Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ছোটবেলায় না ঘুমিয়েও সারা রাত শুনেছিলাম রবিশঙ্করের সেতার

আমার বাবা চিন্ময়জীবন ঘোষ ছিলেন এক জন অসামান্য অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং সাহিত্যবোধসম্পন্ন মানুষ। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান আমি। সেই কারণে পিতৃ-সান্নিধ্যের ক্ষেত্রে হয়তো কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলাম। সব সময় পেয়েছি বাবার সান্নিধ্য। অভিনয় বা আবৃত্তিচর্চা বাবার পেশা ছিল না, কিন্তু ব্যক্তিগত উৎকর্ষ ও অভিরুচির জন্য নিয়মিত চর্চার বিষয় ছিল। তাঁর এই ধরনের সব কাজেই তিনি আমাকে সঙ্গে রাখতেন।

প্রদীপ ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আমার বাবা চিন্ময়জীবন ঘোষ ছিলেন এক জন অসামান্য অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং সাহিত্যবোধসম্পন্ন মানুষ। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান আমি। সেই কারণে পিতৃ-সান্নিধ্যের ক্ষেত্রে হয়তো কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলাম। সব সময় পেয়েছি বাবার সান্নিধ্য। অভিনয় বা আবৃত্তিচর্চা বাবার পেশা ছিল না, কিন্তু ব্যক্তিগত উৎকর্ষ ও অভিরুচির জন্য নিয়মিত চর্চার বিষয় ছিল। তাঁর এই ধরনের সব কাজেই তিনি আমাকে সঙ্গে রাখতেন। ফলে, অক্ষর পরিচয়েরও আগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবীনচন্দ্র সেন— এঁদের রচনা আমাকে প্রভাবিত করত। পড়তে না পারলেও শুনে শুনে শেখা কবিতা আত্মীয়-বন্ধু মহলে আমাকে শোনাতে হত। আমার বাবা সে কালে তৈরি করেছিলেন নোয়াখালি ড্রামাটিক ক্লাব এবং তাঁর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘রক্তকরবী’ নাটক। রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় সেটি ছিল এই নাটকের দ্বিতীয় প্রযোজনা। গোটা বাংলাদেশ থেকে সেই অভিনয় দেখতে এসেছিলেন বিদ্বজ্জনেরা। বাবার উৎসাহে তাঁর সঙ্গে শুনতে গিয়েছি দিলীপকুমার রায়ের গান। দেখেছি উদয়শঙ্করের নৃত্যকলা। পি সি সরকারের ম্যাজিক। বহুরূপীর নাটক। এই ভাবে ছেলেবেলায় তৎকালীন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে বাবারই সূত্রে।

দেশের উত্তাল অবস্থায় ১৯৪২-এর অগস্ট মাসে আমার জন্ম। মা কণিকা দেবীও ছিলেন সুরুচিসম্পন্না। সংস্কৃতিতেও আগ্রহী ছিলেন তিনি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গে আমাদের চলে আসতে হয়েছিল দেশভাগের আগেই। তখনকার অনেক স্মৃতি আজও আমাকে ভাবায়। তখন বউবাজারে সরকারি আবাসনে থাকি। বাবার সঙ্গে পরিচয় সূত্রে বাড়িতে এসেছিলেন নবীন সেতার সাধক রবিশঙ্কর এবং সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। সারা রাত বাজিয়েছিলেন রবিশঙ্কর— তাঁর সেই দিব্যকান্তির বিভা আজও মনে আছে।

স্কুলের স্মৃতি বলতে মনে পড়ে খড়্গপুরের সিলভার জুবিলি হাই স্কুলের কথা। তার পর... ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট স্কুল, বউবাজার বয়স্কুল, দমদমে কুমার আশুতোষ, বরাহনগরে নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দির। শেষোক্ত স্কুল থেকেই আমি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিই। তখন ছাত্রাবাসে থাকতাম। অনতিদূরেই থাকতেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ি। বন্ধুর বাবার সূত্রে নাট্যাচার্যের স্নেহ-সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। ছোটদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ নাটকটি উপস্থাপনের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, ঘটনাটি আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছে। ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট স্কুলের অনেক শিক্ষকের কথা মনে পড়ে, যাঁরা আবৃত্তি-অভিনয়ের ব্যাপারে শুধু উৎসাহ দান নয়, আমাকে প্রভাবিত করেছেন। অজিত সেন মহাশয় আমাকে দিয়ে আবৃত্তি করান মোহিতলাল মজুমদারের কালাপাহাড়। এক দিন তিনি বললেন, ‘কবিকে দেখতে যাবে?’ ভোর পাঁচটায় উঠে গেলাম কবির বড়িশার বাসভবনে। মোহিতলালের সঙ্গে সাক্ষাৎ কালে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা ছিল না। তবু, তাঁকে তাঁর কবিতা ‘কালাপাহাড়’ শোনাবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কবিতা শোনার পর কবি প্রশ্ন করলেন, ‘কবিতাটি বুঝে পড়েছ, তাই না?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, মাস্টারমশাইয়ের নির্দেশ মতো।’ কবির কথাটি ছিল দিক্-নির্দেশের মতো— যা পড়ছ, বুঝে পড়বে, কেমন? কথাটা সহজ। কিন্তু, এই চিন্তাটা আমার মধ্যে স্থায়ী হয়ে গেল। অল্পবয়স থেকেই অনেক অনুষ্ঠানে কবিতা শোনানোর ডাক পেতাম। পোস্টারে নাম লেখা থাকত মাস্টার প্রদীপ বলে। এ ভাবেই ছবি আঁকা, কবিতা পড়া, বই পড়া, প্রকৃতিকে চেনা তখন আমার কাছে ছিল জীবনের আনন্দ-আকর্ষণ।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

খড়্গপুরে গাঁধী আশ্রম থেকে আসতেন সৌম্যদর্শন এক জন মানুষ। বাড়িতে খাঁটি দুধ পৌঁছে দিতেন। ক্রমে আমার জীবনে তাঁর ভূমিকা বদলে গেল। দুধ পৌঁছে দেওয়া উপলক্ষ মাত্র। হিজলির আশে-পাশে শাল-মহুয়ার বিস্তীর্ণ জঙ্গল, খরগোশ, সাপ, কাঠবিড়ালী, বিচিত্র নানা পাখির আবাস। তাদের সান্নিধ্য, ডাক অন্তরঙ্গ ভাবে চিনেছিলাম ওই কানুদার জন্য। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পটভূমিতে সূর্যকে কেমন লাগে, সূর্যোদয়েরও আগে হয় অরুণোদয়, ভোর ও সায়াহ্নের কাকলি যে এক নয়, তা চিনেছিলাম। জেনেছিলাম আদিবাসী, সাঁওতালদের জীবনযাপনকেও। আমার কিশোর বয়সে এরাই জুড়ে থেকেছে।

নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরের পণ্ডিতমশাই ক্ষীরোদবাবু শিখিয়েছিলেন সংস্কৃত কবিতার খুঁটিনাটি। স্তোত্র লিখেছি। অম্বাস্তোত্র, সরস্বতীস্তোত্র— সুর দিয়ে অনুষ্ঠানে গেয়েছে বন্ধুরা। আমার আর এক জন শিক্ষক জগবন্ধু শেঠ। আমার অস্থিরচিত্ততায় উদ্বিগ্ন হয়ে মনে করতেন আমার সৃজনশীলতার সঙ্গে অল্পবয়সের চাপল্যের সংঘাত ঘটতে পারে। তাই শিখিয়েছিলেন বাগান করা। এই ফুলগাছ তোমার। জল দেবে। পরিচর্যা করবে। এক দিন ফুল হলে তা হবে তোমার সৃষ্টি। এ ভাবে একটা ফুলগাছের সঙ্গে কেমন নিবিড় আত্মীয়তা, একাত্মতা গড়ে ওঠে তা অনুভব করেছিলাম। এমন অনেক মানুষের কাছেই অজানতে পেয়েছি জীবনের পাঠ। গড়ে উঠেছে শব্দ চেনা ও চেনানোর তাগিদ।

আবৃত্তি পাঠে ব্যস্ত।

কবিতা বলার সময় আমি নিজেকে খুঁজে পেতে, ব্যক্ত করতে চেষ্টা করি। বিনোদনের জন্য নয়, আলোকিত আনন্দের জন্য। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, আরব, বাংলাদেশ গিয়েছি বার বার। কবিতার ঝুলি নিয়ে কবিতামনস্ক মানুষ নন যাঁরা, তাঁদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি কবিতার শব্দের সংসার, একটা অভিপ্রায় ও আন্তরিকতা নিয়ে। চার/পাঁচ ঘণ্টা একটানা কবিতা নিবেদন করেছি। কথা বলে পার্থিব উদ্দেশ্য নয়, অপার্থিব এক আনন্দ, জীবনের রসদ আর অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাকে নানা আড়ম্বরের আকর্ষণ থেকে বঞ্চিত করে বাঁচিয়ে রেখেছে।

বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে পড়াকালীন পেয়েছি স্বামী তেজসানন্দকে। স্নাতক স্তরের ছাত্র হিসাবে পেয়েছি কবি বিষ্ণু দে-কে। পরবর্তী সময়ে শিবরাম চক্রবর্তী, যামিনী রায়, সত্যেন বসু (বিজ্ঞানাচার্য)— তাঁরা সন্তানের মতো ভালবেসেছেন। শিল্পাচার্য যামিনী রায় এঁকে দিয়েছিলেন আমার বিবাহের আমন্ত্রণপত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে দেখেছি কবি শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, নরেশ গুহর মতো ব্যক্তিত্বদের।

১৯৭০-এ এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম রেকর্ড। আমার কবিতা-জীবনে সবচেয়ে স্নেহ-সান্নিধ্য যাঁর কাছ থেকে পেয়েছি তিনি কাজী সব্যসাচী। প্রতি দিন তাঁর কথা, বাবার কথা স্মরণ না করে পারি না। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি কে, কেমন, কতটা— বলতে যাওয়া স্পর্ধা। কবি নজরুলের নীরবতা পর্বে ক্রিস্টোফার রোড, ঢাকায় তাঁর কাছে থেকেছি। অল্প দিন, কিন্তু সুবিস্তৃত অভিজ্ঞতা। এ ভাবেই বলতে পারি কবি জীবনানন্দ দাশের নাম। আর, আমার জীবন জুড়ে আছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কবি, বাংলাদেশের মানুষজন।

বাংলার আরও অনেক কবি-শিল্পী, নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষজন— যাঁরা অনেকেই আজ অমর্ত্যলোকে— আমার জীবনে তাঁরা নিয়ত প্রত্যক্ষ, তাঁদের কাছ থেকে আলো নিয়ে আমার পথ-চলা। সেই আলোই সকলের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। দিতে চেষ্টা করি। আর্থিক নয়, আত্মিক বিকাশের প্রয়াস। আলোর অন্বেষণেই।

লেখক: আবৃত্তি শিল্পী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE