আজকাল কলকাতার জন্য বড্ড বেশি মন কেমন করে। বহু দূরের কোনও অতীতের পাতা থেকে উঠে আসা ধূসর চিঠির মতো আমার শহর। সে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের স্তরে স্তরে। আমার স্মৃতির পরতে পরতে। উত্তর কলকাতার অন্ধ গলির সোঁদা গন্ধে, লালপেড়ে শাড়ির আঁচলে বাধা চাবির গোছায়, কাঁসা পিতলের গন্ধে, শ্যাওলা ধরা উঠোনে, হেমন্তের পড়ন্ত বেলার মন কেমনে, পায়রাগুলোর বকম বকম শব্দে, চাই বে...ল...ফুল ডাকে, ট্রামের ঘটর ঘটর আর রিকশা দাদুর টুংটাং শব্দে, বসন্ত মালতীর গন্ধ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে আমার উত্তর কলকাতা। আর লেক গার্ডেন্সের পাড়ায় মাসি-পিসি, জেঠি-কাকিদের অকারণ আস্কারা। মা-বাবার হাত ধরে লিলি পুলে ফোটো সেশন, লেকের জলে টলটলে পূর্ণিমা, বিশাল বিশাল গাছের ছায়ায় অকারণ ছুটোছুটি, লেক মার্কেটের আলো-ছায়া, গড়িয়াহাট ধরে মায়ের সঙ্গে শাড়ির দোকান, ডোভার লেনে কলামণ্ডলম নাচের তাল, মুদ্রা, বোল, রবীন্দ্রনাথ, পাড়ার দুর্গাপুজোর রিহার্সাল, মহালয়ার প্রভাত ফেরি, অনাবিল আনন্দে ভরে আছে আমার দক্ষিণ কলকাতা।
বাবার ছিল উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানা আর মায়ের দক্ষিণ কলকাতার আভিজাত্য। তাই, দুই কলকাতা মিলে-মিশে এক হয়ে গিয়েছিল আমার জীবনে। মনে পড়ে রবিবারের দুপুরগুলো দিদার নরম আঁচলে নিজেকে মুড়ে এক মনে রেডিওতে শুনতাম রোমহর্ষক নাটক। শেষ হলেই গল্পদাদুর আসর। আর তার পরেই মা-বাবার সঙ্গে লেক গার্ডেন্স থেকে সোজা কলেজ স্ট্রিটে ঠাকুর্দার বাড়ি। সেখানে সবটুকুই বড় অন্য রকম, সাবেক কালের। এখনও মাঝে মাঝে চলে যাই সেই পাড়ায়। আঁতিপাঁতি খুঁজতে থাকি হারিয়ে যাওয়া সেই সাবেকিয়ানাকে।
আমার দাদু রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। কলকাতা বিশেষজ্ঞের অন্যতম। দাদুর কোলে বসে কখন যেন কলকাতাকে ভালবাসতে শিখেছিলাম। এর ইতিহাস, এর ঐতিহ্য আমাকে গর্বিত করত। আর সেই অনুভূতি আমার শিরায় শিরায়, রক্তে রক্তে এক অদ্ভুত শিকড় মেলে দিয়েছিল। আমি আজও তা অনুভব করি। মা-বাবা ছিলেন শিল্পী। বাড়িতে ছিল শিল্প সাহিত্য চর্চা। ক্যানভাস, রং, তুলি, নাচ-গান, নাটক-রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, শক্তি, সুনীল, গণেশ পাইন, রামানন্দ, কণিকা, দেবব্রত, উত্তম-সুচিত্রা, শৈশবের অনেকগুলি মুখ।
চার বছর বয়সে নৃত্যের হাতে-খড়ি দিদার উদ্যোগে। সেই আমার আজীবন সঙ্গী হয়ে রয়ে গেল। আমার নৃত্যজীবনের প্রেক্ষাপটেও আমার কলকাতা। আমার গুরু থাঙ্কমণি কুট্টির কাছে আমার নৃত্য শিক্ষা। তার সাক্ষীও এই শহর। ডোভার লেনের ওই লাল মেঝের ঘর, বিশাল জানালা-যার মধ্য দিয়ে নানা ঋতুর উঁকিঝুকি, আর তার সঙ্গে উঁকিঝুঁকি প্রথম কৈশোরের রঙিন কল্পনা, অস্ফুট ভালবাসার। সেই ভালবাসার ছবিটি ধীরে ধীরে রূপ নিল এক লাজুক কিশোরের, যার কণ্ঠে প্রথম বেজে উঠল-‘আজি বিজন ঘরে... আসবে যদি শূন্য হাতে’।
আসলে কলকাতা হল আমার কাছে অনেক মুখের, অনেক গল্পের, অনেক ঘটনার একটি কোলাজ চিত্র। মাঝে মাঝে কাজের অবসরে একা যখন সেই কোলাজটিতে চোখ বোলাই হলুদ হয়ে যাওয়া খামের মধ্যে থেকে উঁকি দেয় সাদা কালো সিপিয়ায় হরেক ছবি। না, তাদের রং দিতে ভাল লাগে না। তারা তাদের বিবর্ণতা দিয়ে বর্ণময় গল্প লেখে— পাঠভবন, আমার স্কুলের গল্প, বন্ধুদের গল্প, শৈশবের, যৌবনের, প্রেমের প্রতীক্ষার নানান গল্প। তাদের কত মুখ, কত রং, কত আনন্দ। এই স্মৃতিগুলিই আমার সব চেয়ে কাছের বন্ধু। ভিড় করে এসে একা ঘিরে থাকে আমায়, আমার আজকের দিনগুলিকে। আর তাদের ঘিরে চলচ্চিত্রের মতো জেগে থাকে আমার শহর কলকাতা— আমার প্রথম প্রেম, আমার চিরদিনের আশ্রয়। সেই শিল্পের শহর, সাহিত্যের শহর, আড্ডার শহর, অলসতার শহর, প্রেমের শহর, ঐতিহ্য ইতিহাসের শহর, সাহেবি গন্ধ মাখা শহর, বই পাগল শহর, আমার শহরকে মনের মণিকোঠায়, সোনার জলে বাঁধিয়ে রেখেছি। এই শহরে বসে সেই শহরের স্বপ্ন দেখি, তাকে মনে করি। আসলে আজ যে কলকাতার আমি বাসিন্দা সে আমার কাছে অনেকটা অপরিচিত। আর কিছুটা মন কেমন করা। তবও সে আমার, তবুও তাকেই ভালবাসি।
লেখক: নৃত্যশিল্পী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy