Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিজ্ঞাপনে নারী নারীর বিজ্ঞাপন

সৌজন্যে ‘কজ ক্যাম্পেন’। শুধু মেয়েদের জন্যই। লিখছেন মধুমন্তী পৈত চৌধুরীএমন একটা পৃথিবীও আছে। যেখানে মাঝরাতে জনা পাঁচেক অচেনা ছেলের গাড়িতে লিফ্‌ট নিয়েও একটি মেয়ে সুস্থ শরীরে বাড়িতে ফেরে। যেখানে পাত্রী দেখতে এসে শুধু পাত্রীই না, পাত্রও রান্না করে কি না তা যাচাই করা হয়। যেখানে প্রেগনেন্সির কারণে অফিসে প্রোমোশন না হলে হাইপ্রোফাইল চাকরি ছেড়ে নিজের স্টার্টআপ করতে ভয় পায় না একটি মেয়ে।

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

এমন একটা পৃথিবীও আছে। যেখানে মাঝরাতে জনা পাঁচেক অচেনা ছেলের গাড়িতে লিফ্‌ট নিয়েও একটি মেয়ে সুস্থ শরীরে বাড়িতে ফেরে। যেখানে পাত্রী দেখতে এসে শুধু পাত্রীই না, পাত্রও রান্না করে কি না তা যাচাই করা হয়। যেখানে প্রেগনেন্সির কারণে অফিসে প্রোমোশন না হলে হাইপ্রোফাইল চাকরি ছেড়ে নিজের স্টার্টআপ করতে ভয় পায় না একটি মেয়ে।

প্রশ্ন ওঠে, কত দূরের এই পৃথিবী? এমনটা তো শুধু সিনেমাতেই দেখা যায়।

আর এখন বিজ্ঞাপনেও।

বাস্তবের তেলচিটে মরচে পড়া জমিতে দাঁড়িয়ে এমন নতুন রঙের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভারতের নামী-দামি ব্র্যান্ডগুলি। টার্গেট দর্শক শহুরে শিক্ষিতা চাকুরীরতা জেন-ওয়াই মহিলা মহল। বলিউড ছবিতে যেমন নতুন নারী ও তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা টানছে দর্শকের ভিড়, বিজ্ঞাপন জগতেও আজকের নারীর সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা ভাবাচ্ছে চিন্তাশীল ও প্রগতিশীল সমাজের একাংশকে। হয়তো সেই ভাবনা একটা লাইক আর পাঁচটা কমেন্টেই সীমাবদ্ধ। তবুও ভাবাচ্ছে।

সমকামিতা থেকে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, সম্বন্ধের বিয়ে থেকে পুনর্বিবাহ, সিঙ্গল মাদার থেকে বিয়ের জন্য চাকরির সঙ্গে আপস না করা, মাঝরাতে একা বাড়ি ফেরা থেকে ‘মাই বডি মাই চয়েসের’ ফরমান জারি— মেয়েদের এমন স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়েই বিজ্ঞাপনের দুনিয়াতে আলোড়ন তুলেছে কমার্শিয়াল ব্র্যান্ড। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলি এই তালিকায় শীর্ষে থাকলেও পিছিয়ে নেই ঘড়ি, প্রসাধনী দ্রব্য ও গয়নার ব্র্যান্ডও। বিজ্ঞাপনের পরিভাষায় যাকে বলে, ‘কজ ক্যাম্পেন।.প্রগতিশীল নারী ও তাঁদের অধিকার-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা-দাবি জায়গা করে নিয়েছে এই বিজ্ঞাপনগুলিতে। উঠে আসছে লিঙ্গ-সমতার কথাও।

আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হলেও ভারতে কজ ক্যাম্পেনের চল কিন্তু আগেও ছিল। ‘‘তবে এখনকার বিজ্ঞাপনে বার্তা অনেক বেশি সরাসরি ও প্রত্যক্ষ,’’ বলছিলেন বিজ্ঞাপন কর্মী আন্তন মুখোপাধ্যায়।

তবে এই বিজ্ঞাপনগুলির সঙ্গে সরকারি বি়জ্ঞাপনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ফারাক আছে। মেয়েদের স্বাস্থ্য-সচেতনতা, বাধ্যতামূলক ভাবে স্কুলে পাঠানো, ছেলে-মেয়ে সন্তানের মধ্যে বৈষম্য না করা— মূলত ভারতের সাংবিধানিক অধিকারের কথা বলে সরকারি এই বি়জ্ঞাপনগুলি। টার্গেট, গ্রামীণ মহিলাদের এই বিষয়ে জানানো ও সার্বিক সচেতনতা গড়ে তোলা। আর এখানে সমস্যা সমষ্টিগত। অন্য দিকে শহরের সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার আড়ালে বা কর্মক্ষেত্রে বা বার-এ মহিলাদের যে পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়, কমার্শিয়াল ব্র্যান্ড কিন্তু বলছে তার কথা। অর্থাত্ সমস্যা এখানে ‘চয়েস মেকিংয়ের’। তাই অনেকটাই ব্যক্তিগত। যার জন্য বি়জ্ঞাপনগুলির ট্যাগ লাইনে বারবার বলা হয় ‘মাই লাইফ মাই চয়েস’, ‘মাই লাইফ মাই রুল’। তবে ব্যক্তি আর সমাজ তো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ব্যক্তি চেষ্টা করে, আর তার হাত ধরেই সমাজ এগিয়ে আসে।

বিজ্ঞাপনে মেয়েদের এই সমস্যাকে তুলে ধরার পিছনে মেয়েদেরই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিতে রাজি সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন,‘‘মেয়েদের সূচ্যগ্র মেদিনী কেউ ছেড়ে দেয়নি। তারা নিজেদের জোরেই অর্জন করেছে এই জায়গা। আজকের কসমোপলিটান সমাজে এই সমস্যাগুলি নিয়ে মেয়েরা কথা বলছে। আবহ তৈরি হয়ে আছে। এই বিজ্ঞাপনগুলি তার স্বীকৃতি মাত্র।’’

তবে কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা অনেকটা এগিয়ে এলেও, সামাজিক স্বীকৃতি ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে শহুরে মেয়েরাও কিন্তু অনেকটাই পিছিয়ে। তাই বোধ হয় সমকামিতার মতো ভারতে আইনত নিষিদ্ধ বিষয়ও হয়ে উঠছে বিজ্ঞাপনের প্রতিপাদ্য।

মেয়েদের সমস্যা কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যে একই রকম ভাবে প্রভাব বিস্তার করে না। ‘‘বিভিন্ন বয়ঃক্রমের মহিলাদের মধ্যে এই বিজ্ঞাপনগুলি গ্রহণ ও বর্জনের ব্যাপ্তি কিন্তু অনেকটাই আলাদা,’’ বললেন লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার।

আসলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে ভাবে নারী ও পুরুষের সামাজিকীকরণ হয়ে আসছে, সেই ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে নারী-পুরুষ দু’জনকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাই একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে যখন পাত্রী দেখতে এসে পাত্রীর বাবা পাত্রের যোগ্যতারও প্রশ্ন তোলেন, সে পরিবর্তন কিন্তু সুন্দর।

বাণিজ্যের হাত ধরেই যে ভাবে বার বার মেয়েদের সমস্যা বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হচ্ছে একবাক্যে তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছে সকলেই। কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরত দীনা রায়ের মতে, ‘‘এটা একটা ভাল ট্রেন্ড।’’ বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত অরিজিত্ নন্দীর মতে ‘‘সংখ্যাটা কম হলেও পরিবর্তন তো আসছে। বিজ্ঞাপন ভাল কাজ করছে।’’

বিজ্ঞাপনের পণ্য হিসেবে শুধু নারী শরীর হয়ে নয়, সামাজিক বার্তা দিতে বলিউডের এ প্রজন্মের জনপ্রিয় অভিনেত্রীরা যে ভাবে এগিয়ে আসছে তাও কিন্তু প্রশংসনীয়। আলিয়া থেকে দীপিকা, নিমরত থেকে রাধিকা— প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছে আজকের নারীর মুখ।

সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনও বলছে ঘরে-বাইরে নারীর নতুন ভাবে নিজেকে মেলে ধরার কথা। জাগাচ্ছে আশা। সেটাও বা কম কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE