Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

তুফান আনতে ১৪ ফেব্রুয়ারি লাগে না

আলাদা করে প্রেম দিবসে তাঁর কেন আসক্তি নেই? লিখছেন সুবোধ সরকারআলাদা করে প্রেম দিবসে তাঁর কেন আসক্তি নেই? লিখছেন সুবোধ সরকার

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

সে বার আমেরিকায় ঝড়, নিউ জার্সি জলের তলায়। আমি টরন্টোতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাহিত্যসভা আই.এফ.ও.এ সেরে বাড়ি ফিরব। ২০৫৬-টা ফ্লাইট ক্যানসেল। আমি ভয় পেলাম। ওরা তিনটে ল্যাপটপে ৪৮ ঘণ্টা খুটখুট করে একটা পথ বের করল কলকাতা ফেরার। আমেরিকাকে বাইপাস করে আমস্টারডামে নামলাম। তার পর রাত তিনটের সময় নামলাম দিল্লির বিমানবন্দরে। টার্মিনাল তিন থেকে বেরিয়ে দেখি রাত তিনটের সময় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে আসা মেয়েটি কপাল থেকে চিন্তার চুল সরিয়ে আমাকে একগাল হেসে বলল, ‘‘আপনি কানাডা থেকে এসএমএস করেছিলেন, ঝড় থেমে গেলে ‘দেখা হবে চন্দনের বনে’।’’ মাত্র তিন দিন আগে চলে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি কুড়িটি প্রেমের কবিতার জন্য অমর হয়ে গেছেন, সুনীলদার মৃত্যু যেন আমার বাঁ দিক থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নিয়ে গেছে। নবমীর নিশি পার হয়ে অক্টোবরের শেষ, ঝড়় ও পিতৃবিয়োগের মাঝখানে মনে হল, আজ ভ্যালেন্টাইন ডে।

‘গোলাপ-দিন’ চলে গেল। মানে ইন্টারন্যাশনাল ‘রোজ ডে’ চলে গেল। লেক মার্কেটের আনত গোলাপটির দাম ছিল ২০ টাকা, তার দাম উঠল ৫০। একেই বলে বেওসা। মারবে আমেরিকায়, লাশ পড়বে লেক মার্কেটে, শোভাবাজারে। ‘চকোলেট ডে’ চলে গেল।

যত ‘ডে’ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে হট হল ভ্যালেন্টাইন। ভালবাসতে হলে কার্ড চাই, দাম আছে, ভালবাসতে হলে রেস্তোরাঁ নিয়ে যেতে হবে, দেখলে হবে, খরচা আছে, ভালবাসতে হলে তুমি দেবে হাফ প্যান্ট, আমি দেব করসেট (টাপুর টুপুর ঢাকা থাকে, বাকিটা থাকে না), সন্ধেবেলায়, মল-সন্ধেবেলায় শপিং করে যখন পাড়ার মোড়ে ওলা থেকে নেমে সিংসপা গাছের তলায় দাঁড়াব, তখন তুমি বলবে ‘বাই’। আমি বলব ‘বাই বাই’। একে বলে ভ্যালেন্টাইন ডে। যত শপিং করবে, তত ভ্যালেন্টাইনের বিপদসীমা বাড়বে। যত বিপদসীমা বাড়বে, ততই বিন্দাস। ভালবাসার শ্রেষ্ঠ অংশের নাম বিরহ। তাকে আমরা কোকের বোতলে প্যাক করে ছেড়ে দিয়েছি। আমার মা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এ পারে, গীতা মুখস্থ বলতে পারা মা বেঁচে থাকলে বলতেন, ‘পেছনে নাই চাম, হরেকেষ্টর নাম।’ যাদবপুর, প্রেসিডেন্সির ছেলেমেয়েদের দেখলে আমার মনে হয় আমেরিকা থেকে বেড়াতে এসেছে, বাবা-মাকে ভরসা দিয়ে, ‘ম্যয় হুঁ না’ বলে আবার আমেরিকায় চলে যাবে। নিজের ছেলেকে নিয়ে এ জন্যেই তো কুড়ি বছর আগে লিখেছিলাম

ছেলে খারাপ হলে বিপদ

ছেলে ভাল হলেও বিপদ

খারাপ হলে সারা পাড়া অভিশাপ দেবে

ভাল হলে আমেরিকা কেড়ে নেবে।

আগে আমরা ছিলাম অ্যাংলো-ক্লোন। ছিলাম ইংরেজ। আমরা এখন আমেরিকান-ক্লোন। চার পাশে সব ছোট ছোট ক্লোন ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুকে চে এবং চকোলেট, হাতে গিটার, জিনসে গবাক্ষ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

যাদবপুরের চায়ের দোকানে অন্ধকারে বসে আছে বনলতা সেন। সে একটা পোড়া পাঁউরুটি আর এক ভাঁড় চা অর্ডার করেছে। তাকে কেউ বলবে না ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ আজ সবাই গেছে বনে, ভ্যালেন্টাইনের বনে।

ভালবাসা কি একটি দামি মোবাইল? লোককে ডেকে দেখাতে হবে! ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে, এসএমএসে লাল-লাল হৃদয়। হৃৎপিণ্ড দেখানো যায়, হৃদয় দেখানো যায় না। বললেই বলবে, আঙ্কল জ্ঞান দিচ্ছে, পালিয়ে আয়। পড়া ধরবে। মোবাইলের আর কী-ই বা দাম! লোকে আগে বাদাম কিনত। এখন অ্যান্ড্রয়েড কেনে। কিন্তু ভালবাসা হল সেই হিরে, যাকে লুকিয়ে রাখলে ‘পরাণ্মুখ সবুজ নালি ঘাস, দুয়ার চেপে ধরে।’

গত বারের ভ্যালেন্টাইনে আমার এক একুশ বছরের ছাত্র একটি দামি মোবাইল পেল। আমাকে বাড়িতে এসে দেখিয়ে গেল। খুব খুশি। দু’মাস বাদে মেয়েটির সঙ্গে তার বেধে গেল। সে আমাকে মাথা নীচু করে বলল মোবাইলটা তাকে ফেরত দিয়ে দিতে হবে। তার চোখ দু’টো ছলছল করছিল। আমি পিঠে হাত দিয়ে বললাম, কত মোবাইল আসবে জীবনে, ফেরত দিয়ে এসো। সে রেগে উঠে বলল, এই মোবাইলটা আমি ফেরত দেব না। আমি এটাকে ভালবেসে ফেলেছি। যে আমাকে মোবাইলটা দিয়েছে, সে যায় যাক, আমি মোবাইলটা ফেরত দেব না।

দুশো বছর আগের গল্প, প্যারিসের। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল ছেলেটিকে, তুমি আমার জন্য কী করতে পারো? ছেলেটি বলল, সব পারি। তোমার জন্য সব পারি। আজ ভ্যালেন্টাইন ডে, বলো কী করতে হবে? মেয়েটি ভ্রু তুলে বলল, সব পারো আমার জন্য, যে কোনও কাজ করতে পারো? মেয়েটি এর পর বলল, তুমি তোমার মাকে খুন করে বুক থেকে হৃৎপিণ্ড তুলে এনে দিতে পারবে? ছেলেটি বলল, হ্যাঁ।

মাকে খুন করে হাতে গরম হৃৎপিণ্ড নিয়ে দৌড়তে লাগল ছেলেটি। হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায়। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল মায়ের হৃৎপিণ্ড। ছেলেটি উঠে ধুলো ঝেড়ে, ঝুঁকে হৃৎপিণ্ড তুলতে যাবে যেই, হৃৎপিণ্ড বলে উঠল, খোকা, তোর ভাঙা হাঁটুতে লাগেনি তো?

গল্পটা প্যারিসের নয়, টালিগঞ্জের, শ্যামবাজারের। দুশো বছর আগের নয়, কাল লেখা হয়েছে।

যারা কষ্ট পেতে জানে না, তারা আদিখ্যেতা করে বেশি। যারা ভালবাসতে জানে না, তারাই সবচেয়ে বেশি ভ্যালেন্টাইনের কার্ড কেনে। ভ্যালেন্টাইন ডে আসলে একটা নিও-কলোনিয়াল প্রজেক্টের অংশ। ব্যবসা ছাড়া এর ভেতর আছেটা কী? সরস্বতী পুজোর সকালটাকে ভুলিয়ে দেওয়ার ব্লু-প্রিন্ট আমরাই তৈরি করে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিলাম। সরস্বতীকে বিক্রি করে জিনস পরা নয়া রামমোহন-বিদ্যাসাগরের হাতে এখন বীণা, থুড়ি, বীণা নয়, গিটার। এবং রাজহাঁস। কিন্তু হাঁসের পেটে আর সোনার ডিম নেই।

কিন্তু সবাই ভ্যালেন্টাইন দেখিয়ে বেড়ায় না। অন্য রকম দেখানোর গল্পও আছে। যেমন এই ছেলেটি স্মার্ট, ঝকঝকে। ফুকো, দেরিদা পড়া ছেলে। সে তার সহপাঠী মুসলমান মেয়েটির প্রেমে পড়ল। সবাইকে বলতে লাগল, আমাকে বলল, বাবাকে বলল, মা-কে বলল। পাড়ায় বলল। যেন একটা সেলিব্রেশন। কবিটাতা আমি তার মুখ থেকে টুকে বসিয়ে দিয়েছি।

বাড়িতে বলেছি, বলি রাস্তাকে

গলা ছেড়ে করি গান

মেয়েটি মুসলমান

বলেছি পাড়ায়,কলেজে কলেজে

নিমেষে ওঠে তুফান

মেয়েটি মুসলমান

বাবা-মাকে বলি, বলি আকাশকে

গলা খুলে করি গান

রুকসানা রহমান

প্রতিদিন সকালে বিকেলে এমনকী গভীর নিশীথেও গলিতে গলিতে সারা ভারত জুড়ে প্রেমের উৎযাপন অমর হয়ে চলেছে। কাজল-শাহরুখ তার আইকন। কত যে উনিশ বছরের কাজল কত যে একুশ বছরের শাহরুখ কাকদ্বীপ থেকে কুচবিহারের পথে পথে, নদীর ঘাটে, গাছতলায়, দরগায়, মন্দিরে, চার্চের পেছনে ভ্যালেন্টাইন ডে ছাড়াই প্রেম করে চলেছে— কে তার খবর রাখে! কেন যে ভ্যালেন্টাইন ডে-তেই প্রেম করতে হবে আমি জানি না। রবীন্দ্রনাথ এত প্রেমের গান লিখেছেন, বাঙালিকে প্রেমের ভাষা দিয়েছেন, তিনি কি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে ১৪ ফেব্রুয়ারি কিছু করেছিলেন? বুদ্ধদেব বসু কি প্রতিভা বসুকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন? পাবলো নেরুদা বিশেষ কোনও দিন ছাড়াই তাঁর প্রেমিকাকে বলেছিলেন, ‘‘ডু টু মি অ্যাজ ডাজ দ্য স্প্রিং টু আ স্ট্রবেরি।’’ এ লাইন কানে গেলে কবর থেকে উঠে আসবে যে-কোনও প্রেমিক। তার জন্য ভ্যালেন্টাইন ডে লাগবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE