Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের দুই ‘এস’, পি ভি সিন্ধু আর সাইনা নেহওয়ালের প্রতিদ্বন্দ্বিতার তল খুঁজলেন সুমিত ঘো

এক গুরু, দুই ‘এস’, আর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা

রুদ্ধশ্বাস দ্বিতীয় গেমে দুরন্ত র‌্যালি জিতে তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে দিলেন শূন্যে। সঙ্গে সেই বিখ্যাত গর্জন, যা রিও অলিম্পিক্স থেকেই দেখা যাচ্ছে।

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩৩
Share: Save:

রুদ্ধশ্বাস দ্বিতীয় গেমে দুরন্ত র‌্যালি জিতে তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে দিলেন শূন্যে। সঙ্গে সেই বিখ্যাত গর্জন, যা রিও অলিম্পিক্স থেকেই দেখা যাচ্ছে।

পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু উচ্ছ্বসিত! এই ম্যাচটি তাঁর কাছে সম্মানের লড়াই! এটা প্রমাণ করার মঞ্চ যে, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে ‘এস ফ্যাক্টর’ বলতে এখন তিনিই।

কিন্তু সিন্ধুর গুরু কোথায় গেলেন! এটা যে তাঁর কাছেও কুরু বনাম পাণ্ডবের লড়াই! শুধুই দেশের সেরা দুই ব্যাডমিন্টন তারকার র‌্যাকেটের ঝনঝনানির ম্যাচ নয়, এখানে উড়বে প্রতিহিংসার রংও। আর বদলার সেই হোলি খেলায় মধ্যমণিই যে তিনি, পুল্লেলা গোপীচন্দ!

অবশেষে দেখা গেল তাঁকে। অন্যান্য ম্যাচের মতো টাচলাইনে বসেননি। বিস্ময়কর! ধরা হয়েছিল, সাইনাকে হারানো মাত্র তিনি নিশ্চয়ই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবেন সিন্ধুকে। হয়তো বা বলবেনও অস্ফুটে ছাত্রীকে যে, ধন্যবাদ। আজ তুই আমার হয়ে বদলাটা নিলি। কিন্তু কোথায় কী! ওই তো গুরু গোপীচন্দ। গ্যালারিতে ভিআইপি আসনে উঠে দাঁড়ালেন। সিন্ধু জেতায় খুশি, হাততালি দিয়ে অভিনন্দনও জানালেন। কিন্তু কী নিয়ন্ত্রিত আবেগ প্রদর্শন! দেখে কে বলবে, শুধু অলিম্পিক্সে রুপোজয়ী তাঁর ছাত্রীই জিতলেন না, তিনি নিজেও ব্যক্তিগত লড়াইয়ে সসম্মানে উতরোলেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতোই মহাকাব্যিক এই তিন জনের সম্পর্কের ইতিহাস। ব্যাডমিন্টনে হায়দরাবাদের দুই ‘এস’ কন্যা এবং তাঁদের গুরু গোপীচন্দ। দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিয়নে ২০১৪ এশিয়ান গেমসের আগে সাইনা যখন জানালেন, তিনি গোপী স্যারকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে ভূমিকম্প ঘটল যেন! গোপীচন্দের থেকে সাইনার আলাদা হয়ে যাওয়া মানে যে টোনি নাদাল ও রাফায়েল নাদালের বিচ্ছেদ!

সাইনা সংবাদমাধ্যমকে জানান, টেকনিক্যাল কয়েকটি কারণে গোপীচন্দের অ্যাকাডেমি ছাড়ছেন। কিন্তু ব্যাডমিন্টন মহল আজও মনে করে, বিচ্ছেদের আসল কারণ পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চির দীর্ঘকায় আর এক ‘এস’, পি ভি সিন্ধু। বলা হয়, যাঁর ব্যাডমিন্টনে আসা সাইনাকে দেখে। একেবারেই ঠিক কথা নয়। সিন্ধুর ব্যাডমিন্টনে আসা গোপীচন্দের কথাতেই। বাবা রামানা ছিলেন দেশের প্রাক্তন ভলিবল প্লেয়ার। অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন। ছয় বছর বয়সে সিন্ধুকে দেখে গোপী বলেছিলেন, ‘‘ব্যাডমিন্টন খেলবে। বাবার মতো ভলিবলে যাবে না।’’

কে জানত, ভবিষ্যতের এক থ্রিলারের শুভ মহরৎ হয়ে গেল সে দিনই। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই হায়দরাবাদে ইন্ডিয়ান গ্রঁ প্রি সেমিফাইনালে পৌঁছে হইচই ফেলে দিলেন সিন্ধু। তখনও তিনি এবং সাইনা একসঙ্গে গোপীর অ্যাকাডেমিতেই ট্রেনিং করছেন। কিন্তু যত সময় এগোতে থাকল, উন্নতি করতে থাকলেন সিন্ধু, যত জিততে থাকলেন, সংঘাতের বারুদও যেন ততই জমতে থাকল।

সাইনা মনে করতেন, তিনিই ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের অর্জুন এবং গোপীচন্দ একমাত্র তাঁরই দ্রোণাচার্য। গাণ্ডীব-ধনুক নিয়ে অন্য যে-ই আসুক আশ্রমে, সে কখনও অর্জুনের স্থান বা মর্যাদা পাবে না। বরং তাকে একলব্য হিসেবেই দেখবেন দ্রোণাচার্য। আঙুল কেটে নিয়ে ‘অর্জুন’কেই অপরাজেয় থাকতে সাহায্য করবেন। সাইনার সেই বিশ্বাস প্রবলভাবে ধাক্কা খেল যে দিন অ্যাকাডেমিতে দেখলেন, স্পেশ্যাল ট্রেনিং শুরু হয়ে গিয়েছে। গুরু গোপী আলাদা ক্লাস করাচ্ছেন তাঁর নতুন রত্ন সিন্ধুকে। চেঁচাচ্ছেন, উৎসাহিত করে যাচ্ছেন তাঁকে। এত দিন এ রকম ক্লাস বরাদ্দ ছিল শুধু সাইনা নেহওয়ালের জন্যই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সে দিনই সাইনা বুঝে গেলেন, দ্রোণাচার্যের আশ্রমে তিনি আর একমাত্র অর্জুন নন।

২০১৪ এশিয়ান গেমসের আগে পাকাপাকি বিচ্ছেদ ঘটলেও আগে এক বার গোপীকে ছাড়তে চেয়েছিলেন সাইনা। এক শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শে শেষ পর্যন্ত মত পাল্টান। গাড়ির মধ্যে বসে সে বার তিনি গোপীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, তাঁর কাছেই থাকতে চান। কিন্তু সাময়িক মিটমাট হলেও গুরু-ছাত্রীর সম্পর্ক চিরস্থায়ী হয়নি।

হায়দরাবাদে দুই কন্যাকে বহু দিন ধরে দেখে আসা ব্যক্তিরা দু’জনের ভিন্নধর্মী চরিত্রের দিকটাও তুলে ধরেন। সাইনা বেশি আত্মকেন্দ্রিক। সিন্ধু খোলামেলা, বন্ধুবৎসল। সাইনা চুপচাপ থাকেন, সিন্ধু হুল্লোড় করতে ভালবাসেন। দু’জনের দু’টি পথ যেন সত্যিই মেলার নয়।

এর সঙ্গে অহরহ চলতে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সাইনার বন্ধুরা অনুযোগ করেন, গোপীর কাছে থাকার সময় বার বার তাঁকে সিন্ধুর সঙ্গে প্র্যাকটিস গেম খেলানো হচ্ছিল। তাতে সিন্ধুর সামনে ‘ওপেন’ হয়ে যাচ্ছিল সাইনার খেলার ভঙ্গি। গোপীর অ্যাকাডেমি ছেড়ে চলে যাওয়ার নাকি এটাও অন্যতম কারণ। ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে নিজের ‘গেম’কে আড়াল করতে চেয়েছিলেন সাইনা। আবার সিন্ধুর সমর্থকেরা বলেন, কখনওই তাঁর অগ্রগতিকে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট দেখিয়ে গ্রহণ করতে পারেননি সাইনা। আন্তর্জাতিক সাফল্যকে সেলিব্রেট করতে হায়দরাবাদে এক বার বড় পার্টি দিয়েছিলেন সাইনা। আমন্ত্রিতদের তালিকায় অনুপস্থিত উল্লেখযোগ্য নাম, পি ভি সিন্ধু। দিল্লিতে সম্প্রতি সিন্ধু জেতার পরেও সাংবাদিক সম্মেলনে আসেননি সাইনা।

গোপী যদিও কখনও সাইনার বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি প্রকাশ্যে। এ নিয়ে বার বার জিজ্ঞেস করেও তাঁর কাছ থেকে শুধু প্রাক্তন ছাত্রীর জন্য স্নেহই মিলেছে। আশ্রমিক শৃঙ্খলাতে অ্যাকাডেমি চালান তিনি। নিজেও শৃঙ্খলারক্ষার উদাহরণ রাখতে চান।

নাকি মনে পড়ে যায় নিজের জীবনের কথা আর মুখ বুজে প্রায়শ্চিত্ত করেন? এক দিন তিনিও যে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি কোচ সৈয়দ মহম্মদ আরিফকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

P. V. Sindhu Saina Nehwal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE