরা, নৃত্যনাট্য, কবিতা আর কোমল প্রীতিময়তা। মানুষের লোভ-লালসা, হিংস্রতা, হননেচ্ছা আরোপিত হয়েছে ভিন্নতর মাত্রায়, যা কোমল লাবণ্যে সব বীভৎসতাকে একটু আবছায়ায় রাখে। সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রকে ধন্যবাদ। এই কাজে তাঁর অবদান ভোলার মতো নয়।
ছবিটাকে নিয়ে একটু মুশকিলও আছে। ঠিক এ ধরন বা ঘরানার চলচ্চিত্র দেখতে কিন্তু আমবাঙালি অভ্যস্ত নয়। প্রেক্ষাগৃহে বসে বোঝা যাচ্ছিল সকলেই ছবিটার সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছেন না বা সংযোগ ঘটছে না। নতুন কিছু হলেই এই বিপন্নতা থাকে। কিন্তু আমি সর্বদাই নতুনত্বের পক্ষে।
গল্পটার বিবরণ অনাবশ্যক। এই বিয়োগান্ত মধুর কাহিনিটি সকলেরই জানা। বিশেষত্ব এই যে, এই গল্পে সাপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটা দৃঢ় বার্তা আছে। অভিনয় সকলেরই যথাযথ। যিশুকে একটু বেশি মনে থাকবে। আর ছবিতে পার্বতী বাউলকে ব্যবহার করায় আমি খুব খুশি। তাঁর ভূমিকা যেন অনেকটা বিবেকের মতো।
আলাদা করে বলার মতো আরও একটি ব্যাপার আছে ‘আরশিনগর’-এ। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়া, অতীত-বর্তমানে কাহিনির সঞ্চারণা, সংলাপ থেকে হঠাৎ সঙ্গীতে রূপান্তর ইত্যাদি ব্যাপারে সম্পাদনাটি হয়েছে অতীব শিল্পসম্মতভাবে।
আর ‘কুছ তো লিখ যা... মওলা’ কাওয়ালিটি কানে লেগে থাকে। গল্পের শেষে একটি নাটকীয় শ্লেষ ঘটানো হয়েছে। শিখ ছদ্মবেশী মুসলমান নায়িকাকে খুন করে মুসলমান গুণ্ডারাই। আর হিন্দু দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত হয় বোরখা পরা নায়ক।
এই ছবির প্রাণ হল তার গীতিময়তা। সঙ্গীতও কখনও কখনও সংলাপেরই ভূমিকা নেয়। শ্রীজাত এই ক্ষেত্রটিতে খুবই সফল হয়েছেন। অন্তত তাঁর রচিত একটি গান তো আমার খুবই ভাল লেগেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy