Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বাটার চিকেন নো… ফল ইয়েস

পরিশ্রম থেকে নিষ্ঠা, সাফল্যের অন্য নাম বিরাট

ডিনার ৭.৩০। ঘুম ৯। নতুন বিরাট কোহালি-র সাফল্যের পাসওয়ার্ড। লিখছেন বন্ধু নীতি কুমার ২০০৬-এর ডিসেম্বর। ইন্ডিয়া সবে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ওয়ান ডে সিরিজ হেরেছে। তা-ও আবার ৪-০। একে তো এমন হোয়াইটওয়াশ। তার উপর টেস্ট সিরিজের জন্য আবার নেওয়া হয়েছে ‘ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি’কেই। দু’য়ে মিলে মেজাজ আরও খাপ্পা কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের। সৌরভের বদলে ওঁর মিডল অর্ডারে পছন্দ গৌতম গম্ভীর।

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

২০০৬-এর ডিসেম্বর।

ইন্ডিয়া সবে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ওয়ান ডে সিরিজ হেরেছে। তা-ও আবার ৪-০।

একে তো এমন হোয়াইটওয়াশ। তার উপর টেস্ট সিরিজের জন্য আবার নেওয়া হয়েছে ‘ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি’কেই। দু’য়ে মিলে মেজাজ আরও খাপ্পা কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের। সৌরভের বদলে ওঁর মিডল অর্ডারে পছন্দ গৌতম গম্ভীর।

গম্ভীরের যদিও অপেক্ষা করতে কোনও অসুবিধা ছিল না। বরং ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাটাই ওঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি গম্ভীরের মনে এটাও ছিল যে, ওয়ান ডে সিরিজে অমন রান আর ট্যুর ম্যাচে ৮০ করা সৌরভের এটা পাওয়াই স্বাভাবিক।

গম্ভীরের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে সময় লাগেনি। জোহানেসবার্গের প্রথম টেস্ট ম্যাচে ‘দাদা’ স্বমহিমায় টিমে। গম্ভীরকে বসতে হল রিজার্ভ বেঞ্চে। ১৭ ডিসেম্বর, ম্যাচের তৃতীয় দিনে দিল্লির বাঁ-হাতির নজর অবশ্য ক্রিকইনফো.কম-এ। রঞ্জিতে দিল্লি-কর্নাটক ম্যাচের লাইভ কমেন্ট্রি শোনার জন্য। আর সে খবরের জন্য কারওকে ছাড়ছিলেন না গম্ভীর... টিম ম্যানেজার থেকে বিসিসিআই অফিসে ফোন কল, এমনকী মিডিয়া পার্সন — চোখের সামনে যাঁকে পাচ্ছেন, তাঁর কাছেই গম্ভীরের প্রশ্ন রঞ্জি ম্যাচ নিয়ে।

পরের দিন, ১৮ ডিসেম্বর। কর্নাটকের ৪৪৬ তাড়া করতে দিল্লি তখন খোঁড়াচ্ছে। ৫ উইকেটে ১০৩। আঠারো বছরের বিরাট কোহালি তখন ক্রিজে। ৪০ নট আউট। ও দিকে আবার ইন্ডিয়া-দক্ষিণ অফ্রিকার ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছে চার দিনে। ১২৩ রানে জিতেছে ভারত। টিমের সঙ্গে জয়ের খুশিতে মাততে হয়েছে গম্ভীরকেও। কোহালির সামনে পাহাড় প্রমাণ চাপ থাকলেও, ইন্ডিয়া অ্যাওয়ে টেস্ট ম্যাচ জিতেছে।

১৯ ডিসেম্বর। মঙ্গলবার। একদিনের ছুটি পেয়েছে টিম ইন্ডিয়া। জোহানেসবার্গের হোটেল স্যান্ডটন সানে উঠেছে টিম। হোটেলের লাগোয়া এক বিরাট শপিং মল। প্রায় সব প্লেয়ারই তখন ব্যস্ত শপিংয়ে। কিন্তু গম্ভীর ছুটলেন হোটেলের বিজনেস সেন্টারে। ইন্টারনেটে দিল্লি-কর্নাটক ম্যাচের খবর দেখতে। রঞ্জি ম্যাচের তৃতীয় দিনেই দিল্লি করে ফেলেছে ৩০৮, কোহালি তখনও ৯০ রান করে ক্রিজে। নিজের রাজ্য যে তখনও জমি ছাড়েনি, এতে খুশি গম্ভীর। কিন্তু গম্ভীরের জানার কথা নয়, কী পরিস্থিতিতে জমি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন বিরাট। আঠারো বছরের ছেলেটা সে দিনই বাবাকে হারিয়েছে। তবু সেই অবস্থাতেই ব্যাট করতে এসেছে টিমের জন্য।

দিল্লির এক সাংবাদিক গম্ভীরকে এই কথাটা জানিয়েছিলেন। প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলেন দিল্লির টিমমেটদের। ওঁরাও একই কথা বলাতে বিশ্বাস করলেন ঘটনাটা। পরের ফোনটা গম্ভীর করেছিলেন কোহালিকে। স্বাভাবিকভাবে বেশি কথা বলার লোক নন গম্ভীর। তবে এ বারে তার ব্যতিক্রম হয়েছিল। প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন কোহালিকে। যদিও কোনও প্রশংসাই তাঁর কাজের জন্য যথেষ্ট হতে পারে না। তবে গম্ভীরের ফোন পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন কোহালি। আসলে, ক্রিকেটীয় বিশ্বে একজন প্লেয়ার অন্যজনের প্রশংসা করছেন — এমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না।

বুদ্ধিদীপ্ত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক ক্রিকেটারের বেড়ে ওঠার সেটাই শুরু। বাইরের পৃথিবীর কাছে, কোহালি মানেই এক জেট-সেট তরুণ, যে সামান্য কোনও ইন্ধনেই হয়তো জামার হাতা গুটিয়ে নেমে পড়বে গন্ডগোলে। রাস্তায় মারপিট করা ছেলেদের মতো বিরাটের আগ্রাসী মেজাজ যত লোকের খারাপ লাগত, ঠিক তত লোকের কিন্তু পছন্দও হত।

তাতে কোহালির কী! কোহালির কাছে এই আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশ দক্ষিণ দিল্লিতে বেড়ে তাঁর বেড়ে ওঠা সূত্রেই। রাজধানীর এই জায়গাটা আসলে ১৯৪৭-এ পার্টিশনের ফলে ভারতে আসা রিফিউজিতে ভরা। পশ্চিম বিহার, পঞ্জাব বাগ... এই সব অঞ্চলের বাসিন্দারা হল প্রধানত পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু। শূন্য থেকে শুরু করা জনগণ। কোহালির আগের প্রজন্মও তার ব্যতিক্রম নয়। কেউ এক ইঞ্চি জমিও চাননি, কেউ তাঁদের এক ইঞ্চি জমি ছেড়েও দেয়নি। সব কিছুই পেতে হয়েছে লড়াই করে। আর শুধু তো জীবনধারণ নয়। কী করে নিজেকে আরও বড় করে তোলা যায় তার অবিরাম প্রচেষ্টা। এই প্রবণতাটা কোহালির মজ্জাগত। যদিও সবার থেকে আলাদা ক্রিকেটার কী করে হওয়া যায়, তার মন্ত্র কোহালির জানা ছিল না।

যুবরাজ সিংহ আর বিরাট— দু’জনই দু’জনকে পছন্দ করতেন। দু’জনই পছন্দ করতেন ক্রিকেটের বাইরের জীবন, বিদেশি গাড়ি, চকচকে জামাকাপড়, দামি ঘড়ি, আর অবশ্যই পঞ্জাবি খাবার আর গান। যদিও তখনও যুবরাজের ক্যানসার ধরা পড়েনি। কোহালি তাঁর সর্বদা সহচর। তাঁকে টিপসও দিতেন। একবার মজা করে কোহালিকে বলেছিলেন, ‘‘চিকু, আমি যে ভুলগুলো করেছি, তুই সেগুলো করিস না। মনে রাখবি, ব্যাটে যতক্ষণ রান আছে, ততক্ষণ সব ঠিক। ব্যাটে রান না থাকলে দেখবি বন্ধুও কেমন শত্রু হয়ে যায়। আর টেস্ট ক্রিকেটে নজর দে। অন্য সব ফালতু।’’

তবে এ কথাটা যুবরাজ একাই বলেননি কোহালিকে। সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ আর হরভজন সিংহও একই উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁকে। কোহালি কথাটা এ কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেননি। মনে রেখেছিলেন। আর বুঝে গিয়েছিলেন সারসত্যটা । বিশ্ব ক্রিকেটে আধিপত্য জমাতে হলে ফিটনেসেও সেরা ফর্মে থাকতে হবে। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল বিরাটের রূপান্তর। দিল্লির গোলগাল ছেলে থেকে মেদহীন খোদাই-করা গ্রিক ভাস্কর্যের মতো চেহারার তরুণে।

২০১১য় এক বিশ্বজোড়া বিজ্ঞাপনে নাইকি চাইছিল বিরাটের জামাখোলা ছবি। দিল্লির ছেলের কাছে এটা একটা মোটিভেশন। বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংয়ে নিজের সে ছবি দেখে উত্তেজিত বিরাট। বন্ধুদের কাছে সে উত্তেজনা চাপতেও পারেননি। ম্যাচের মধ্যেও জায়ান্ট স্ক্রিনে সেই বিজ্ঞাপন দেখে উত্তেজনায় ফুটতেন বিরাট। টিম মেটরা তো আয়নার সামনে বিরাটের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো নিয়ে ঠাট্টাও শুরু করে ছিলেন। অনেকে তো মজা করে বলতেন, আয়না কেন, বিরাট তো নিজের ছায়ার দিকেও মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকে।

নাইকির বিজ্ঞাপনের সেই ছবি সামান্য হলেও বিরাটের জীবনে একটা বড় মাইলস্টোন। শরীরচর্চায় আরও বেশি করে সময় দেওয়ার পোকাটা তখন থেকেই মাথায় চড়ে বসেছিল বিরাটের। ভাল চেহারার প্রতি লোভটাও কিন্তু দিল্লির ছেলেদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। ক্রিকেটে অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরচর্চার ব্যাপারেও অনেক বন্ধ দরজা খুলে যাচ্ছিল বিরাটের। ২০১১-১২র অস্ট্রেলিয়া সফরে বিচ্ছিরিভাবে হেরেছিল ইন্ডিয়া। কিন্তু বিরাটের নজরে এল, অস্ট্রেলিয়দের ট্রেনিংয়ের পদ্ধতি ভারতীয়দের থেকে আলাদা। অস্ট্রেলিয়ার ট্রেনিংয়ে ইনটেনসিটিটা অনেক বেশি। ডায়েটও সম্পূর্ণ আলাদা। আর সব থেকে বড় কথা হল, ক্রিকেটের প্রতি অস্ট্রেলিয়দের দৃষ্টিভঙ্গি।

২০১২-র আইপিএল-এর পর কোহালি নিজের ফিটনেসের দিকে নতুন করে নজর দিলেন। বাটার চিকেন, নান, ডাল, রাজমা-চাওল, মাখন, তেল — পছন্দের সব খাবার ছেঁটে ফেললেন নিজের ডায়েট থেকে। আর খাবারের তালিকায় এল মাল্টিগ্রেন রুটি, ভাপা মাছ, তন্দুরির নানা পদ, ওটস আর ফল। মিষ্টির কোনও জায়গাই থাকল না ডায়েটে। কর্নফ্লেক্সের সঙ্গে শুধু স্কিমড মিল্ক। এই ডায়েট চার্ট তো পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চললেনই। সঙ্গে ঠিক করে নিলেন খাবারের সময়। সন্ধে সাড়ে সাতটার পর আর কিছু খান না বিরাট। কথাটা বিশ্বাস করা শক্ত হলেও, সত্যিই ভারতীয় ক্রিকেটের পোস্টারবয় ঘুমিয়ে পড়তেন রাত ন’টার মধ্যে। প্রথম প্রথম শরীর এই পরিবর্তন মানতে পারেনি। অনেক সময় শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করেছেন বিরাট। কিন্তু তাতে থেমে যাওয়ার লোক নন তিনি।

ওঁর বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ফিটনেসের ব্যাপারে বিরাটের এই মাতামাতির পিছনে নাকি অনুষ্কা শর্মারও অনেকটা অবদান। ফিটনেস ফ্রিক অনুষ্কা উদ্বুদ্ধ করতেন বিরাটকে। বুঝিয়েছিলেন সুন্দর শরীরের গুরুত্ব। কানাঘুষোয় শোনা যায়, দু’জন নাকি জিমে যেতেন একসঙ্গে। আর ট্রেনিং করতেন একদম পোড়খাওয়া পেশাদারদের মতো।

কোহালি জোর দিতেন শরীরের নীচের অংশের দিকে। বিশেষ করে পায়ের মাসেলে। ওঁর মতে ভাল অ্যাথলিট বডির মূলে হল শরীরের সুগঠিত নীচের অংশ।

ম্যাচট্যাচ না থাকলেও দিনে চারবার দু’ঘণ্টা করে জিমে যান বিরাট। মনকে শান্ত রাখতে রোজ যোগব্যায়াম।

তবু ভিতরে ভিতরে দিল্লির ছেলের স্বভাবসিদ্ধ ছটফটে ভাব এখনও অটুট তাঁর মধ্যে। এখনও হয়তো জামা খুলে নিজের সুঠাম দেহ আয়নায় দেখতে ভালবাসেন। ওঁর বন্ধুরা বলেন, ফোর প্যাকস অ্যাব এখনই বানিয়ে নিয়েছেন বিরাট। কিন্তু বিরাট বলে কথা। ফোর প্যাকে থেমে থাকার বান্দা নন তিনি। তাঁর মন্ত্র হল, জীবন চাইছে আরও বেশি।

টেস্ট অধিনায়ক হয়ে হয়তো বিজ্ঞাপনে আর জামা খুলে দাঁড়াবেন না, তবে সিক্স প্যাকসের মোহ মনে হয় ছাড়তে পারেননি।

আর অবশ্যই মেটেনি আরও বেশি রান, আর আরও বেশি ট্রফির খিদে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE