বহু বছর আমি বলিনি ওঁকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যখনই সুযোগ হত আমাকে ও জীবন সম্বন্ধে নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনাত। আমি কিছু বলতে গেলে বলত, ‘‘ফারহা শাট আপ। আই অ্যাম এলডার টু ইউ। লিসন টু মি।’’
আমিও চুপচাপ শুনতাম ওর কথা। বাদ সাধল একটা আউটডোরের সময় যখন ও আমার কাছে আমার পাসপোর্ট চাইল। পাসপোর্টে আমার বয়স দেখেই আমাকে ফোন।
‘‘ফারহা, তুনে কভি বোলা নহি তু মেরে সে উমর মে বড়া হ্যায়?’’ হাসতে হাসতেই বলল শাহরুখ।
আমি আর হাসি চাপতে পারিনি। ওকে বলেই ফেললাম, ‘‘আমি তো ছ’মাসের বড়ই কিন্তু তুমি এত জ্ঞান দিতে আর আমার ব্যাপারে কেয়ার করতে, কোনও দিন বলতে ইচ্ছে করেনি।’’ সে দিন খুব হেসেছিলাম দু’জনে।
আমার কিছু দিন আগে পঞ্চাশ হল। আজ শাহরুখের হাফ সেঞ্চুরি।
শাহরুখের পঞ্চাশ! বিশ্বাস হয় না।
ফিটেস্ট ফিফটি ইয়ার ওল্ড
কী করে যে সময়টা কেটে গেল, কে জানে! ঠিক পঁচিশ বছর আগে ওর সঙ্গে প্রথম বার দেখা হয়েছিল। ১৯৯০। ‘কভি হা কভি না’য়ের সেটে। জামাকাপড়ের ঠিকঠিকানা নেই, একটা টি-শার্ট আর জিন্স। চুলগুলো উসকোখুসকো। আজকে ওই দিনটায় ফিরে তাকালে মনে হয়, কে জানত সেই আলাপটা জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা অ্যাসোসিয়েশন হয়ে উঠবে।
আগেই বললাম, বিশ্বাসই হয় না শাহরুখের পঞ্চাশ। তার কারণ, আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি শাহরুখের মেন্টাল এজ এখনও পঁচিশ।
পঁচিশ না হলে কেউ অত খাটতে পারে? লাস্ট পাঁচ বছর দেখছি, ও নিজের কাজের ‘পেস’টা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ওর থেকে কুড়ি বছরের ছোটরা ওর এনার্জির সঙ্গে পেরে ওঠে না। কারণ শাহরুখ আমার দেখা ‘ফিটেস্ট ফিফটি ইয়ার ওল্ড’।
সে দিন ‘দিলওয়ালে’র গানটার শ্যুটিং হচ্ছে আইসল্যান্ডে। আমি কোরিওগ্রাফার। তা শটের আগে সকালবেলা আমার বহু দিনের অভ্যেস স্টারদের কস্টিউমটা দেখে নেওয়া। কাজলের কস্টিউমটা অ্যাপ্রুভ করার পর, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে শাহরুখের জামাকাপড় দেখাতে আনল। বিশ্বাস করুন, আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। পঞ্চাশ বছরের শাহরুখের ওয়েস্ট সাইজ কত জানেন?
আঠাশ ইঞ্চি।
হ্যাঁ, ভুল বলিনি, ২৮। ওর যা শিডিউল তাতে জিম করার যে খুব সময় ও পায় তা নয়। পুরোটাই ওর ডায়েট যেটা আমার মতে রাবিশ কিন্তু ওর শরীর, এই ডায়েটটা নিতে পারে। কাপের পর কাপ ব্ল্যাক কফি। মাঝেমধ্যে কোলা আর সকাল-বিকেল তন্দুরি চিকেন। এই ডায়েট বোধহয় কুড়ি বছর মেনটেন করছে ও।
জীবনীশক্তির নামই শাহরুখ
আজ পঞ্চাশে পড়ার দিনে শাহরুখের ব্যাপারে একটা কথাই মনে হয়। আশেপাশে যে দিকে দেখবেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অনেকের স্বপ্ন দেখার ইচ্ছেটাও একটু একটু করে কমে যায়। কিন্তু শাহরুখকে দেখে তা কে বলবে! প্রত্যেক দিন কী করে আরও বড় ছবি করা যায়, আরও নতুন নতুন কী করা সম্ভব ওর কোম্পানি রেড চিলিজের — তাই ভেবে চলেছে সর্বক্ষণ।
আমরা অনেকেই বলি, উফ, এই কাজটা হল না কারণ সময় হয়নি সারা দিনে। ওর সঙ্গে একদিন কাটালে বুঝতে পারবেন একদিনে সত্যি কতগুলো কাজ করা যায়।
সত্যি তো পৃথিবীর অন্যতম বড় স্টারের নাম শাহরুখ খান। ও যা অ্যাচিভ করে ফেলেছে, তা অনেকেই ছুঁতে পারবে না। আমি আগে ওকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘‘ইউ ডোন্ট ফিল টায়ার্ড?’’ শুনে হেসে বলত, ‘‘ফারহা, দেয়ার ইজ সো মাচ টু ডু।’’ এই জীবনীশক্তির নামই শাহরুখ খান।
এত দিনে প্রপার বাবা হয়েছে
আজকে আমারও পরিবার রয়েছে, তিন ছেলেমেয়ে। বহু সময়ে এমন হয়, শাহরুখ ওর প্রাইভেট পার্টিগুলোতে যেতে বলে কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, স্কুলের হোমওয়ার্কের জন্য যেতে পারি না। কিন্তু যখনই সুযোগ পাই তখনই ওর সঙ্গে গল্প করে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি।
এই যেমন এক মাস আগে করলাম। আইসল্যান্ডের গান শেষ করার পর শাহরুখ কিছুতেই আমাকে দেশে ফিরতে দেবে না। জোর করে নিয়ে গেল লন্ডনে ওর বাড়িতে।
লন্ডন শাহরুখের সেকেন্ড হোম। তখন ওখানে ওর বাচ্চারাও ছিল। ওখানেই প্রথম দেখলাম বাচ্চাদের সঙ্গে ওর ইন্টার্যাকশনটা কী লেভেলের। বাচ্চারা ওকে স্টার হিসেবে দেখেই না। কেউ ওকে আবদার করছে, কেউ দুষ্টুমি করছে, কেউ জিনিস ছড়িয়ে রাখছে ড্রয়িংরুমে। শাহরুখ সেগুলো সরিয়ে রাখছে নিজে, ওদের গল্প বলছে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবনের নানা শিক্ষা দিচ্ছে বাচ্চাদের। দু’দিন দেখার পর আমি বলেই ফেললাম, ‘‘শাহরুখ, এত দিনে বুঝতে পারলাম তুমি প্রপার বাবা হয়েছ।’’
কিধর হ্যায়, কাম ওভার
তবে লন্ডনে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে শাহরুখের জীবন নিয়ে নানা কথা হল। এই একটা পরিবর্তন এসেছে ওর মধ্যে গত দশ বছরে। আগে শাহরুখ ঠিক যতটা হ্যাপি-গো-লাকি ছিল, এখন ঠিক ততটাই ফিলোজফিক্যাল হয়ে গেছে।
কী নিয়ে আলোচনা হয় শাহরুখের আমার সঙ্গে? বেশির ভাগটাই ফ্যামিলি সংক্রান্ত। ওর জীবনের বহু ঘটনা ও আমাকে বলে। আমিও বলি আমার জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা। এটা এমন একটা বন্ডিং যেটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না আমার কাছ থেকে।
আর একটা জিনিস বলি। একটা সময় শাহরুখের অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য আমরা সবাই নানা কিছু করতাম। একটা ইনসিকিওরিটি ছিল ওর ক্লোজ গ্রুপের সবার মধ্যে। আজ সবাই বোধহয় আমরা নিজের নিজের জায়গাটা বুঝতে পেরেছি। আজ আর কথা না বললে ইনসিকিওর্ড লাগে না। জানি শাহরুখ আছে আমাদের সবার জন্য। আর যে দিন ওর সত্যি কথা বলতে ইচ্ছে করে, সে দিন ওর ফোনটা ঠিক চলে আসে, ‘‘কিধার হ্যায় তু, কাম ওভার।’’
আজ যখন ও পঞ্চাশে পা দেবে, আমি শিওর ও মুম্বইতেই থাকবে। জন্মদিনের দিন ও শ্যুট করে না। .
এই পঁচিশ বছরে একবারই বোধহয় ও জন্মদিনের দিন শ্যুটিং করেছে।
সেটাও ‘ম্যয় হুঁ না’র সেই কাওয়ালি গানটার জন্য, ‘তুমসে মিলকে দিলকা হ্যয় জো হাল ক্যয়া কহে...’। আমরা যারা ওর খুব কাছের, নিশ্চয়ই ওকে উইশ করব একটু বেলার দিকে। আর আমার ছবির একটা ডায়ালগ আমি তো অন্তত বলবই সে দিন।
বলব শাহরুখ, জাস্ট হাফ সেঞ্চুরি হল। এবার সেঞ্চুরি চাই।
পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy