Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

বার্লিন পাঁচিলের দু’পারের ইতিহাস

পশ্চিমমুখী একটা কংক্রিটের দেওয়াল। এক পিঠ তার ভীষণ রঙিন। আর উল্টো পিঠ কংক্রিটরঙা, ধূসর। দেওয়াল ফেলে, সদর পেরিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। পাশের একটা ঘরে কয়েকটা মনিটরে জার্মান ভাষায় চলছে এক জনের জবানবন্দি। তিনি পূর্ব জার্মানির দিকে বার্লিন-পাঁচিলের পাহারাদারের দায়িত্বে ছিলেন। আশেপাশে রয়েছে নানা মাপের স্টিলের আলমারি। কাচের ঠেলা পাল্লায় তার তাকগুলো ঢাকা। অনেকটা এ দেশে বাড়িতে বই রাখার আলমারির মতো। সে সব আলমারির কয়েকটা সে কালে বাজেয়াপ্ত করা পাসপোর্টে ভর্তি। কয়েকটায় রয়েছে নজরদারির নানা সরঞ্জাম। তা ছাড়া চেকপোস্ট চার্লির নানা অবশেষ।

পিঙ্ক লেনিন

পিঙ্ক লেনিন

সংহিতা মুখোপাধ্যায় ও পার্থপ্রতিম দাস
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

পশ্চিমমুখী একটা কংক্রিটের দেওয়াল। এক পিঠ তার ভীষণ রঙিন। আর উল্টো পিঠ কংক্রিটরঙা, ধূসর। দেওয়াল ফেলে, সদর পেরিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। পাশের একটা ঘরে কয়েকটা মনিটরে জার্মান ভাষায় চলছে এক জনের জবানবন্দি। তিনি পূর্ব জার্মানির দিকে বার্লিন-পাঁচিলের পাহারাদারের দায়িত্বে ছিলেন। আশেপাশে রয়েছে নানা মাপের স্টিলের আলমারি। কাচের ঠেলা পাল্লায় তার তাকগুলো ঢাকা। অনেকটা এ দেশে বাড়িতে বই রাখার আলমারির মতো। সে সব আলমারির কয়েকটা সে কালে বাজেয়াপ্ত করা পাসপোর্টে ভর্তি। কয়েকটায় রয়েছে নজরদারির নানা সরঞ্জাম। তা ছাড়া চেকপোস্ট চার্লির নানা অবশেষ।

আমরা দাঁড়িয়ে ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে। লস এঞ্জেলসের শহরতলি কালভার সিটি। সেখানে আমাদের ঘর থেকে হাঁটা দূরত্বে এই মিউজিয়াম। জার্মান ভাষায় ওয়েন্ডে মানে মোড়। এখানে রয়েছে ১৯৬১-তে বার্লিন দেওয়াল গাঁথা থেকে শুরু করে ১৯৯০-এ তা ভাঙা পর্যন্ত সোভিয়েত ব্লকের ইতিহাস। মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট আছে। সেখানে লেখা ছিল প্রত্যেক শুক্রবার দুপুর তিনটে থেকে একটা গাইডেড ট্যুর হয়। আবেদন জানানোর জন্য একটা ই-মেল আইডি-ও ছিল। মেল করতেই সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল, কোনও প্রবেশমূল্য ছাড়াই।

মিউজিয়ামের দোতলায় উঠে যে হলটায় দাঁড়ালাম, সেখানে অনেকগুলো ডেস্ক-চেয়ারের সঙ্গে রয়েছে বক্তৃতার বা মিছিলে হাঁটার ভঙ্গিমায় প্রায় পাঁচ ফুটের একটা লেনিনের কাঠের মূর্তি। দেওয়ালে টাঙানো কয়েকটা বড় বড় ছবি। এই হলের ওপরেই মিউজিয়াম ডিরেক্টর ও অন্য আধিকারিকদের দফতর। মিউজিয়াম দেখতে এই হলেই জড়ো হতে হয়। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-র লস এঞ্জেলস ক্যাম্পাসের ছাত্রেরা। গরমের ছুটিতে ছাত্র ও গবেষকরা এখানে বেতনভুক ইনটার্ন হিসেবে কাজ করেন। আমাদের ট্যুর গাইড ছিলেন তেমনই এক ইনটার্ন, নাম আলিনা সেরেব্র্যানি। মিউজিয়ামের ফেসবুক পাতা থেকে জেনেছিলাম আলিনার পূর্বপুরুষও জড়িয়ে ছিলেন বার্লিন পাঁচিলের ইতিহাসে।

মিউজিয়ামের সংগ্রহগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে আলিনা জানিয়েছিলেন, বার্লিন পাঁচিল ভেঙে পড়ামাত্র সাবেক পূর্ব জার্মানি জুড়ে দুদ্দাড় করে ভেঙে পড়ছিল পুরনো ব্যবস্থায় বানানো সব আসবাবপত্র, ভাস্কর্য কিংবা রাষ্ট্রীয় স্মারক। আস্তাকুড়ে জমা হচ্ছিল নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ইতিহাসের সেই মোড়ে, প্রায় লোপ পেতে বসেছিল পূর্ব ইউরোপের অবরুদ্ধ তিন দশকের ইতিহাস। আধুনিক ইতিহাসের স্বার্থে ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার জাস্টিনিয়ান জামপল সেই অধ্যায়কে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে রাখার চেষ্টা করছেন। তাঁর নিজের শহর কিন্তু লস এঞ্জেলস। যে হেতু বার্লিন পাঁচিল ভেঙে পড়ার সময় পূর্ব জার্মানির মানুষের আবেগ পুরনো সব কিছুকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল সে কারণেই ওই মিউজিয়াম পূর্ব জার্মানির কোথাও বানাতে ভরসা পাননি জামপল। যে সমস্ত দিনলিপি, নথি এবং অবশেষ এই মিউজিয়ামে আছে তা থেকেও এ কথা বোঝা যায়। ধ্বংসাবশেষ কুড়োতে কুড়োতে এক দশকে ইতিহাসবিদ জামপলের সংগ্রহ যা দাঁড়িয়েছিল তা সংরক্ষণের জন্য গ্যারাজ কিংবা বৈঠকখানা নেহাতই অপ্রতুল ছিল। তা ছাড়াও ইতিহাসের সেই মূহূর্তকে তো তিনি আশ্রয় দিয়ে চলেছেন ভাবি কালের জন্যও! তাই সমস্ত সংগ্রহ যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছাত্র, গবেষক এবং উৎসাহী ও মনোযোগী সাধারণ পর্যবেক্ষকের নাগালে পৌঁছয় তাই তিনি বানিয়েছেন এই মিউজিয়াম।

হল পেরিয়ে যে করিডরে গেলাম, সেখানে লেনিনের একটা আবক্ষ মূর্তি রাখা ছিল। কিন্তু, সেটার মাথা থেকে ৯০ শতাংশ গোলাপি রঙে ঢাকা। এটি পিঙ্ক লেনিন। পাঁচিল ভেঙে পড়ার পর জনতার আক্রোশে মূর্তিটার রং বদলে গিয়েছে! করিডর পেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এসে দেখতে পেলাম, একতলার সংগ্রহশালা, মোটেও মিউজিয়ামের মতো নয়, অনেকটা ওয়্যার হাউসের মতো। স্টিলের নাটবল্টু আঁটা, তাতে আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি দড়ির পেছনে সারি সারি কার্ল মাক্স, স্তালিন, লেনিন, ক্রুশ্চেভের ভাঙা কিংবা গোটা আবক্ষ মূর্তি। আসলে সেগুলো যাতে তাক থেকে পড়ে না যায় তাই আড়াল দেওয়া হয়েছে অমন করে। এই তাকগুলো উচ্চতায় ঘরের ছাদ অবধি আর চওড়ায় দেওয়াল পর্যন্ত বাড়ানো যায় এমন।

মিউজিয়ামের প্রথম একজিবিট মিত্র শক্তির চেক পয়েন্ট চার্লির নাম লেখা সাইন বোর্ড। তার পর ছিল কিছু অবাক করা চেয়ার। সাদা রঙের প্লাস্টিকে বানানো ডিমাকৃতি গার্ডেন চেয়ারটার গদি নীল ভেলভেট দিয়ে মোড়ানো— অপরূপ দেখাচ্ছে। বেশ কিছু গদিআঁটা চেয়ারের মাথাটা খুলে দিলেই সেটা একটা সিঁড়ি হয়ে যায়। বার্লিন পাঁচিলের ভিতরে লোহার যোগানের অভাব হয়তো প্লাস্টিকের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর নতুন নতুন উদ্ভাবনীর পথে চালিত করেছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উৎপাদকদের। তাই অপূর্ব ডিম-চেয়ার তৈরি হয়েছিল। চাকা লাগানো অটোমান, মানে গদি আঁটা যে চেয়ারে হেলান দেওয়ার অংশটি থাকে না, তার কাঠের খোল দিব্যি ব্যবহার করা হত জিনিসপত্র রাখার জায়গা হিসেবে। আসবাবের ধরন থেকে মনে হয় যে, অকুলান বাসস্থানে সংকুলানের জন্য আসবাব হত ভাঁজ করে ছোট করে ফেলা যায় এমন কিংবা একই আসবাবকে অনেক রকম কাজে ব্যবহার করা যাবে এমন কিছু। তাই আলিনার মতে, শুধু চেয়ারের জন্য নয়, যে কোনও শিল্পজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রেই অবশ্যম্ভাবী ছিল এই উদ্ভাবনী। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ডিডিআর বা জিডিআর-এ বানানো সাইলেন্ট স্টার ছায়াছবির কথা। সেই ছবির বিষয় সারা পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের সম্মিলিত শুক্র গ্রহ অভিযান। সেই দলের এক জন চিনা বৈজ্ঞানিক অজৈব পদার্থ থেকে খাবার সংশ্লেষের পদ্ধতি জানতেন! আরও মনে পড়ে পূর্ব জার্মানির উদ্ভাবনী শক্তির আর এক বিস্ময় দুই দরজার ত্রাবান্ত গাড়ি।

মিউজিয়ামে ইস্টার্ন ব্লকের নানান দেশ থেকে আনা ভাস্কর্যের সংগ্রহটা যদিও আদর্শবাদ জড়ানো, তবুও রকমারি। মুষ্টিবদ্ধ মুদ্রায় লাল সেলামরত শ্রমিক কিংবা কমিউনিজমের প্রবক্তা মার্কস, এঙ্গেলস এবং বিভিন্ন সোভিয়েত এবং ইস্টার্ন ব্লকের নেতাদের মূর্তির মাধ্যম ছিল প্লাস্টার অফ প্যারিস। বাচ্চাদের জন্য তৈরি কাঠের খেলনাতেও আধুনিক নেতৃত্ব অতিমানবিক মহিমায়। একটা বেশ রঙচঙে কাঠের মূর্তি দেখিয়ে আলিনা বলেছিলেন, সেই মূর্তিটা সম্ভবত লেনিনের এবং নেদারল্যান্ডসে খোদাই করা। কমিউনিস্ট নেতাদের ছাঁচে ঢালা সীসার মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। তবে সবথেকে নজরকাড়া মূর্তিটি এক অখ্যাত মহিলা শ্রমিকের। কাঠে বানানো প্রায় দেড় ফুট লম্বা সেই মূর্তির পেশীবহুল হাত, চওড়া কাঁধ-কপাল, পিছনে টেনে বাঁধা চুলে এক বলশালীনিকে দেখা যায়।

চমকপ্রদ একটা জিনিস দেখলাম, গানের দল ফুডিসের রেকর্ডের খাপের ছবি। ফুডিস ছিল পূর্ব জার্মানির প্রথম রকব্যান্ড, যারা জনসমক্ষে গানের অনুষ্ঠান করার সরকারি অনুমতি পেয়েছিল। শুধু তাই নয় সরকারি রেকর্ডিং সংস্থা আমিগা থেকে বেরতো তাদের লং প্লেয়িং রেকর্ড। সে সব রেকর্ডের খাপের নকশা হত দারুণ রঙিন। ওয়েন্ডে মিউজিয়ামে পূর্ব জার্মানির বইপত্রের বেশ বড় সংগ্রহ আছে। বইপত্র অবশ্য মূলত কমিউনিস্ট দর্শনের উপরেই লেখা। প্রধানত জার্মান ভাষায় লেখা সেই সব বইপত্র।

বই ছাড়াও এই মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে পূর্ব জার্মানির বেশ কিছু রেডিও সেট। রেডিও বেশ শক্তিশালী মাধ্যম ছিল মতাদর্শ প্রচারের। কিন্তু, এই যন্ত্রই নাকি তাঁদের অশান্তিরও কারণ ছিল। কারণ যন্ত্রটা সোভিয়েত ব্লকের জনসাধারণেরও বেশ পছন্দ ছিল। আবার সাধারণ ক্রেতার নাগালেও ছিল। ফলে, ক্রমাগত রেডিও তরঙ্গ বেয়ে ইস্টার্ন ব্লকের জনসাধারণের বৈঠকখানায় ঢুকে পড়ছিল বার্লিন দেওয়ালের পশ্চিম দিক থেকে প্রচারিত যাবতীয় রাজনৈতিক আলোচনা, জনমত, পুব দিকের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির সমালোচনা— সবই। যার মধ্যে ইস্টার্ন ব্লকের রাষ্ট্র নেতৃত্বের সব থেকে অপছন্দ ছিল রক সঙ্গীত। আর যুবজনতার প্রথম পছন্দের রেডিও স্টেশন ছিল রক সঙ্গীতের স্টেশন।

শ্যালমাই নামে একটা বাজনা পূর্ব জার্মানির স্কুল, কারখানা আর নগরে-গঞ্জে খুব জনপ্রিয় ছিল। এই বাজনা বাজানো বেশ সহজেই শেখা যায়। পূর্ব জার্মানির বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ভেব ট্যাকটনের পক্ষ থেকে বার্লিন দেওয়ালের হোতা ইরিশ হোনেকারকে তাঁর ৭৫তম জন্মদিনে যে শ্যালমাইটা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, সেটা এখন ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছে। পূর্ব জার্মানির সোশ্যালিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা তথা রাষ্ট্রনেতা ইরিশ হোনেকার তাঁর সেই শ্যালমাইটা দিয়েছিলেন পশ্চিম জার্মানির রকস্টার উডো লিন্ডেনবার্গকে। আশির দশকের শেষে পশ্চিম জার্মানিতে সেটার বদলে নিয়েছিলেন লিন্ডেনবার্গের চামড়ার জ্যাকেট।

ওয়েন্ডে মিউজিয়াম সাবেক পূর্ব জার্মানি আর ইস্টার্ন ব্লকের জীবনের নানা কোণ থেকে সংগ্রহ করেছে যাপনের অবশেষ। তার মধ্যে রয়েছে পোশাক, পর্দা, কার্পেটও। পূর্ব জার্মানির অসংখ্য কার্পেটের নকশায় দেখা যায় নিসর্গ, ফুলতোলা পাতাবাহার আর অবশ্যই বালক নেতার ছবি। সব থেকে বেশি পাওয়া যায় লেনিনের ছ’বছর বয়সের একটা ছবি। আমাদের পটচিত্র বা কাঁথায় বালক নিমাই বা বালক গদাধরের মতো। বালক লেনিনের সেই ছবিটা শুধু কার্পেটে নয়, কুশনের ঢাকায়, পর্দাতেও বোনা হত। ওয়েন্ডে মিউজিয়ামের এ সব বস্ত্র সংগ্রহের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে পুলিশ, নাবিক আর সেনার উর্দি। নাবিকের উর্দি ও স্কার্ফের রং হত ঘন নীল। এ রকম এক নাবিকের উর্দিতে স্কার্ফের ভিতরের অংশে আঁকা ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরপ্রান্ত ছোঁয়া কামচটকা উপদ্বীপের মানচিত্র।

এই সব সংগ্রহের মধ্যে সব থেকে চমকপ্রদ ছিল অ্যটাচি কেস। অনেকগুলো অ্যাটাচি খুলে খুলে আলিনা দেখিয়েছিলেন। এই অ্যাটাচিগুলো সবই পূর্ব জার্মানি থেকে সংগৃহীত। এগুলো স্টাসির মানে পূর্ব জার্মানির নিরাপত্তা মন্ত্রকের সম্পত্তি ছিল। এর ভিতরে সাধারণত একটা ডিকোডার থাকত। এই অ্যাটাচি কেসগুলো মূলত খবর দেওয়া-নেওয়ার কাজে লাগত।

মিউজিয়ামের সংগ্রহে থাকা পূর্ব জার্মানির সিনেমার মধ্যে জাপানি ও রাশিয়ান ভাষার বেশ কিছু ছবি আছে। জাপানি ছবির পোস্টারে তার নামের ইংরেজি তর্জমা ছিল। সেটা পড়ে মনে হল জাপানি ছবিটা সামাজিক ছবি। তবে রাশিয়ান ছবির পোস্টারে মহাকাশ যান আঁকা ছিল। মিউজিয়ামে হাতে আঁকা ছবির সংগ্রহও বিশাল। একটা ছবিতে দেখা যায় মেয়েরা যন্ত্রপাতি, ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে চাষের কাজে চলেছে। দূরে আকাশে দলা দলা মেঘ। সেই মেঘে নাকি পাঁচটা মহাদেশের রেখার আদল। ছবিটাতে দেখানো হয়েছে যে, সোভিয়েত ব্লকের ভূমিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মেয়েরাই ধরে রাখে এবং দূরের মেঘের দিকে মেয়েদের তুলে রাখা আঙুলে সেই ভূমিভিত্তিক সমাজতন্ত্রকে ইস্টার্ন ব্লকের বাইরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। অন্য কয়েকটা ছবিতে দেখা যায় পশ্চিমী দুনিয়ার কোর্টরুমে চলতে থাকা ডিভোর্সের মামলার শুনানির দৃশ্য, পশ্চিমী হোটেলে ফূর্তির আয়োজনে খোলামেলা পোশাকে নারীদের উপস্থিতি। একটা ছবি রাজনৈতিক সম্মেলনের। এই ছবিতে বক্তা ক্রুশ্চেভ। সমস্ত শ্রোতার ছবি অটুট রেখে নরুণ জাতীয় কিছু দিয়ে খুবলে তোলার চেষ্টা হয়েছে ক্রুশ্চেভের প্রতিকৃতি।

এখানকার যাবতীয় সংগ্রহের একটা বড় অংশ হল পূর্ব জার্মানির পাওয়া কূটনৈতিক উপহার। তার মধ্যে প্যালেস্তাইন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, কঙ্গো এবং অবশ্যই রাশিয়া থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপহারও আছে। প্যালেস্তাইনের উপহার মূলত পোর্সেলিন প্লেটে একরঙা সনাতন নকশা, ইয়েমেনের উপহার দাবার ঘুটি, কঙ্গোর উপহার আফ্রিকান রমণীর আবক্ষ মূর্তি, রাশিয়ার উপহার লেনিন মূর্তি। দুঃখজনক ভাবে এই মূর্তিটাতেও কালো রং লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কম্বোডিয়া থেকেও কাঠে খোদাই করা দাবার ঘুটির উপহারও ছিল।

আলিনার থেকে জানলাম, যত সিনেমা পাওয়া গিয়েছে পূর্ব জার্মানি থেকে সেগুলোর ইংরেজি তর্জমা ও সাবটাইটেল বানানোর কাজ চলছে। সব দেখাশোনা শেষে দোতলার হলঘরে আবার ফিরে এলাম সবাই। তখন আলিনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, ওঁদের ওখানে কনফারেন্স, মিটিং ইত্যাদি ওই হলঘরে সেই সব কাঠের ডেস্কে বসেই হয় কিনা। আলিনা বলেছিলেন নিশ্চয়ই হয়। তবে কাঠের ডেস্কগুলোও পূর্ব জার্মানির সংসদ ভবন থেকে আনা। ডেস্কগুলো এমন করে বানানো যে সেগুলো লেখাপড়ার কাজেও ব্যবহার করা যায় আবার একটু এ-ধার ও-ধার করে সিনেমা দেখার কাজেও ব্যবহার করা যায়। পূর্ব জার্মানির এক দ্রব্য বহু ব্যবহারের উদ্ভাবনীকে কুর্নিশ করে বেরিয়ে এলাম। আসার আগে আলিনা বলেছিলেন, নীচের তলার পাসপোর্টের সংগ্রহ আর ওই এক খণ্ড বার্লিন দেওয়াল দেখে যেতে। বার্লিন দেওয়াল খণ্ডের পিছনে তখন চরাচর ব্যাপি প্রশান্ত মহাসাগর আর অস্তোন্মুখ সূর্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE